মুন্সিগঞ্জ, ৯ এপ্রিল, ২০২০, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
দেশে যখন করোনা আতঙ্কে পরিবারের সবাই ঘরবন্দি তখন একই কারনে দেশের বাইরে কর্মহীন হয়ে পড়া মুন্সিগঞ্জের কয়েক লক্ষ প্রবাসীরা ভালো নেই।
নিরবে কুকড়ে কাঁদছেন তারা। দেশ থেকে যারা তাদের সান্ত্বনা দেবেন তারাও ভালো নেই। যেখানে বেচেঁ থাকাটাই চ্যালেঞ্জ সেখানে সুখ-দুঃখ আর কষ্টের অনুভূতিগুলো কারো কাছে বলার সুযোগও নেই।
করোনার সংক্রমণ এড়াতে মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বড় বড় শহর লকডাউন করে দেয়া হয়েছে। প্রতিদিন বাড়ছে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা। অচল হয়ে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্য। বন্ধ রয়েছে সকল হোটেল-রেষ্টুরেন্ট ও শপিংমলগুলো। এমন পরিস্থিতিতে সেখানে বেচেঁ থাকাটাই তাদের কাছে চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে।
সোশ্যাল মিডিয়া ফেইসবুক, প্রবাসীদের পরিবার, প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন ও গত কয়েকদিনে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে এ চিত্র দেখা গেছে।
এর মধ্যে বিভিন্ন দেশ ‘অবৈধ প্রবাসীদের ফিরিয়ে আনতে সরকারকে চাপ দিচ্ছে’ এমন খবরে উদ্বেগ আরও বেড়ে গেছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আবদুুল মোমেন, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমেদ সহ সরকারের একাধিক সূত্র বলছে, বাহরাইন, কাতার ও কুয়েতে বর্তমানে প্রায় ৩৮ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি আছেন। সৌদি আরব ও ওমানে কয়েক হাজার অবৈধ প্রবাসী আছেন। একইসঙ্গে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও মালদ্বীপও তাদের দেশে থাকা অবৈধ বাংলাদেশিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে ঢাকাকে চাপ দিচ্ছে।
প্রবাসীপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত মুন্সিগঞ্জ জেলার ঠিক কতজন বিদেশে রয়েছেন তার সঠিক তালিকা নেই।
তবে, একটি বেসরকারি সংস্থার তথ্য বলছে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মুন্সিগঞ্জের ২ লাখ ৭০ হাজার জন বিদেশে রয়েছেন এবং বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি বিদেশে রয়েছে এমন ১০টি জেলার মধ্যে অষ্টম স্থানে রয়েছে মুন্সিগঞ্জ। শতাংশের হিসাবে ৩.০৬। ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত এই সংখ্যা প্রায় ৩ লাখ বলে ধারনা করা যায়।
সরকারি তথ্যে মুন্সিগঞ্জ জেলায় সবচেয়ে বেশি প্রবাসী মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলাতেই। এই উপজেলায় বিদেশে রয়েছেন প্রায় ২০ হাজার মানুষ। এদের মধ্যে অস্বচ্ছল পরিবারের সংখ্যাই বেশি।
এর মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে কিছুটা দূর্বল মুন্সিগঞ্জের ৫টি চরাঞ্চল- চরকেওয়ার, মোল্লাকান্দি, আধারা, শিলই, বাংলাবাজারের ৭ হাজার জনেরও বেশি বিদেশে রয়েছেন।
যার বেশিরভাগই বিদেশে গেছেন ধার-দেনা অথবা জমি-সম্পত্তি বিক্রি করে।
পরিবারের হিসেব করলে শুধুমাত্র মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার ৫ চরের ৬ হাজার পরিবারের সদস্যরা বিদেশে ভালো নেই।
আর দেশে তাদের আত্মীয়-স্বজনরা রয়েছেন নানা উদ্বেগ আর সমস্যায়। চাকরি হারানো অথবা যে কোন সময়ে দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ে যাওয়া নিয়ে তাদের মধ্যে আর্থিক সংকটে পড়ার দুশ্চিন্তা দিনকেদিন প্রকট হচ্ছে।
মুন্সিগঞ্জ সদরের মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের রাজারচর গ্রামের আশা বেগম যার স্বামী মামুন মিঝি (২৫) বর্তমানে মালয়েশিয়া রয়েছেন তিনি জানান, ‘মালয়েশিয়াতে করোনার প্রভাবে তার স্বামী ঘড়বন্দি রয়েছেন। তার কাজ ও বেতন বন্ধ রয়েছে। এর প্রভাব তাদের পুরো পরিবারেই পড়েছে।’
জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সহকারি পরিচালকের কাছে বিদেশে অবস্থানরত কর্মহীনদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কোন সুযোগ-সুবিধা বা প্রণোদনা দেওয়া হবে কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘করোনা পরিস্থিতিতে যারা বিদেশে ঘড়বন্দি হয়ে আছেন তাদেরকে স্ব স্ব দেশের দূতাবাসের মাধ্যমে আর্থিক প্রণোদনা দেয়ার পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে।’
মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) দীপক কুমার রায়ের কাছে প্রবাসীদের দেশে থাকা পরিবারের জন্য সরকার বা জেলা প্রশাসনের আলাদা কোন সাহায্য-সহযোগিতার নির্দেশনা বা পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সরকারি এ ধরনের কোন নির্দেশনা আমাদের কাছে নাই’।
তিনি বলছেন, ‘সরকারের নির্দেশনা আছে যারা হতদরিদ্র মানুষ, যারা খেটে খাওয়া মানুষ, দিনমজুর তাদেরকে সহযোগিতার একটা বিষয় আছে। সেই ক্ষেত্রে আমাদের তালিকা তৈরির কাজ চলমান আছে।’
প্রবাসীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম-(ওকাপ) এর চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আজকের অবস্থানে নিয়ে আসার জন্য যাদের অবদান সবচেয়ে বেশি তারা হচ্ছেন এই অভিবাসী কর্মীরা। করোনা পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ এই অভিবাসী কর্মীরাই।’
তিনি বলছেন, ‘সরকার অন্যান্য জনগোষ্ঠীর জন্য যেভাবে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করেছে। সেখানে অভিবাসী কর্মীদের জন্য আলাদাভাবে না ভাবাটা আমাদের হতাশ করেছে। এটা দুঃখজনক।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে জোরালো দাবি করছি, যারা বিদেশে অবস্থানরত আছেন তাদের জন্য প্রণোদনার পাশাপাশি তাদের যারা পরিবার দেশে আছে, যারা সমস্যায় আছে তাদের জন্য আলাদা প্রণোদনা প্যাকেজ দিতে হবে।’