মুন্সিগঞ্জ, ২২ এপ্রিল, ২০২২, সাজ্জাদ হোসেন (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চ ভাঙা, সাউন্ড ব্যবস্থা নষ্ট, পর্যাপ্ত আলোক বাতি নেই, বৃষ্টি হলেই ছাদ চুয়ে পড়ে পানি, বেশিরভাগ চেয়ার ব্যবহার অনুপযোগী, আছে কক্ষ সংকট।
প্রায় ১০ বছর যাবত নির্বাচনের মাধ্যমে কোন কমিটিও গঠন হয়নি। স্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কালচারাল অফিসারও নেই। বছরের পর বছর ধরে এমন সমস্যার সম্মুখীন শিল্পীরা। তবুও এ জেলার শিল্পীরা সাংস্কৃতিক চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন।
সবার দাবি, শিল্পকলা একাডেমীর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিগগির নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হোক। শিল্পীরা জানান, ১৫ বছর আগে নির্মিত শিল্পকলা একাডেমীতে দীর্ঘদিন যাবত নানা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন শিল্পীরা। প্রায় ৫ বছর যাবত মঞ্চ ভাঙা। গ্যালারির বেশিরভাগ চেয়ারও ব্যবহারের অনুপযোগী। প্রায় ৪ বছর যাবত সাউন্ড সিস্টেম নষ্ট। দর্শক শ্রেণির বেশিরভাগ চেয়ার ও ফ্যান নষ্ট। প্রায় ৩-৪ বছর যাবত দুইতলা গ্যালারির দুইটি টয়লেট পরিত্যক্ত। অডিটোরিয়ামের পলেস্তারা খসে পড়েছে। শিল্পকলা একাডেমির অডিটোরিয়াম ভাড়া করেও কোন সুবিধা পাওয়া যায়না। অতিরিক্ত টাকা গুনে দোকান থেকে ভাড়া নিয়ে অনুষ্ঠান করতে হয়। আলোকসজ্জা, সাউন্ড সিস্টেম, পর্দা, ফ্যান, চেয়ার, জেনারেটরসহ আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র ভাড়া নিতে হয়। শিল্পকলা একাডেমি অডিটোরিয়াম ভাড়া করে একদিনের অনুষ্ঠান করতে প্রায় ১০-১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ লাগে।
একাডেমি সূত্রে জানা যায়, ভ্যাটসহ সরকারি অডিটোরিয়াম ভাড়া ৩ হাজার ৪৫০ টাকা, বেসরকারি ভাড়া ৯ হাজার ৭৭৫ টাকা, সম্মিলিত সংস্কৃতিক জোটভুক্ত সংগঠনের জন্য ২ হাজার ৮৭৫ টাকা। কিন্তু এ টাকা দিয়েও কোন সুবিধা পাওয়া যায়না। স্থানীয় দোকান থেকে একদিনের জন্য আলোকসজ্জার জন্য ৩ হাজার ৫০০ টাকা ও সাউন্ড সিস্টেম ৩ হাজার ভাড়া নিতে হয়।
জেলা শিল্পকলা একাডেমির অফিস সহকারি আবু সাইদ বলেন, দীর্ঘদিন যাবত শিল্পকলা একাডেমীর বেহাল দশা। মঞ্চ ভাঙা, সাউন্ড নষ্ট, আলোক বাতি নষ্ট, বৃষ্টিতে পানি পড়ে, কক্ষ সংকট, বিদ্যুৎ সংযোগে সমস্যা। প্রায় ৫ বছর যাবত ভেঙে যাওয়া মঞ্চ স্থায়ীভাবে ঠিক করা হচ্ছে না। কোন অনুষ্ঠান সামনে থাকলে জোড়াতালি দিয়ে মেরামত করা হয়। প্রায় ৯ মাস যাবত কালচারাল অফিসার ছাড়া অফিস করেছি। বর্তমানে একজন সহকারি কমিশনার (ভূমি) অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসাবে আছেন।
তিনি আরও জানান, গত এক বছরের বকেয়া সম্মানি ঈদের পূর্বে শিল্পীদের জন্য আসার কথা থাকলেও এটি আসেনি। প্রায় ৪ বছর যাবত প্রশিক্ষকরা সম্মানী পাননা। প্রতিমাসে প্রশিক্ষকের ১৪০০ টাকা ও সহকারি হিসাবে ১২০০ টাকার সম্মানী পাচ্ছেন না। তাছাড়া শিল্পকলা একাডেমির স্টাফরা এক মাস পরপর বেতন পেয়ে থাকে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত বছর সীমিত একটি বাজেটের মাধ্যমে কিছু সংস্কার কাজ হয়েছিল। তিনটি কক্ষে টাইলস করা হয়েছিল, পর্দা ও আলোক বাতির কাজ হয়। একটি কনফারেন্স রুম মেরামত করা হয়েছিল। তিনটি কক্ষ রঙ করা হয়েছিল। তবে পুরো ভবন রঙ করতে পারেনি। অল্প বরাদ্দ থাকায় সব সমস্যার দূর হয়নি।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাবেক সভাপতি মতিউল ইসলাম হিরু বলেন, শিল্পকলা একাডেমিতে স্থায়ীভাবে একজন কালচারাল অফিসার নিয়োগ দেওয়া জরুরি। শিল্পকলা একাডেমির সমস্যা নিরসনে প্রশাসন, শিল্পী, প্রশিক্ষক, কালচারাল অফিসারসহ সবার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
আমার জানা মতে, প্রায় ৯-১০ বছর যাবত শিল্পকলা একাডেমিতে কোন কমিটি নেই। নির্বাচন না হওয়ার কারণে প্রাণচঞ্চল পরিবেশ তৈরি হচ্ছে না। তিনি জানান, শিল্পকলা একাডেমির সভাপতি জেলা প্রশাসক। সদস্য সচিব হিসাবে একজন নিয়োগ পেতে হলে নির্বাচন দরকার। এ ব্যাপারে প্রশাসন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। করোনাকালীন সময়ে ঢাকা থেকে একজন কালচারাল অফিসারের নিয়োগ চূড়ান্ত হয়েছিল। কিন্তু নানাবিধ কারণে ওই কর্মকর্তা আসেনি।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক সাব্বির হোসেন জাকির জানান, শিল্পকলা একাডেমিতে কমিটি না থাকার কারণে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিল্পীরা। ঢাকার মাধ্যমে যেসব অনুষ্ঠান জেলা পর্যায়ে করার কথা এগুলো বন্ধ। জেলা শহরের শিল্পকলা একাডেমি আধুনিক হওয়া প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে ১২-১৩ টি জেলা আধুনিক শিল্পকলা একাডেমির সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। কিন্তু মুন্সিগঞ্জ এ তালিকায় ছিলনা। মঞ্চ ভাঙা থাকায় শিল্পীরা মাঝেমধ্যে আহত হয়। সরকারি, বেসরকারি কোন অনুষ্ঠান হলে অস্থায়ীভাবে তাৎক্ষনিক মঞ্চ মেরামত করা হয়। কিন্তু এরপর সে সমস্যা থেকেই যায়। গরমের দিনে এখানে কোন কাজই করা যায়না। এর জন্য বাহিরে এখন অনুষ্ঠান করা হয়। কেননা ভিতরে অনুষ্ঠান করতে হলে অনেক খরচ লাগে। বিচ্ছিন্নভাবে বেশকিছু সংস্কার হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এমনকি শিল্পকলা একাডেমির বাহিরের রঙ পুরোপুরি সম্পূর্ণ করতে পারেনি।
তিনি আরও জানান, এ জেলার অনেক শিল্পী ঢাকার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে জেলার সুনাম অর্জন করছে। গণসংগীত প্রতিযোগিতা, নাট্যউৎসবে এ জেলার শিল্পীদের অংশগ্রহণ রয়েছে। ভারতের নাট্য উৎসবেও আছে মুন্সিগঞ্জের শিল্পীদের সুনাম। কিন্তু শিল্পকলা একাডেমীর বেহাল অবস্থার কারণে নতুন শিল্পী তৈরি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি সুজন হায়দার জনি বলেন, জেলার সংস্কৃতি চর্চার বিকাশে শিল্পকলা একাডেমি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু আমাদের জেলা শিল্পকলা একাডেমির খুবই জরাজীর্ণ অবস্থা। অবকাঠামোগত ভাবেও জরাজীর্ণ, ব্যবস্থাপনার দিক থেকেও জরাজীর্ণ।
তিনি বলেন, এই শিল্পকলা ভবনটি আসলে শুধুই একটি দেয়ালের প্রাচির। ভেতরে কোন ধরনের সুযোগ সুবিধা নেই। নাটক মঞ্চায়নের অনুপযোগী এই মঞ্চটি মোটেও বিজ্ঞান সম্মতভাবে তৈরি হয়নি। এখানে লাইট নেই, সাউন্ড নেই। নাটক মঞ্চায়ন বা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এগুলো ভাড়া করে আনতে হয়। এছাড়া মিলনায়তনের বসার চেয়ারগুলো দুমড়ে মুচড়ে গেছে। সামান্য বৃষ্টি হলে টিনের চালার ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ে মঞ্চ ভেসে যায়। অপরিচ্ছন্ন ময়লা আবর্জনার ভাগাড় হয়ে থাকে শিল্পকলার আশপাশ। এভাবেতো সৃজনশীল চর্চা করা যায় না। সৃজনশীল চর্চার বিকাশের জন্য পরিবেশ প্রয়োজন হয়। এছাড়া দীর্ঘ দিন ধরে জেলা শিল্পকলা একাডেমির কোন কমিটি নেই। একটি নির্বাচিত কমিটি থাকলে হয়তো কিছুটা হলেও সাংস্কৃতিক চর্চাবান্ধব হয়ে ওঠতো জেলা শিল্পকলা একাডেমি।
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) ও কালচারাল অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মো. কামরুল হাসান মারুফ জানান, শিল্পকলা একাডেমীর সংস্কারের জন্য গত অর্থবছর কোন বরাদ্দ এসেনি। আগামী অর্থবছর বরাদ্দের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হবে। এ শিল্পকলা একাডেমীতে জেলা প্রশাসক সভাপতি ও কালচারাল অফিসার সদস্য সচিব হিসাবে থাকেন। নির্বাচনের কোন প্রক্রিয়া থাকলে সেটিও খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি আরও জানান, এক মাসের কম সময় যাবত দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। প্রায় ৯ মাসের বিদ্যুৎ বিল, ঝাড়ুদারের বিল ও ইন্টারনেট বিল বাকি আছে। জেলা প্রশাসকের সাথে এসব বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে।