প্রথাবিরোধী লেখক অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের ৭৩তম জন্মদিন আজ। ১৯৪৭ সালের ২৮ এপ্রিল মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
আজাদ ১৯৪৭ সালে মুন্সিগঞ্জ জেলার বিক্রমপুরে তাঁর নানাবাড়ি কামাড়গাঁওয়ে জন্ম নেন, তাঁর জন্ম নাম ছিলো হুমায়ুন কবীর। ১৯৮৮ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর নাম পরিবর্তনের মাধ্যম তিনি বর্তমান নাম ধারণ করেন। বাবা আবদুর রাশেদ প্রথম জীবনে বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও পোস্টমাস্টারির চাকুরি করতেন, পরে ব্যবসায়ী হন। মা জোবেদা খাতুন একজন গৃহিণী ছিলেন। তিন ভাই এবং দুই বোনের মধ্যে আজাদ ছিলেন পিতামাতার প্রথম পুত্রসন্তান। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে। তিনি ছেলেবেলায় প্রায় ১৫ বছর বয়স পর্যন্ত রাড়িখাল গ্রামে বেড়ে ওঠেন।
১৯৫২ সালে হুমায়ুন ‘রাড়িখাল প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’ প্রথম শ্রেণীতে ভর্তি হন, ওখানে তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েন, এরপর ১৯৫৫ সালে তৃতীয় শ্রেণী বাদ দিয়ে তিনি সরাসরি চতুর্থ শ্রেণীতে ভর্তি হন রাড়িখালের ‘স্যার জে সি বোস ইন্সটিটিউশন’-এ, যেটাতে তৃতীয় শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ছিলো। ছেলেবেলা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। এ বিদ্যালয় থেকে তৎকালীন ‘ইস্ট পাকিস্তান সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ড’ এর অধীনে ১৯৬২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন (ম্যাট্রিক বা মাধ্যমিক) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ১৯৬৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট (উচ্চ মাধ্যমিক) পাশ করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি এবং ১৯৬৮ সালে একই বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হন। ২০১৬ সালে তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বন্ধু স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে বলেন যে, তার এই বন্ধুটি লেখাপড়ায় খুবই মনোযোগী ছিলো এবং সে বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে বই পড়ে অনেক সময় ব্যয় করতো।
১৯৭৬ সালে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল বাংলা ভাষায় সর্বনামীয়করণ এই গবেষণাপত্র পরবর্তীকালে ১৯৮৩ সালে প্রোনমিনালাইজেশান ইন বেঙ্গলি নামে বাংলা একাডেমি থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
বহুমুখী সাহিত্য প্রতিভার অধিকারী স্বতন্ত্র ও প্রথাবিরোধী লেখক হিসেবে সুপরিচিত হুমায়ুন আজাদ কর্মজীবনে অধ্যাপনা পেশা বেছে নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, সমালোচক, গবেষক, ভাষাবিজ্ঞানী, কিশোর সাহিত্যিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার।তিনি বাংলাদেশের প্রধান প্রথাবিরোধী এবং বহুমাত্রিক লেখক যিনি ধর্ম, মৌলবাদ, প্রতিষ্ঠান- ও সংস্কারবিরোধিতা, নিরাবরণ যৌনতা, নারীবাদ ও রাজনীতি বিষয়ে নির্মম সমালোচনামূলক বক্তব্যের জন্য ১৯৮০-র দশক থেকে ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠীর দৃষ্টি আর্কষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। গতানুগতিক চিন্তাধারা তিনি সচেতনভাবে পরিহার করতেন। তাঁর নারী (১৯৯২), দ্বিতীয় লিঙ্গ (২০০১) এবং পাক সার জমিন সাদ বাদ (২০০৪) গ্রন্থ তিনটি বিতর্কের ঝড় তোলে এবং নারী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত ঘোষণা করা হয়েছিল।
অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ ছিলেন একজন প্রথাবিরোধী ও বহুমাত্রিক মননশীল লেখক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৬০টির বেশি। আজাদের ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ২২টি সমালোচনা গ্রন্থ, ৮টি কিশোরসাহিত্য, ৭টি ভাষাবিজ্ঞানবিষয়ক গ্রন্থ তাঁর জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর অব্যবহিত পরে প্রকাশিত হয়। ১৯৯২ সালে নারীবাদী গবেষণামূলক গ্রন্থ নারী প্রকাশ করে গোটা দেশে সাড়া তোলেন। বইটি ১৯৯৫ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ছিলো। এ গ্রন্থ তাঁর বহুল আলোচিত গবেষণামূলক কাজ হিসেবেও স্বীকৃত। তাঁকে ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১২ সালে সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম এবং ভাষাবিজ্ঞানে বিশেষ অবদানের জন্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। তাঁর রচিত কিশোরসাহিত্য ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত আব্বুকে মনে পড়ে জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে ২০০৩ সালে।
জীবনের শেষার্ধে অকুতোভয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা, সামরিক শাসনের বিরোধিতা, নারীবাদী বক্তব্য এবং একই সঙ্গে নিঃসংকোচ যৌনবাদিতার জন্যে তিনি ব্যাপক পাঠকগোষ্ঠির দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত অভীষ্ট তাঁর সাহিত্যকে প্রবলভাবে প্রভাবান্বিত করেছিল। লেখার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তীব্র আক্রমণের কারণে ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হত্যা প্রচেষ্টার শিকার হন।
তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলো হলো- জ্বলো চিতাবাঘ, সব কিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে, যতোই গভীরে যাই মধু যতোই ওপরে যাই নীল, আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে অন্যতম। তার প্রকাশিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে রয়েছে-ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইল, সব কিছু ভেঙে পড়ে, যাদুকরের মৃত্যু; শুভব্রত, তার সম্পর্কিত সুসমাচার অন্যতম। প্রবন্ধ ও গবেষণা- রবীন্দ্র প্রবন্ধ : রাষ্ট্র ও সমাজ চিন্তা, শামসুর রাহমান :নিঃসঙ্গ শেরপা, বাংলা ভাষার শত্রুমিত্র, কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু, বাক্যতত্ত্ব, তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান, শিল্পকলার বিমানবিকীকরণ ও অন্যান্য প্রবন্ধ, ভাষা-আন্দোলন : সাহিত্যিক পটভূমি, নারী, নিবিড় নীলিমা, মাতাল তরণী, সীমাবদ্ধতার সূত্র, আধার ও আধেয়, দ্বিতীয় লিঙ্গ।
এছাড়া বহু শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনা করেছেন তিনি। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, অগ্রণী শিশু-সাহিত্য পুরস্কার ও মার্কেন্টাইল ব্যাংক পুরস্কার। ২০১২ সালে পান মরণোত্তর একুশে পদক।
২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে হুমায়ুন আজাদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়। একই বছর ১১ আগস্ট জার্মানির মিউনিখ শহরে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পরবর্তী সময়ে জমিয়াতুল মুজাহেদিনের জঙ্গিরা এ হামলার কথা স্বীকার করে।