মুন্সিগঞ্জ, ১১ মে ২০২৫, মামুনুর রশীদ খোকা (আমার বিক্রমপুর)
দক্ষিণবঙ্গের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার মুন্সিগঞ্জের ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে দুর্ঘটনার হটস্পটে পরিণত হয়েছে। ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা। ঝরছে তাজা প্রাণ। এক্সপ্রেসওয়েতে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে প্রাণহানির সংখ্যা।
গত ১ মাস ১০ দিনের ব্যবধানে ২৩টি দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২ জন যাত্রী। আহত হন অন্তত ৪০ যাত্রী। এ অবস্থায় এক্সপ্রেসওয়ের ৩০ কিলোমিটার এলাকা পথচারী ও যাত্রীদের সামনে এখন মৃত্যুকূপ হয়ে উঠেছে।
ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার পদ্মা সেতু উত্তর টোল প্লাজা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের সর্বত্রই দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা হিসেবে দেখছে হাইওয়ে পুলিশ। তবে দুর্ঘটনার হটস্পট হচ্ছে জেলার সিরাজদিখান উপজেলার নিমতলা ও কুচিয়ামোড়া এবং শ্রীনগর উপজেলার ষোলঘর, হাসাড়া ও দোগাছি এলাকা। সাম্প্রতিক সময়ে ওই এলাকাগুলোতেই দুর্ঘটনার চিত্র পাওয়া গেছে।
এদিকে অদক্ষ চালকের হাতে যানবাহন চলাচলকে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে দেখছে হাইওয়ে পুলিশ। আর অদক্ষ চালকদের যানবাহন চলাচলে থাকছে না কোনো নিয়ন্ত্রণ। আবার বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানোকে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে। এছাড়া নির্ধারিত গতিতে যানবাহন চলাচলের নির্দেশনা মানছেন না চালকরা। আবার ঝুঁকিপূর্ণ ওভারটেকিং দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে। একই সঙ্গে দ্রুত গতিতে যানবাহন চালাতে গিয়ে সামনে থাকা যানবাহনকে যেন চোখেই দেখছেন না চালকরা। এতে পেছন থেকে যানবাহনকে ধাক্কা দেওয়ার ঘটনায় প্রাণহানি বাড়ছে এক্সপ্রেসওয়েতে।
হাসাড়া হাইওয়ে পুলিশের সূত্র মতে, সর্বশেষ গতকাল শনিবার সকালে জেলার শ্রীনগর উপজেলার কামারখোলা এলাকায় ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দেয় একটি প্রাইভেট কার। এ দুর্ঘটনায় অন্তত দুজনকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। গত বৃহস্পতিবার জেলার সিরাজদিখান উপজেলার নিমতলা এলাকার এক্সপ্রেসওয়েতে অ্যাম্বুলেন্সের পেছনে যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় একই পরিবারের চারজনসহ নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় পাঁচ।
প্রসব বেদনা উঠলে ওইদিন মাদারীপুর সদর উপজেলার দুধখালী গ্রামের অন্তঃসত্ত্বা নারী রোজিনা বেগমকে (৩০) নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকার গ্রিণরোডের একটি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন পরিবারের ১০ সদস্য। দুপুর ১টার দিকে চাকা পাংচার হলে অ্যাম্বুলেন্সটি দাঁড়িয়ে ছিল নিমতলা এলাকার এক্সপ্রেসওয়েতে।
এ সময় ঢাকামুখী গোল্ডেন লাইন পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস পেছন থেকে অ্যাম্বুলেন্সকে ধাক্কা দিলে দুর্ঘটনাস্থলেই মারা যান অন্তঃসত্ত্বা নারীর শাশুড়ি শাহেদা বেগম (৬১)। গুরুতর আহত অবস্থায় মারা গেছেন ওই নারীর শ্বশুর আ. সামাদ ফকির (৭০), স্বামী হাফেজ বিল্লাল হোসেন ফকির (৪০), ননদ আফসানা আক্তার (২৭) ও অ্যাম্বুলেন্স চালক মাহবুব সরদার (৪০)। তবে প্রাণে বেঁচে গেছেন অন্তঃসত্ত্বা নারী। পরে ওইদিন বিকেলেই ঢাকার ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ছেলে সন্তান জন্ম দেন রোজিনা বেগম। এ ঘটনায় ওইদিন বিকালে ঢামেকের আশপাশ থেকে হাইওয়ে পুলিশ ঘাতক বাসের সুপারভাইজার কল্যাণ বিশ্বাস (২৩) ও হেলপার সাইফুল ইসলাম শান্তকে (২৬) গ্রেপ্তার করে।
গত ১ মে রাত সাড়ে ৯টার দিকে জেলার শ্রীনগর উপজেলার ওমপাড়া এলাকার এক্সপ্রেসওয়েতে মাওয়াগামী প্রাইভেট কারের ধাক্কায় অজ্ঞাতপরিচয় এক যুবক নিহত হন। অন্যদিকে, গত ২৯ এপ্রিল একই উপজেলার ষোলঘর এলাকায় দ্রুতগতির যাত্রীবাহী বাসের ধাক্কায় অজ্ঞাতপরিচয় ৭৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ মারা যান। ২৬ এপ্রিল ওই উপজেলার হাসাড়া এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় মো. আলিমুল নামে এক আরোহী নিহত হন। আগের দিন ২৫ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে জেলার সিরাজদিখান উপজেলার নিমতলা কলাবাগান এলাকায় বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রেলিংয়ের সঙ্গে ধাক্কায় চালক ইউসুফ খান (৫৪) ঘটনাস্থলেই মারা যান।
গত ১৭ এপ্রিল রাত ৮টার দিকে ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে ৬০ জন যাত্রীবোঝাই করে বরিশালের উদ্দেশে যাত্রা করে বরিশাল এক্সপ্রেস বাসটি। শ্রীনগর উপজেলার সমষপুর এলাকায় কাভার্ড ভ্যানের সঙ্গে সংঘর্ষে বাসটির ছাদ উড়ে যায়। এতে অন্তত পাঁচ যাত্রী আহত হন। ছাদ উড়ে গেলেও বাস না থামিয়ে ছাদবিহীন অবস্থায় অন্তত পাঁচ কিলোমিটার পথ চালিয়ে নিয়ে যান চালক। পরে যাত্রীদের চিৎকারে গাড়ি থামিয়ে পালিয়ে যান চালক। গত ৬ মে রাত ৯টার দিকে জেলার সিরাজদিখান উপজেলার কুচিয়ামোড়া এলাকার অদূরে ধলেশ্বরী টোল প্লাজা থেকে সেই বাসের চালক মো. শহীদুল শেখকে (৩০) গ্রেপ্তার করেন র্যাব সদস্যরা।
হাসাড়া হাইওয়ে থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী বলেন, রাজধানী ঢাকার কেরাণীগঞ্জের পোস্তগোলা থেকে শুরু হয়েছে এক্সপ্রেসওয়ে। সেখান থেকে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মাওয়া পদ্মা সেতু পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য ৩০ কিলোমিটার। আর ওই এক্সপ্রেসওয়েতে উঠলেই যানবাহনগুলো দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করে। বিশেষ করে মোটরসাইকেল বেপরোয়া গতিতে ছুটতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে প্রায়শই।