১০ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
সোমবার | রাত ১০:১৫
অবাক বিশ্ব তাকিয়ে রয়, তবু মাথা নোয়াবার নয়
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ২৫ জুন, ২০২২, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার দুর্মর কবিতায় বলেছিলেন— হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ। কেঁপে কেঁপে উঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে, সে কোলাহলের রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ। জলে ও মাটিতে ভাঙ্গনের বেগ আসে। হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন, জন্ম নিয়েছে সচেতনতার দান, গত আকালের মৃত্যুকে মুছে আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ। “হয় দান নয় প্রাণ” এ শব্দে সারা দেশ দিশাহারা, একবার মরে ভুলে গেছে আজ, মৃত্যুর ভয় তারা। সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়: জ্বলে পুড়ে—মরে ছারখার। তবু মাথা নোয়াবার নয়।

বাংলাদেশ আজ বিশ্ব জয় করেছে। বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রতীক পদ্মা সেতু আজ উদ্বোধন হতে চলেছে। বাংলাদেশকে বিশ্ব আজ থেকে পদ্মা সেতুর দেশ হিসেবে চিনবে। পদ্মা সেতু বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে পৌছাবে।

স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিন আজ। পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ—পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোতে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে। বাংলাদেশের ২১ টি জেলা যুক্ত হবে রাজধানী ঢাকার সাথে।

প্রায় ৪৪ হাজার বর্গ কিলোমিটার অঞ্চলের মানুষ পদ্মা সেতু দ্বারা সরাসরি উপকৃত হবে। যা পুরো বাংলাদেশের ২৯ শতাংশ।

নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানানো নিয়ে একসময় নানা বিরোধীতা করেছিলেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবি, অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের ব্যক্তিত্বরা।

তাদের উস্কানিতে বিশ্ব মোড়লরাও বিরোধীতা করেছিলেন পদ্মা সেতু নির্মান প্রকল্পে। সেসব উপেক্ষা করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাহস, সক্ষমতা আর আত্মবিশ্বাস নিয়ে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার মেগা প্রকল্প নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

এরপর খরস্রোতা পদ্মার বুকে শুরু হলো সেতু নির্মাণের কাজ। আজ সেই সেতুর উদ্বোধন। কাল সকাল থেকে চলবে গাড়ি।

পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. এমাজউদ্দীন আহমদ একসময় বলেছিলেন, “…নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার বিষয়টি হাস্যকর ও অবাস্তব ব্যাপার” (সূত্র: ‘পদ্মা সেতু: নতুন সরকারের অপেক্ষা’, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ১৩ জুলাই ২০১২)।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছিলেন,“নিজস্ব অর্থায়নে সরকার পদ্মা সেতু করার যে পরিকল্পনা করছে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তবে সরকার ইচ্ছা করলে পদ্মা সেতু প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে পারবে, কিন্তু শেষ করতে পারবে না” (সূত্র: ‘পদ্মা সেতু: নতুন সরকারের অপেক্ষা’, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ১৩ জুলাই ২০১২)।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন, “শুরু করতে পারলেও শেষ করার কোনো গ্যারান্টি থাকবে না” (সূত্র: ‘পদ্মা সেতু: নতুন সরকারের অপেক্ষা’, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ১৩ জুলাই ২০১২)।

কবি এবং বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ১২ তম চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ বলেছিলেন, “…তাহলে পদ্মা সেতু তো হবেই না, দেশ—বিদেশে সবাই বিশ্বাস করবে অভিযোগ যথার্থ এবং এর পরিণতি হবে বর্তমানে ক্ষমতাসীনদের জন্য অভাবনীয়” (সূত্র: ‘পদ্মা সেতু: উইন উইন নাকি লস লস?’, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই), ৩ অক্টোবর, ২০১২)।

সাংবাদিক ও বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক উপ প্রধান সিরাজুর রহমান বলেছিলেন, নিজস্ব সম্পদ থেকে পদ্মা সেতু তৈরির কথাবার্তা আকাশ—কুসুম কল্পনামাত্র” (সূত্র: স্বপ্নের কুসুম দিয়ে মহাকাশে সেতু তৈরি করবেন প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১২ জুলাই ২০১২)।

আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শাহ্দীন মালিক বলেছিলেন, পদ্মা সেতু দেশি অর্থায়নে হবে না। সম্ভব নয়” (সূত্র: ‘বীরদর্পে ভেঁা—দৌড়’, প্রথম আলো, ১৫ আগস্ট ২০১২)।

লেখক ও বুদ্ধিজীবি বদরুদ্দীন উমর বলেছিলেন, “…নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ কোন ব্যাপারই নয় বলে প্রধানমন্ত্রী যে আস্ফালন করেছিলেন সেটা যে কত হাস্যকর এবং অবাস্তব ছিল, এ নিয়ে এখন আর কারও দ্বিমত থাকার উপায় নেই” (সূত্র: ‘সব শর্ত পূরণের পর বিশ্বব্যাংক ফিরে এলো’, দৈনিক যুগান্তর, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১২)।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বাতিল করায় পদ্মা সেতু না হওয়ার জন্য সরকার, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর পরিবার দায়ী” (সূত্র: ‘এ সরকারের আমলে আর পদ্মা সেতু হবে না: খালেদা’, দৈনিক মানবজমিন, ৩০ জুন ২০১২)।

২২ মিটার প্রশস্তের ৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের দ্বিতল এই সেতুর ডিজাইন করেছে বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠান মনসেল। যার বর্তমান নাম “এইকম”। পদ্মা সেতু নির্মাণে ১৫০ মিটারের ৪১ টি স্প্যান বসাতে হয়েছে।

পদ্মা নদীতে প্রতি সেকেন্ডে ৩৮ হাজার ১২৯ ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। ঢাকা শহরে প্রতিদিন যে পরিমাণ পানি লাগে তার সমান পানি প্রতি ৭৯ সেকেন্ডে এই নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। এই নদী পানির স্রোতের সাথে করে ৬৫ ফুট বা ২১ তলা বিল্ডিংয়ের সমান নিচের মাটিকেও সরিয়ে নিতে পারে। তাই খরস্রোতা এই নদীর উপরে সেতু নির্মাণের সময় এ বিষয়টিও ভাবিয়েছে প্রকৌশলীদের। তাই এই সেতু নির্মাণের সময় একেকটি পাইল প্রায় ৪২ তলা বিল্ডিংয়ের সমান করে বসানো হয়েছে।

পদ্মা সেতুর একটি পিলারের ওজন ৫০ হাজার টন যা বহন করতে ৫ টন ওজনের ১০ হাজার ট্রাক প্রয়োজন।

পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে ১.৬ কিলোমিটার ও শরিয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ১২.৪ কিলোমিটার নদী শাসন করতে হয়েছে। এই সেতুতে লাগানো ফ্রিকশন পেন্ডুলাম বিয়ারিং বিশ্বের আর কোন সেতুতে ব্যবহার করা হয়নি।

রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও টিকে থাকবে পদ্মা সেতু।

২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়। পুরো পদ্মা সেতু প্রকল্পটি ১২ টি ভাগে পরিচালিত হয়। আর রেল সংযোগ প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ১৪ অক্টোবর।

পানি থেকে পদ্মা সেতুর উচ্চতা প্রায় ৬ তলা বিল্ডিংয়ের সমান। ৬.১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৪.৮ কিলোমিটার সেতুকে রাখা হয়েছে এই উচ্চতায়। নদীর পানি বাড়লেও নিচ দিয়ে চলাচলকারী নৌযানের যাতে কোন সমস্যা না হয়। পদ্মা সেতু পরিবর্তন করে দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা।

লাভবান হবে বন্ধু রাষ্ট্র ভারতও। এই সেতুর কারনে ভারতের অর্থনীতি লাভবান হবে। চাঙা হবে ভারতের ভোমরা বন্দর। বাংলাদেশের পণ্য ভারতে পৌছে যাবে ৫—৬ ঘন্টায়। আগে যেখানে সময় লাগতো ১০—১২ ঘন্টা। প্রতিদিন অন্তত ১ হাজার পর্যটক বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা সহ নানা কাজে ভারতের কলকাতা শহরে যান। ঢাকা—থেকে কলকাতা যেতে সময় লাগে ১০— ১২ ঘন্টা। পদ্মা সেতু চালু হলে সময় লাগবে। ৫—৬ ঘন্টা।

দেশের ভেতরে—বাইরে নানা বিরোধিতা, ষড়যন্ত্র রুখে দিয়ে বিশ্ব মোড়লদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ কাজ শেষ করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন। সাবাস, বাংলাদেশ। সাবাস, শেখ হাসিনা।

error: দুঃখিত!