মুন্সিগঞ্জ, ১৭ এপ্রিল, ২০২২, আরাফাত রায়হান সাকিব (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জের টংগিবাড়ী নাটেশ্বরে আবিস্কৃত হলো আরো একটি অষ্টকোনাকৃতির বৌদ্ধস্তূপ ও ধর্মচক্র। নবম ধাপে ৬ মাসের উৎখননে আবিস্কৃত এই নিদর্শন দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে বিরল এবং এটি প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস ও দেশের প্রত্ন ক্ষেত্রকে আরো সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি গবেষণা ও পর্যটনের ক্ষেত্রে নতুন দ্বার উন্মোচিত করবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গতকাল শনিবার দুপুর ১২টার দিকে আবিস্কৃত প্রত্নস্থাপনাটি ঘুরে দেখেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব সহ গবেষনা ও উৎখনন কাজের সংশ্লিষ্টরা। পরে এ উপলক্ষ্যে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মুন্সিগঞ্জের নাটেশ্বরে ২০১৩ সালে প্রথম আবিস্কৃত হয় ৯শ থেকে ১২শ বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির ও নগরীর ধ্বংসাবশেষ। এরপর ধাপে ধাপে উৎখননে এলাকাটির মাটির নিচ থেকে বেরিয়ে এসেছে প্রাচীন নগরীর রাস্তা, মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ, পিরামিড আকৃতির স্থাপনা সহ বহু প্রাচীন নিদর্শন।
নবম ধাপে এবার ৬ মাসের উৎখনন কাজে মাটির প্রায় ১৪ ফুট নিচ থেকে আবিষ্কৃত হলো অষ্টকোনাকৃতির স্তূপ ও ধর্মচক্র। দুষ্প্রাপ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ এই স্থাপনা বৌদ্ধ ধর্মের অষ্টাঙ্গিক মার্গকে নির্দেশ করে।
এর আগে আবিস্কৃত ৪টি সহ এ নিয়ে নাটেশ্বরে আবিস্কৃত অষ্টকোনাকৃতির স্থাপনার সংখ্যা দাড়ালো পাঁচে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সদ্য আবিষ্কৃত ৫ম স্তূপটি পূর্বের ৪টি অষ্টকোণাকৃতির স্তূপের প্রায় অনুরূপ কিন্তু পূর্বের ৩ টি স্তুপের আদি পর্যায় এবং পরবর্তী পর্যায় দু’টি ধাপেরই স্তূপ স্থাপত্য অনেকটা সম্পূর্ণ অবস্থায় এবং ১টি অত্যন্ত ক্ষতিপ্রস্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল; ফলে আদি পর্যায়ের অষ্টকোণাকৃতি স্তূপটির স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ রূপে বোঝা যায়নি। কিন্তু এবারের ৫ম অষ্টকোণাকৃতির স্তুপের আদি পর্যায়ের স্তূপের স্থাপত্যিক বৈশিষ্ট্য উন্মোচিত হয়েছে কারণ পরবর্তী পর্যায়ের স্তুপটি ছিল খুবই ক্ষতিগ্রস্ত।
৫ম স্তূপের আদি পর্যায়ের অষ্টকোণাকৃতি স্তূপের দেয়ালের গাঁথুনী এখনো অপূর্ব মসৃণ, মনে হয় যেন আধুনিক সিরামিক ইটের গাঁথুনী। দেয়ালের ইট, পরিমাপ, গাঁথুনী সেও আবার কাদা মাটির মর্টার তবুও অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় বহন করে। ৭.৪ পরিমাপের একটা বর্গাকার ভিত্তির ওপর উলম্বভাবে ইট স্থাপন করে অনেকটা গরুর গাড়ির চাকার ন্যায় ধর্মচক্র নির্মাণ করা হয়েছে। ইতোপূর্বে আবিষ্কৃত ১ম এবং ৪র্থ অষ্টকোণাকৃতির স্তূপে আদি পর্যায়ে ধর্মচক্রের আভাষ দেখা দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ের অষ্টকোণাকৃতির স্তূপ দ্বারা আবৃত থাকায় সে রহস্য উন্মোচিত হয়নি। সদ্য আবিষ্কৃত ৫ম অষ্টকোণাকৃতি স্তূপের ধর্মচক্রটিতে আটটি স্পাক রয়েছে। প্রসঙ্গত, ধর্মচক্রে সাধারণত ৪, ৬, ৮, ১০, ১২, ২৪ এমনকি ৩১টি পর্যন্ত স্পাক যুক্ত থাকে।
প্রতিটি স্পাকের সংখ্যা বৌদ্ধধর্মে প্রতীকী অর্থে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। আরো জানানো হয়, নাটেশ্বরে আবিষ্কৃত অষ্টকোণাকৃতির ৫ম স্তূপে আটটি স্পাকযুক্ত ধর্মচক্র বৌদ্ধধর্মের মূল অষ্টাঙ্গিক মার্গ দর্শনকে দ্বিগুন করে প্রতিফলিত করেছে।
বৌদ্ধধর্মে কোন একক পূজনীয় হিসেবে ধর্মচক্র প্রাচীনকাল থেকেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়। বৌদ্ধধর্মের মূল দর্শন হলো চার আর্যসত্য- ১. জীবনে দুঃখ আছে, ২. দুঃখের কারণ আছে, ৩. দুঃখের বিনাশ আছে এবং ৪. দুঃখ বিনাশের উপায়ও আছে। দুঃখ বিনাশের উপায় হলো- অষ্টাঙ্গিক মার্গ- ১. সুদৃষ্টি ২. সৎ সংকল্প, ৩. সৎ বাক্য, ৪. সৎ কর্ম, ৫. সঞ্জীবিকা, ৬.সৎ চিন্তা, ৭. সঠিক চৈতন্য এবং ৮. সৎধ্যান অনুশীলন। বৌদ্ধধর্মে অষ্টমঙ্গল হিসেবেও ৮টি প্রতীক কল্পনা করা হয় যার মধ্যে ধর্মচক্র অন্যতম । ধর্মচক্রকে সূর্য রশ্মির সঙ্গেও তুলনা করা হয়।
সাধারণত ধর্মচক্র স্তূপের তোরণ বা অশোক স্তম্ভের শীর্ষে শোভাবর্ধন করে থাকে। কিন্তু অন্ধপ্রদেশের অমরাবতি এবং নাগার্জুনকোভা স্তূপের বেদিতে নাটেশ্বরের আবিষ্কৃত ধর্মচক্রের অনেকটা অনুরূপ ধর্মচক্র আবিষ্কৃত হয়েছিল। নিরেট ভিত্তিভূমিতে আট স্পাক বিশিষ্ট ধর্মচক্রের ওপর হাজার বছরের প্রাচীন হলঘর/মণ্ডপসহ অষ্টকোণাকৃতির উপস্থিতি এর আগে বাংলাদেশ কেন ভারতবর্ষের অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি।
নাটেশ্বর দেউলে আবিষ্কৃত কেন্দ্রীয় অষ্টকোণাকৃতি মন্দির, বর্গাকৃতির স্তূপ, একাধিক অষ্টকোণাকৃতি স্তূপ, স্তূপের স্মারক কক্ষে বর্গাকার, অষ্টকোণা ও গোলাকার (শুন্য) প্রতীকী স্থাপত্য, আট স্পাকযুক্ত ধর্মচক্র সবই বৌদ্ধ ধর্মের মূল মন্ত্রের প্রতীকী রূপ। নাটেশ্বর দেউলে প্রায় সকল স্থাপত্যে প্রতীকীরূপে বৌদ্ধ ধর্মের মূল দর্শন ফুটিয়ে তোলার এমন নজির আর কোথাও নেই।
পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্করের (৯৮০-১০৫৩ খ্রিষ্টাব্দ) জন্মভূমি বিক্রমপুরের নাটেশ্বর দেউলে সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত প্রতীকী স্থাপত্য সমূহ থেকে মনে হয় যে, প্রায় ১১০০ বছর আগে বিক্রমপুরে বৌদ্ধ ধর্ম এবং দর্শনের একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী স্কুল বিকাশ লাভ করেছিল। বৌদ্ধ দর্শন অনুযায়ী এ স্থানের মাটির নিচে আরো ৩টি একই ধরনের স্থাপনা থাকতে পারে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
১০একর টিবিতে উৎখনন কাজ শেষ হলে আর্কিওলজিক্যাল পার্ক নির্মানের পরিকল্পনা রয়েছে। যা পর্যটনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখবে।
প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র এতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এই নাটেশ্বরে বৌদ্ধ ধর্ম সংস্কৃতির চর্চা আমাদের দাবি ৭শ ৮শ থেকে হাজার ১২শ শতকে আমাদের বাংলাদেশে নয় ভারতবর্ষের মধ্যে সবচে বিকশিত রূপ বিক্রমপুরে ঘটেছে অতীশ দ্বীপঙ্করের নেতৃত্বে। প্রথম অষ্টকোনাকৃতির স্তূপ পেয়েছি ২০১৩-১৪ সালের খননে, এরপর পর্যায়ক্রময়ে ২য়, ৩য় ও ৪র্থ টি পেয়েছি। আমাদের যে গবেষণা ও চিন্তা চেতনা সেখান থেকে মনে হচ্ছে পুরো এলাকায় আটটি অষ্টকোনাকৃতির স্তূপ আছে। ৫নং স্তূপটির পর আমরা মনে করছি আরও ৮টি স্তুূপ আছে। ৮টি পেলে নাটেশ্বর যে বৌদ্ধ ধর্ম চর্চার একটি উন্নত শিখরে অবস্থান করছিলো তার এটিই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের সভাপতি নূহ-উল-আলম লেনিন জানান, গত ১০বছর যাবত আমরা খনন কাজ পরিচালনা করছি। আমরা বৌদ্ধ মন্দির নগরী আবিস্কার করেছি। ৮ম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর বিভিন্ন সময় নির্মিত হয়েছে। এবারে সর্বশেষ আমরা একটি অষ্টোকোনাকৃতির স্তূপ ধর্ম চক্র সহ আবিস্কার করেছি। এই ধরনের নিদর্শন বাংলাদেশে আর কোথাও নেই। সেই দিক থেকে এটা এক অবিস্মরণীয় আবিস্কার। খনন কাজ অব্যাহত থাকবে আগামী ২বছর। খনন কাজ শেষ হলে চীনাদের সহযোগিতায় এখানে যেনো পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠে এবং আবিস্কৃত নিদর্শন গুলো যেনো সংরক্ষিত হয় সেজন্যে একটি আর্কিওলজিক্যাল পার্ক করার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। তখন সকলের কাছে এটা শিক্ষণীয় ও দর্শনীয় কেন্দ্র হিসাবে গড়ে উঠবে। এমনকি আমি মনে করি এটা বৌদ্ধদের কাছে দ্বিতীয় তীর্থ স্থান ক্ষেত্র হিসাবে গড়ে উঠবে।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সচিব মোঃ আবুল মনসুর জানান, খনন কাজে নতুন আবিস্কৃত স্থাপনা দেখে আমি খুশি। এর মূল্য অনেক। বাকি ৩টি আবিস্কৃত হওয়ার পর একটি ফরমেটে আসবে একটি ম্যাপে আসবে। তারা যে খনন করেছে আবিস্কার করেছে এটি অত্যন্ত আশাপ্রদ। এর মাধ্যমে পর্যটন তথা আমাদের বিক্রমপুর যে প্রাচীন সভ্যতার অংশ তা সারা বিশ্বে প্রমানিত হবে। অতীশ দীপঙ্কর কে বলা হয় বৌদ্ধ ধর্মের দ্বিতীয় পুরুষ। সরকারি প্রচেষ্টায় এই স্থাপনা তার সময়ের তা প্রমান করা যায় তবে বিক্রমপুর পর্যটন তথা ধর্মীয় পর্যটনের জন্য গুরুত্ব বহন করবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে নাটেশ্বরে আবিস্কৃত হওয়া প্রত্ননিদর্শন ৭ম থেকে ১২শতকের বৌদ্ধ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত মন্দির ও নগরের ধ্বংসাবশেষ। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গত নভেম্বরে নবম ধাপের খননকাজ শুরু করে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা কেন্দ্র ঐতিহ্য অন্বেষণ।