মুন্সিগঞ্জ, ১৭ আগস্ট ২০২৪, ফয়সাল হোসেন (আমার বিক্রমপুর)
তিনজনের সংসার। এক দিন কাজে না গেলে ঘরে চুলা জ্বলে না, জোটে না মেয়ের পড়াশোনার খরচ। সংসারী মানুষটি ৪ আগস্ট সকাল ৮টার দিকে ঘর থেকে কাজের জন্য বের হয়েছিলেন। কথা ছিল কাজ শেষে দুপুরে বাড়িতে ফিরবেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিবারকে দেওয়া কথা তিনি রাখতে পারেননি। পরদিন বাড়িতে ফিরেছেন লাশ হয়ে।
গত ৪ আগস্ট মুন্সিগঞ্জ শহরের সুপারমার্কেট এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গুলিতে নিহত হন রিয়াজুল ফরাজী (৩৮) নামের ওই ব্যক্তি। তিনি মুন্সিগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুর এলাকার বাসিন্দা, পেশায় শ্রমিক ছিলেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে রিয়াজুল ফরাজীর স্ত্রী রুমা আক্তার বলেন, ওই দিন আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের গোলাগুলির মধ্যে পড়ে প্রাণ হারান রিয়াজুল। তিনি বলেন, ‘খুব অল্প বয়সে আমাগো বিয়া হইছিল। আমি নিজে হার্টের রোগী। একটা মাইয়া ধারদেনা কইরা বিয়া দিছি। আরেক মেয়ে (খুকু আক্তার) দশম শ্রেণিতে পড়ে। আমার ওষুধের খরচ, মেয়ের পড়ার খরচ, সংসারের খরচ চালাইতে যখন যে কাজ পাইত, তা–ই করত (রিয়াজুল)। কখনো অলস বইসা থাকত না।’
একটু থেমে আক্ষেপের সুরে রুমা আবার বলতে শুরু করেন, ‘সেদিন (৪ আগস্ট) বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় (রিয়াজুল) বলেছিল, ‘‘চিন্তা করিস না, আমাগো কষ্ট বেশি দিন থাকব না। আমি কাজে গিয়া টাকা জমামু। তর ওপারেশন করামু। তুই সুস্থ হইয়া যাবি। মাইয়ারে মেট্রিক পাস করাইয়া ভালা পোলা দেইখা বিয়া দিমু…।’’ কথাগুলো পুরোপুরি শেষ করতে পারলেন না রুমা। বারবার কান্না চেপে বসছিল গলায়। একপর্যায়ে সশব্দে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
বিলাপ করতে করতেই নিহত স্বামীকে উদ্দেশ করে রুমা বলছিলেন, ‘দেশের অবস্থা ভালা ছিল না। তোমারে (রিয়াজুল) কাজে যাইতে মানা করছিলাম। তুমি বলছিলা, তোমার লগে কারও কোনো শত্রুতা নাই। কেউ তোমার কোনো ক্ষতি করব না। জলদি কাজের থেইকা ফিরা আইবা। তুমি তো আর ফিরা আইলানা। আমরা এহন কই যামু, কী করমু, কে আমাগো দেখব?’
ঘটনার দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও এখনো যেন শোক কাটছে না রিয়াজুলের পরিবারের। প্রতিদিন বাড়িতে মানুষজন ও আত্মীয়স্বজন আসছেন। গতকাল শুক্রবারও রুমা এবং তাঁর মেয়েকে সান্ত্বনা দিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু কোনো কিছুই তাঁদের শান্ত করতে পারছে না। বাবার স্মৃতি মনে করতেই কেঁদে উঠছিল খুকু আক্তার।
খুকুর সঙ্গে কথা হলে সে জানায়, ‘আমার বাবা খেটে খাওয়া মানুষ ছিলেন। পাইপ ফিটিংয়ের কাজ করতেন। কাজ না থাকলে অটোরিকশা চালাতেন। আমি আমার বাবার হত্যার বিচার চাই।’
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ৪ আগস্ট রোববার সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীরা। সকাল পৌনে ১০টার দিকে তাঁরা শহরের সুপারমার্কেট এলাকায় গেলে পুলিশের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা শিক্ষার্থীদের পেটাতে শুরু করেন। আন্দোলনকারীরা শহরের হাটলক্ষীগঞ্জ এলাকার সড়ক দিয়ে সুপারমার্কেট এলাকায় আসতে চাইলে মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, তার পুত্র ফয়সাল বিপ্লব (সাবেক সংসদ সদস্য) ও বিপ্লবের স্ত্রী চৌধুরী ফাহরিয়া আফরিন ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান আনিস উজ্জামানের নির্দেশে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফয়সাল মৃধা, শহর ছাত্রলীগের সভাপতি নসিবুল ইসলাম নোবেল, সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাত হোসাইন সাগর, সরকারি হরগঙ্গা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নিবির আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন, সদর উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুরুজ মিয়া, সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান লাকুম, চরকেওয়ার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মোতা গাজীসহ অসংখ্য পদধারী নেতা ও সাধারণ কর্মী-অনুসারী পিস্তল-বন্দুক, ছুরি-ককটেল নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালান। অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ছররা গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতে দেড় শতাধিক আন্দোলনকারী গুলিবিদ্ধ হন। সেই সঙ্গে রিয়াজুল ফরাজীসহ তিনজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান।
পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ভয়ে ভাইয়ের লাশটাও দেখতে যেতে পারেননি নিহত রিয়াজুলের মেজ ভাই আজিজুল ফরাজী। সেদিনের ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘ভাই তো মারাই গেছে। দেশের যে পরিস্থিতি ছিল, তাতে আমাদেরও হয়রানি করা হচ্ছিল। ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগের লোকজন (সাবেক এমপি বিপ্লবসহ অন্যরা) পুলিশ নিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে শাসিয়ে গিয়েছিল। পরদিন ৫ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালান, সেদিন ভাইয়ের লাশটা মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের মর্গ থেকে বাড়িতে এনেছিলাম।’
রিয়াজুলের বড় ভাই জিয়াউর রহমান ফরাজী বলেন, ‘আমার ভাই তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল। সে মারা যাওয়াতে পুরো পরিবারটি এখন অসহায় হয়ে পড়েছে। আমরাও দিনমজুর মানুষ, দিন আনি দিন খাই। আমরা তো আমাদের পেটই ঠিকমতো চালাতে পারি না। এখন ওদের কী করে দেখব? আমরা চাই, রিয়াজুল হত্যার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিচার হোক এবং বর্তমান সরকার যেন এই পরিবারটির পাশে এসে দাঁড়ায়।’
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফিফা খান বলেন, হতাহত ব্যক্তিদের সহযোগিতার ব্যাপারে এখনো সরকারি কোনো নির্দেশনা আসেনি। সরকারের পক্ষ থেকে বরাদ্দ পেলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট পরিবারকে সহযোগিতা করা হবে।
সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থান্দার খায়রুল হাসান জানান, নিহতের ঘটনায় আজকালের মধ্যে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের হবে।