মুন্সিগঞ্জ, ২৮ মার্চ ২০২৫, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
গত ৪ আগস্ট মুন্সিগঞ্জ শহরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন ভ্যানচালক মুক্তার হোসেন (৪৪)। সেদিন দুপুরের দিকে বাগমামুদালিপাড়া এলাকায় কৃষি ব্যাংকের সামনে পুলিশের মুহুর্মুহু রাবার বুলেটের মুখে পড়েন তিনি। একই সময় হামলা করতে আসা এক অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ (নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন) নেতাকে ধরে ফেললে তার পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে পালিয়ে যায় ওই সন্ত্রাসী।
মাথা, বাম হাত, বাম পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশে গুলিবিদ্ধ হন এই ‘জুলাই যোদ্ধা’। পরে নিজের উপার্জনের একমাত্র সম্বল ভ্যানগাড়িটি বিক্রি করে সেই অর্থ ব্যায় করেন চিকিৎসায়। শরীর থেকে বের হয় ৬৫টি রাবার বুলেট ও একটি ম্যাগাজিনের গুলি। কিন্তু মুক্তার হোসেনের শরীরের অন্ডকোষের পাশে থাকা রাবার বুলেটটি অপারেশনের অভাবে এখনো বের করা সম্ভব হয়নি। শরীরে সেই গুলি নিয়ে সাহায্যের আশায় মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন তিনি।
অন্ডকোষের পাশে গুলি আটকে থাকায় স্বাভাবিক চলাফেরাও ব্যাহত হচ্ছে তার। বর্তমানে স্ত্রী আর দুই সন্তান নিয়ে মানবেতর দিন কাটছে এই জুলাই যোদ্ধার।
মুক্তার হোসেন জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এ আহতের গেজেটেড তালিকায় নাম আসলেও এখনো কোন অর্থ সহযোগিতা পাননি তিনি। এছাড়া আলাদা করে জেলা প্রশাসন ও সিভিল সার্জন কার্যালয়ে চিকিৎসা সহায়তার আবেদন জানালেও সেখান থেকেও এখন পর্যন্ত সাড়া মেলেনি।
মুক্তার হোসেন বলেন, ‘গত বছরের আগস্টের আগে সুপারমার্কেট এলাকার একটি ইলেক্ট্রনিকস প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক কাজ করতাম। সেখানে মানুষের কেনা টিভি-ফ্রিজ ইত্যাদি ভ্যানে করে বাসায় দিয়ে এসে দৈনিক এক থেকে দেড় হাজার টাকা আয় হতো। পাশাপাশি বাড়তি আয়ের আশায় কিস্তিতে টাকা তুলে একটি অটোরিকশা কিনে ভাড়ায় দিয়েছিলাম। সেটি থেকে আয় হতো দৈনিক ৩০০ টাকা। কিন্তু ৪ আগস্ট সুপারমার্কেটে ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে আহত হওয়ার সেই ভ্যান ও অটোরিকশাটি বিক্রি করে চিকিৎসা করতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারি/বেসরকারি কোন সহযোগিতা পাইনি।’
মুক্তার বলেন, ‘যারা এখন সমন্বয়ক তাদের কাছেও গেছি। বিএনপির যারা বড় নেতা তাদের কাছেও গেছি। কেউই আগাইয়া আসে নাই। এখন আফসোস হয় কাগো জন্য কি করলাম।’
ঘটনার বর্ণনায় মুক্তার হোসেন বলেন, ‘৪ তারিখ সকালে প্রতিদিনকার মত সুপারমার্কেট এলাকায় কাজে আসছিলাম। সকাল ১০টার দিকে দেখলাম আন্দোলনকারীদের উপর গুলি শুরু হলো। এই দৃশ্য দেখে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলাম না। ছুটে গেলাম তাদের পাশে। ওদের সাথে অবস্থান নিয়ে হামলা প্রতিরোধ করতে করতে দুপুর হয়ে গেল। দেখলাম যে সময় যত গড়াচ্ছে বিভিন্ন জায়গা থেকে ককটেল ও অস্ত্র নিয়ে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের লোকজন আরও জড়ো হচ্ছে। এক গ্রুপ হামলা করতে করতে হাপিয়ে গেলে আবার আরেক গ্রুপ এসে হাজির হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘দুপুর আড়াইটার দিকে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ভবনের সামনে এক ছাত্রলীগ নেতা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের উপর হামলা করতে এলে আমি তাকে ঝাপটে ধরি। এমন সময় সে আমার পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে দৌড়ে পালিয়ে যায়।’
‘একইসময় পুলিশ সড়কের বিপরীত পাশে জেলা বিএনপির কার্যালয়ের সামনে থেকে মুহুর্মুহু রাবার বুলেট ছুড়ে মারে। এসময় আমার শরীরে ৬০-৬৫টি রাবার বুলেট লাগে। প্রথমে কিছুক্ষণ আমি হাটার চেষ্টা করলেও পরমুহুর্তে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সড়কের উপর পরে যাই। এসময় কয়েকজন অল্পবয়সী ছেলে ও মেয়ে আমাকে ধরাধরি করে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর দেখি আরও বিভৎস চিত্র। আহত কাউকে হাসপাতালে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের লোকজন উল্টো আহতদের পিটাচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখে শিক্ষার্থীরা আমাকে আমার বাসায় নিয়ে যায়। পরে স্থানীয় একটি ক্লিনিকের দুইজন নার্সকে ডেকে নিয়ে এসে প্রায় ৬৫টি ছররা গুলি বের করা হয়। একইসময় আমার বা পায়ে লাগা ছাত্রলীগের গুলিটিও বের করা হয়। তবে অণ্ডকোষের পাশে ছররা গুলিটি অপারেশন ছাড়া বের করা সম্ভব নয় বলে নার্সরা জানান।’
তিনি বলেন, ‘আমি ৬-৭মাস ধরে অপারেশনের জন্য মানুষের হাত-পায়ে ধরেছি। কেউই আমার চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসেনি।’
মুন্সিগঞ্জ সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এম সাইফুল আলম বলেন, ‘গত ৪ আগস্ট জেলা শহরে আন্দোলনে ৩ জন শহীদ ও দেড় শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এসব ঘটনায় এখন পর্যন্ত থানায় ৬টি মামলা হয়েছে। মুক্তার হোসেনের যে ঘটনা সে ঘটনায় তিনি থানায় অভিযোগ করলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
জেলা সিভিল সার্জন ডা. মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সরকারি আহতের তালিকায় জেলায় এ ক্যাটেগরিতে ১৩ জন, বি ক্যাটেগরিতে ২৩ জন ও সি ক্যাটেগরিতে স্থান পেয়েছেন ১৪৪ জন। তবে এর মধ্যে এখন পর্যন্ত অর্থ সহায়তা পেয়েছেন মাত্র ৩ জন। মুক্তার হোসেন চিকিৎসার জন্য অর্থ সহায়তা চেয়ে আবেদন করলে আমরা নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবো। তিনি যাতে দ্রুত স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন সেলক্ষ্যে তাকে ডাক্তারি পরামর্শ দেয়ার ব্যবস্থা করা হবে।’