কায়সার হামিদ
‘নিষিদ্ধ’ হওয়ার পরও মুন্সিগঞ্জ জেলায় কোনোভাবেই বন্ধ করা হচ্ছে না কারেন্ট জাল (মনোফিলামেন্ট) উৎপাদন। লাগামহীন ঘোড়ার মতো ছুটে চলছে কারেন্ট জাল উৎপাদনের কাজ। উল্টো প্রভাবশালীদের সহযোগিতায় অধিক মুনাফার লোভে দেদারছে কারেন্ট জাল মেশিনের আমদানি করা হচ্ছে।
গত ১২ সেপ্টেম্বর মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসন ও জাল ব্যবসায়ীরা সম্পূর্ণ স্থায়ীভাবে কারেন্ট জাল উৎপাদন, পরিবহন, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ বা ব্যবহার বন্ধের সিদ্বান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্ত যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হওয়া বাজারে কারেন্ট জালের সরবরাহ বন্ধ হয়নি।
এ ঘোষণার পরেই পদ্মা ও মেঘনা নদীতে ২২ দিনের অভিযানে প্রায় ৮৭ লক্ষ মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়। এরপরও খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রশাসনকে ম্যানেজ করার মাধ্যমে জাল উৎপাদনে বহাল রাখছেন ব্যবসায়ীরা।
মুন্সিগঞ্জ জেলার মৎস্য অধিদফতরের তথ্যানুসারে, মুন্সিগঞ্জে ছোট-বড় সব মিলিয়ে ১শ’ ৬০টি জাল কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে ৪২টি মাল্টিফিলামেন্টে। আর ২৮টি অবৈধ কারেন্ট জাল করখানা হিসেবে বন্ধ রয়েছে। এখনও প্রায় ৮০টির মতো অবৈধ কারেন্ট জাল কারখানা চালু রয়েছে।
জেলার কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদফতর থেকে লাইসেন্স নিয়ে জেলা সদরেই গড়ে উঠেছে প্রায় ৫০টি জাল কারখানা। এর মধ্যে মাল্টিফিলামেন্ট-মনোফিলামেন্ট উভয় ধরণের কারখানা রয়েছে।
স্থানীয় কারেন্ট জাল ব্যবসায়ীরা জানায়, সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নে কারেন্ট জাল কারখানা সবচেয়ে বেশি। ছয় শতাধিক কারখানার প্রায় সাড়ে ৩ হাজার মেশিনে উৎপাদন হচ্ছে কারেন্ট জাল। প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে কারখানার মালিকরা এসব জাল উৎপাদন করছেন।
মাঝে মাঝে র্যাবের অভিযানে কোনো কারখানাকে জরিমানা করা হলে কিছুদিন কারেন্ট জালের উৎপাদন বন্ধ থাকে। তবে, অভিযানে ধারাবাহিকতা বজায় না থাকায় কারখানার মালিকরা পুনরায় কারেন্ট জালের উৎপাদন শুরু করেন। অনেক সময় কিছু সরকারি কর্মকর্তারা বকশিসের লোভে আগে ভাগেই অভিযানের কথা কারখানার মালিকদের জানিয়ে দেন। এতে অভিযানের মূল উদ্দেশ্য সফল হয় না বলে জানান স্থানীয়রা।
অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং এলাকার চেয়ারম্যান-মেম্বারদের সহযোগিতায় আমদানি করা হচ্ছে কারেন্ট জাল মেশিন। স্থানীয় জন প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরা কারেন্ট জাল উৎপাদনের পাশাপশি জাল আয়রণ বাণিজ্যও গড়ে তুলেছেন। একই সঙ্গে মুক্তারপুর ফেরি ঘাট থেকে ফিরিঙ্গী বাজার এলাকায় স্থল ও নদী পথে প্রতিনিয়ত ট্রাক ও ট্রলারসহ বিভিন্ন যানবাহনে করে ঢাকার চক বাজা সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কারেন্ট জাল সরবরাহ করা হচ্ছে। নৌ-পুলিশের অভিযান না থাকায় হাটলক্ষীগঞ্জ লঞ্চ ঘাট হয়ে দক্ষিণবঙ্গেও কারেন্ট জাল চলে যাচ্ছে।
১২ নভেম্বর জেলা আইন শৃঙ্খলা, সন্ত্রাস এবং নাশকতা প্রতিরোধ কমিটির সভায় ‘নিষিদ্ধ’ কারেন্ট জাল উৎপাদনের প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস বলেছিলেন, ‘এখনো কিছু কিছু কারখানায় কারেন্ট জাল উৎপাদন অব্যাহত রয়েছে। শর্ষের ভেতরে ভূত থাকলে যা হয়। যাদের দায়িত্ব এগুলো বন্ধ করার, তারাই এই কারেন্ট জাল উৎপাদন কাজের সাথে জড়িত।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পঞ্চসার ইউনিয়নের এক জাল ব্যবসায়ী বলেন, একই মেশিনে সব ধরনের জাল বানানো যায়। তবে চাহিদা বেশি থাকায় কারেন্ট জালই বেশি উৎপাদন করা হয়।
কারেন্ট জাল উৎপাদন, পরিবহন, বাজারজাতকরণ, সংরক্ষণ বা ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকা সত্বেও আপনারা কেন কারেন্ট জাল উৎপাদন করছেন জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা একা জাল উৎপাদন করি না। আরো অনেকেই জাল উৎপাদন করে। আমাদের জাল ব্যবসায়ী সমিতির কথায় আমরা কারেন্ট জাল উৎপাদন করি। আপনার কিছু জানার দরকার হলে আমাদের জাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মহিউদ্দিন আহম্মেদ, সহ-সভাপতি মো. হাবীব চেয়ারম্যান (সাবেক), মোস্তফা চেয়ারম্যান (বর্তমান), আনোয়ার এবং হাজী মো. শফিউদ্দিনের কাছে জিজ্ঞাসা করেন গিয়ে। ওনারা এই সম্পর্কে সব বলতে পারবেন।’
জাল ব্যবসায়ীর সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্থায়ীভাবে সব কারেন্ট জাল উৎপাদন বন্ধ করা হয়েছে। কয়েকটা কারখানায় এখনো কিছু কারেন্ট জাল উৎপাদন করছে। তবে আমি তাদেরকে বলেছি কারেন্ট জাল উৎপাদন বন্ধ করতে।’
কারেন্ট জাল ব্যবসায়ীর সহ-সভাপতি মো. হাবীব চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা কারেন্ট জাল ব্যবসায়ীদের মেশিন মনোফিলামেন্ট থেকে মাল্টিফিলামেন্টে রূপান্তর করতে বলেছি।’
আপনারা কারেন্ট জাল উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত আছেন বলে শুনছি এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমার নিজের কারেন্ট জাল কারখান ছিলো। এখন তা সম্পূর্ণ বন্ধ।’
পঞ্চসার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. গোলাম মোস্তফা এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি কখনোই কারেন্ট জাল ব্যবসায়ীদের সাথে জড়িত ছিলাম না। কারেন্ট জাল বন্ধের জন্য প্রশাসন ও পৌর মেয়রের সঙ্গে কথা বলেছি।’
জেলার পরিবেশ অধিদফতরের সিনিয়র কেমিস্ট মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল-মামুন বলেন, ‘কারেন্ট জাল উৎপাদন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কাজেই এ ধরনের কারখানাগুলোকে পরিবেশের ছাড়পত্র দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। তবে সুতা বা মাল্টিফিলামেন্ট কারখানার কথা বলে কেউ যদি মনোফিলামেন্ট জাল উৎপাদন করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিব।’
মুন্সিগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. অলিউর রহমান বলেন, ‘গত ১২ সেপ্টেম্বর সভায় অবৈধ কারেন্ট জাল কারখানার মালিকরা আমাদের সাথে অঙ্গীকার করেছেন নভেম্বর মাসের মধ্যে তারা মনোফিলামেন্ট মেশিন মাল্টিফিলামেন্টে রূপান্তরিত করবে। তার পরেও তারা যদি তা না করে তাহলে আমাদের অভিযান পুনরায় অব্যাহত থাকবে।’