মুন্সিগঞ্জ, ২৯ মার্চ ২০২৩, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জ শহরের মাঠপাড়ায় পরকীয়া সম্পর্ক নিয়ে পারিবারিক কলহের জেরে শ্বাসরোধে দিনমজুর স্বামী নাজির হোসেনকে (৪৫) হত্যার দায়ে স্ত্রী নীলা বেগমকে (৪০) যাবজ্জীবন দন্ড প্রদান করেছেন আদালত।
হত্যাকান্ডের ৮ বছর পর দীর্ঘ বিচারিক কার্য শেষে গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১২ টা’র দিকে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ কাজী আব্দুল হান্নান ৩০২ ধারায় নীলা বেগমকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার রায় দেন।
মুন্সিগঞ্জ কোর্ট পুলিশের পরিদর্শক জামাল হোসেন এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। দন্ডপ্রাপ্ত নীলা বেগম মুন্সিগঞ্জ সদরের নয়াগাঁও এলাকার মৃত জয়নাল আবেদীনের মেয়ে।
মামলার এজাহার ও বাদী সূত্রে জানা যায়, ২৩ বছর আগে মুন্সিগঞ্জ শহরের মাঠপাড়া এলাকার গিয়াসউদ্দিন দেওয়ানের পুত্র নাজির হোসেনের সাথে পঞ্চসার ইউনিয়নের নয়াগাঁও এলাকার মৃত জয়নাল আবেদীনের মেয়ে নীলা বেগমের বিয়ে হয়। দাম্পত্য জীবনে তাদের এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। তারা বর্তমানে প্রাপ্তবয়স্ক।
বিয়ের পর থেকেই তাদের মধ্যে সাংসারিক বিরোধ চলছিলো। নীলা বেগম তার স্বামীকে মারধরও করতেন। হত্যাকান্ডের দুই-তিন মাস আগে নীলা বেগমের পরকীয়া সম্পর্কের কথা তার স্বামী জানতে পেরে পরিবারের অন্যান্যদের জানালে তাদের সম্মুখেই নীলা বেগম তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেন।
২০১৫ সালের ২০ জুন ঘটনার দিন তাদের মধ্যে ঝগড়া হয় এবং একপর্যায়ে নীলা বেগম তার স্বামী নাজির হোসেনকে মারধর করেন। পরে নাজির হোসেন অভিমানে দোচালা টিনের ঘরের উপরে সিলিংয়ে শুয়ে থাকেন। সেসময় রমজান মাস থাকায় প্রতিবেশীরা তারাবিহ্ নামাজ পড়তে গেলে রাত সাড়ে ৯টা’র দিকে নীলা বেগম বৈদ্যুতিক তার পেচিয়ে শ্বাসরোধ করে তার স্বামী নাজির হোসেনকে হত্যা করেন।
পরে মামলার বাদী নিহতের ছোট ভাই জাহাঙ্গীর হোসেনসহ অন্যরা তার মরদেহ ও পাশ থেকে সাড়ে ৩ ফুট লম্বা লাল রঙের বৈদ্যুতিক তার উদ্ধার করে।
পরদিন ২১ জুন এ ঘটনায় নীলা বেগমকে অভিযুক্ত করে নিহতের ছোট ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন বাদী হয়ে মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। পুলিশ ঐদিনই নীলাকে গ্রেপ্তার করে ২২ জুন মুন্সিগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রেরণ করলে আদালত তাকে জেলহাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
এরপর আদালতে দীর্ঘ ৮বছর ধরে বিচারকার্য শেষে খুনের ঘটনায় নীলা বেগমের জড়িতের প্রমাণ পাওয়ায় এবং একপর্যায়ে সে নিজেও ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তি দেয়ায় তাকে যাবজ্জীবনের রায় দেন মুন্সিগঞ্জ সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালত।
রায়ের পরে প্রতিক্রিয়ায় মামলার বাদী ও নিহতের ছোট ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমার ভাই খুবই সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আমার পাঁচ বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে নাজির হোসেন ছিলেন মেঝ। তিনি দিনমজুরের কাজ করতেন। পরকীয়ার কারণে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে নীলা বেগম। আমি এই রায়ে সন্তুষ্ট। আদালতের কাছে কৃতজ্ঞ।
পরকীয়ায় আসক্ত ছিলেন নীলা
২৩ বছর আগে মুন্সিগঞ্জ শহরের মাঠপাড়া এলাকার গিয়াসউদ্দিন দেওয়ানের পুত্র নাজির হোসেনের সাথে পঞ্চসার ইউনিয়নের নয়াগাঁও এলাকার মৃত জয়নাল আবেদীনের মেয়ে নীলা বেগমের বিয়ে হয়। তাদের ঘরে এক ছেলে সন্তান ও এক মেয়ে সন্তানও আসে। কিন্তু এরপরও পরকীয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েন নীলা। পরিকল্পনা করে বৈদ্যুতিক তার পেচিয়ে শ্বাসরোধে স্বামীকে হত্যা করেন তিনি। পরে আদালতে ১৬৪ ধারায় হত্যাকান্ডের কথা নিজ থেকে স্বীকারও করেন।
দিনমজুর ছিলেন নিহত নাজির
মুন্সিগঞ্জ শহরের মাঠপাড়া এলাকার গিয়াসউদ্দিন দেওয়ানের পুত্র নাজির হোসেন পেশায় দিনমজুর ছিলেন। মাঠপাড়াতেই টিনের দোচালা ঘরে স্ত্রীকে নিয়ে বসবাস ছিলো তার। ছেলে নাইম ও মেয়ে নুপুরকে নিয়ে সুখের সংসার ছিলো তাদের। কিন্তু স্ত্রীর পরকীয়ায় জীবন দিতে হয় নাজিরকে। পরকীয়া সম্পর্কের জেরে দাম্পত্য কলহ ছিলো তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। পাঁচ বোন ও তিন ভাইয়ের মধ্যে নাজির হোসেন ছিলেন মেঝ। মামলার বাদী ও নিহতের ছোট ভাই বলেন, আমার ভাই খুবই সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। সে পরিশ্রম করে সন্তান ও স্ত্রীদের সবসময় হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করতেন।
১৩ জন স্বাক্ষ্য দেন আদালতে
আলোচিত স্ত্রীর হাতে স্বামী খুনের মামলায় ১৩ জন স্বাক্ষী আদালতের কাছে তাদের জবানবন্দি দেন। এর মধ্যে মামলার বাদী নিহত নাজির হোসেনের ছোট ভাই জাহাঙ্গীর হোসেনসহ ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকসহ অন্যান্যরা রয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ কাজী আব্দুল হান্নান স্বামীকে হত্যার দায়ে স্ত্রী নীলা বেগমকে যাবজ্জীবন দন্ডের আদেশ দিতেই বিমর্ষ হয়ে পড়েন নীলা। পরে তাকে আদালত থেকে আবারও জেলহাজতে ফিরিয়ে নেয়া হয়। স্বামী হত্যায় দন্ডপ্রাপ্ত নীলা রায়ের বিরুদ্ধে কোন আপিল করবেননা বলেও জানা যায়।