মুন্সিগঞ্জ, ১৪ মে, ২০২২, জিতু রায় (আমার বিক্রমপুর)
একটা সময়ে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল পরিবারের সদস্যদের সাথে সিনেমা হলে ছবি দেখা। বর্তমানে হলে বসে ছবি দেখার অভ্যাস হারিয়ে গেছে। দর্শক না থাকায় একের পর এক বন্ধ হয়ে গেছে সিনেমা হল। সে ধারাবাহিকতায় মুন্সিগঞ্জে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক সিনেমা হল।
জানা যায়, ২০০০ সাল পর্যন্ত মুন্সিগঞ্জ শহর ও আশপাশের এলাকায় ৯টি সিনেমা হল ছিল। শহরে ছবিঘর ও দর্পণা, মুক্তারপুরের পান্না সিনেমা হল, কমলাঘাটের মিনার্ভা ও আয়না, ধলাগাঁও বাজারের আঁখি, টংগিবাড়ী উপজেলা সদরের পপি, বেতকা বাজারের স্বপ্নছায়া, আলদী বাজারের শীতল হল। দর্শক খরায় ব্যবসায়িক লোকসান হওয়ায় ৯টি হলের মধ্যে পর্যায়ক্রমে ৮টি সিনেমা হলই বন্ধ হয়ে গেছে।
যার মধ্যে ছবিঘর ভেঙে হয়েছে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন, মিনার্ভা ভেঙে আবাসিক অঞ্চল, দর্পনা ও আয়না সিনেমা হল ভেঙে কমিউনিটি সেন্টার। সদর ও টংগিবাড়ী ছাড়াও অন্যান্য উপজেলায়ও একই অবস্থা। বর্তমানে মুক্তারপুরের একমাত্র পান্না সিনেমা হল চালু আছে। কিন্তু দর্শক না হওয়ায় এবং লোকসানের পাল্লা ভারি হওয়ায় এ হলটিও বন্ধ হওয়ার উপক্রম প্রায়। শিল্প অধ্যুষিত এ অঞ্চলের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম পান্না হল একসময় জমজমাট ছিল। হলভর্তি দর্শকও ছিল। কিন্তু আজ এসব শুধুই অতীত। ফলে হল মালিক ভিন্ন ব্যবসার কথা ভাবছেন।
এ প্রসঙ্গে মিরকাদিম নবোদ্বয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদের সভাপতি মনিরুজ্জামান শরিফ বলেন, সত্তরের দশকে সিনেমা পিপাষুদের চাহিদা পুরণে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলায় মিরকাদিম বন্দরের খুব কাছেই গড়ে উঠে মিনার্ভা সিনেমা হলটি। এর নির্মাণ শৈলী ও সিট ক্যাপাসিটি বেশি থাকায় এখানে শুরু থেকেই ঢাকার সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন সিনেমা মুক্তি পেতো। নতুন সিনেমা মুক্তি পাওয়ার কারণে মুন্সিগঞ্জ থেকে অনেকেই এখানে ছবি দেখতে আসতো। পরে এর কিছু দূরে গড়ে উঠে আরেকটি সিনেমা হল আয়না। এই সিনেমা হলটি নির্মিত হয় আশির দশকে। আয়না সিনেমা হলের নাম পরিবর্তন করে পরে এই সিনেমা হলের নাম রাখা হয় শাপলা সিনেমা হল। নব্বইয়ের দশকে বাংলা সিনেমার ব্যাপক চাহিদা ছিলো মিরকাদিমে। বর্তমানে সেই পরিবেশ আর নেই ফলে হলগুলো থেকে এ জনপদের মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।
রামগোপালপুর এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী শেখ ফরিদ জানান, ৮০ দশকে সিনেমার স্বর্ণযুগে রামপাল ইউনিয়নে চালু হয় আঁখি সিনেমা হল। সেই সময়ে হলটিতে প্রতিযোগিতা করে বিভিন্ন সিনেমা মুক্তি পেতো। বর্তমানে এ সিনেমা হলটি বন্ধ হয়ে গেছে। এ সিনেমা হলের সামনের অংশ অনেকটাই বর্তমানে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এক সময়ে এখানে মানুষের পদচারণায় গমগম থাকলেও বর্তমানে এটি ঝোপঝাড়ে ভরা। দেখলে মনে হবে পরিত্যাক্ত গুদাম ঘর।
বন্ধ হয়ে যাওয়া দর্পনা সিনেমা হলের তৎকালীন ম্যানেজার মো. মনির হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, আশির দশকে রাত বারোটার নাইট শো শেষ হওয়ার পরেও দর্শকদের অনুরোধে ছবি চালাতে হতো। দুই তিনজন টিকিট দিয়ে শেষ করতে পারতাম না। আর এখন ভালো ছবিও আসেনা দর্শকও আসে না। পচিঁশথেকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে একটা ছবি এনে এক সপ্তাহ চালালে অর্ধেক টাকাও উঠাতে পারি না। লাভ তো দূরের কথা ষ্টাফদের বেতনটাই দিতে পারি না। এভাবে দিনের পর দিন লোকসান গেছে। তাই হল বন্ধ করে দিসি।
পান্না সিনেমা হলের মালিক আজগর হোসেন বলেন, বছরে দুইটি ঈদ আর নতুন ছবির ক্ষেত্রে শুধু শুক্রবার দর্শকের সমাগম হয়। বছরের বাকি সময় দর্শক শূণ্য থাকে সিনেমা হল। ছবি চালিয়ে লোকসান গুনতে হচ্ছে। তাছাড়া প্রতিটি বাজারের চায়ের দোকানে ক্যাবল টিভির মাধ্যমে বিভিন্ন ছবি দেখানো হয়। যার ফলে মানুষ এথন হলে আসতে চায় না।
বিভিন্ন চ্যানেল, মোবাইলে আপলোডিং, ইন্টারনেট ও ডিস লাইনের মাধ্যমে ঘরে ঘরে সিনেমা দেখার ব্যবস্থা থাকায় সিনেমা হলে দর্শক আসতে চাচ্ছে না। সিনেমা হলের প্রতি বিমুখ হয়ে গেছে। ঘরে বসেই বিনোদনের সুযোগ নিতে আগ্রহী হয়ে উঠছে মানুষ। হলে ছবি দেখার ক্ষেত্রে কেন এত বিমুখতা? এ বিষয়ে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সাথে কথা বললে তারা বলেন, পরিবারের সকলকে নিয়ে সিনেমা হলে সিনেমা দেখার পরিবেশ নেই। তাছাড়া ইন্টারনেট, মোবাইলে ডাউনলোড করে ছবি দেখা যায়। ফলে মানুষ আর আগের মতো সিনেমা হলে আসার আগ্রহ দেখায় না।
কলের গানের রেকর্ড সংগ্রাহক হিসেবে খ্যাত দরদী মাইক সার্ভিসের সত্বাধিকারী নেসার আহম্মেদ হাজারী জানায়, আমাদের সময় সপ্তাহে দুটি করে সিনেমা মুক্তি পেতো ঢাকাতে। প্রতিযোগিতা করে সিনেমা চলতো । কার আগে কে এখানে নতুন সিনেমা আনবে তার প্রতিযোগিতা চলতো। সিনেমার গান, গল্প আর অভিনয় মন্ত্রমুগ্ধ থাকত দর্শক। এখন আর সেই ধরনের ছবি বানাতে পারে না তাই দর্শকও নাই।
মুন্সিগঞ্জ ফিল্ম সোসাইটির সভাপতি তুষার রায় বলেন, সিনেমা একজন মানুষের সৃজনশীল মনোভাব গঠনে ও বিকাশে ভূমিকা রাখে। আমরাই শেষ প্রজন্ম যারা হলে বসে সুন্দর পরিবেশে ছবি দেখার সুযোগ পেয়েছি। নতুন প্রজন্ম হলে বসে সিনেমা দেখার কথা ভাবতেও পারে না। পরিবেশের কারণে অভিভাবকরা শঙ্কায় থাকে তার সন্তানকে সিনেমা দেখতে পাঠাতে।
মুন্সিগঞ্জের সন্তান চিত্র নায়ক আশিক চৌধুরী জানায়, করোনা আগে থেকেই সারাদেশে হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। ভালো সিনেমা মুক্তি পেলেও দর্শক সমাগম না থাকায় একের পর এক ছবি ব্যবসায়িক বিপর্যয়ের মুখ পড়ছে। এর ফলে লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে প্রযোজকদের।
তিনি আরো বলেন, সিনেমা শিল্পকে বাঁচাতে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত। প্রতিটি জেলায় আধুনিক সুবিধা সম্বলিত নতুন নতুন হল নির্মাণ করা প্রয়োজন।