৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
বুধবার | বিকাল ৪:২৪
মুক্তিযোদ্ধা নয়, তাই তালিকা নেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের
খবরটি শেয়ার করুন:

মহান মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টুকুতেই পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের নিরীহ মানুষের উপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ডিসেম্বর মাসে তারা যখন বুঝতে পারে তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়, তখন এ দেশকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল এবং পঙ্গু করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। এ লক্ষ্যে ১৪ ডিসেম্বর রাতে তাদের দোসর রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনীর সহায়তায় দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নিজ নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে হানাদার বাহিনী।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বুদ্ধিজীবীদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ। ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। দিবসটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববহ হলেও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা নেই কোথাও।

সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভিন্ন সংস্থায় খোঁজ নিয়েও পাওয়া যায়নি শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। বিষয়টি সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, তারা মুক্তিযোদ্ধা নয়, তাই তালিকা করা হয়নি।

রোববার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে গিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কোনো তালিকা পাওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. জহুরুল হক প্রিয়.কমকে বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সবাই তো মুক্তিযোদ্ধা নন। তাই সবার তালিকা মন্ত্রণালয়ে নেই। আমাদের কাছে শুধু শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর কর্তৃপক্ষের কাছেও নেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি মফিদুল হক প্রিয়.কমকে বলেন, এই তালিকা করা অনেক কঠিন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাছে এ তালিকা নেই।

তার কথামতো, বাংলা একাডেমি প্রকাশিত স্মৃতি’৭১ নামে একটি গ্রন্থে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা রয়েছে। কিন্তু বাংলা একাডেমির লাইব্রেরিতে বইটি পাওয়া যায়নি।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ম্যানেজার চন্দ্রজিতপ্রিয়.কমকে বলেন, বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডতো সারাদেশে আলাদা আলাদাভাবে সংগঠিত হয়েছে। তাই এ তালিকা করা খুব কঠিন। স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করা হয়েছে এমন ১৫২ জনের তালিকা এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। প্রাথমিকভাবে ঢাকা কেন্দ্রীক কিছু শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি হলেও সারাদেশে কত বুদ্ধিজিবী শহীদ হয়েছেন এ তথ্য এখনো তৈরি করা হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে একাধিকবার শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হলেও জীবিত বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এতে ভেটো দিয়েছেন। তাদের দাবি, তৎকালীন সময়ে বহু বুদ্ধিজীবী পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন, চাকরিও করেছেন এবং বেতন-ভাতাদি পেয়েছেন। তারা ভারতে না গিয়ে দেশে ছিলেন। এক্ষেত্রে তাদের মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা যায় না। আর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় শুধুমাত্র শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বুদ্ধিজীবীদেরই তালিকা করবেন। এর বাইরে নয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৭২ সালে সাড়ে ৩০০ শহীদ বুদ্ধিজীবীর একটি অসমাপ্ত তালিকা হলেও পরবর্তীতে এ তালিকাকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়া হয়নি। পরে ১৯৮৪ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা নিয়ে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক গ্রন্থ’ প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নাম সংগ্রহের জন্য তখন বাংলা একাডেমি সব জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। সে সময় বাংলা একাডেমি নিজেরাই ঠিক করে যে শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ডাক্তার, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার, প্রকাশকসহ বিশেষ কিছু পেশাজীবীদের ‘বুদ্ধিজীবী’ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

সেই নীতিমালা অনুযায়ী ১৯৮৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর ২৫০ জনের তালিকা নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষ গ্রন্থ প্রকাশ করা হয়। যে ২৫০ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম সংগ্রহ করা হয় তাদের অনেকেরই আবাসিক ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে বেশকিছু শহীদ বুদ্ধিজীবীর বিস্তারিত তথ্য যোগাড় করা সম্ভব হয়নি। কোষ গ্রন্থের নাম-ঠিকানা ধরে খোঁজ-খবর নিয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের বেশ কয়েকজনের নিকটাত্মীয়ের লেখা সংকলিত করে ১৯৮৮ সালে বাংলা একাডেমী প্রকাশ করে ‘স্মৃতি-৭১’ গ্রন্থ।

‘স্মৃতি-৭১’ গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপক সাড়া জাগায় এবং ওই গ্রন্থে প্রকাশিত তালিকার বাইরে অনেক শহীদ বুদ্ধিজীবীর আত্মীয়-স্বজন তাদের তথ্য নিয়ে স্বপ্রণোদিত হয়ে বাংলা একাডেমির সঙ্গে যোগাযোগ করে। এ পর্যায়ে এসে কোষ গ্রন্থের তালিকাসহ মোট প্রায় ৩২৫ জনের মতো শহীদ বুদ্ধিজীবীর নাম বাংলা একাডেমির হাতে আসে। পরে একের পর এক ‘স্মৃতি-৭১’ প্রকাশিত হতে থাকে। এ গ্রন্থের ১০ম খন্ড প্রকাশিত হয় ৪ ডিসেম্বর ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। ১০ম খন্ডে স্থান পেয়েছেন ১২জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর নিকটাত্মীয়ের স্মৃতিকথা। ১০ম খন্ড পর্যন্ত বাংলা একাডেমি ২৩৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর আত্মীয়-বন্ধুবান্ধবের লেখা স্মৃতিকথা প্রকাশ করে। এর বাইরে বাংলা একাডেমি আর কোনো তালিকা সংগ্রহ বা প্রকাশ করতে পারেনি। সরকারও আর কখনো শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করার চেষ্টা করেনি।

অন্যদিকে ১৯৭২ সালে জাতীয়ভাবে প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী দিবসের সঙ্কলন, পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ ও আন্তর্জাতিক নিউজ ম্যাগাজিন ‘নিউজ উইক’ এর সাংবাদিক নিকোলাস টমালিনের লেখা থেকে জানা গেছে, শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা মোট ১ হাজার ৭০ জন।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একাত্তরের ২৯ ডিসেম্বর গঠিত বুদ্ধিজীবী তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, রাও ফরমান আলী এদেশের ২০হাজার বুদ্ধিজীবীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়নি। কারণ, ফরমান আলীর টার্গেট ছিল শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদেরকে গভর্নর হাউজে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে মেরে ফেলা।

 

আমিনুল ইসলাম মিঠু

error: দুঃখিত!