২৮শে নভেম্বর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ
মঙ্গলবার | রাত ৮:২৩
মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে রিফাত হোসাইন দিগন্ত’র লেখা “ঢেউ”
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ ২৮ নভেম্বর, ২০১৯, বিশেষ প্রতিনিধি (আমার বিক্রমপুর)

“ভাই এরকম ভাগ্য যদি সবার থাকতো রে!তোর কপালটা দোস্তো সোনায় বাঁধাই কইরা রাখা দরকার!!” দাঁত কেলিয়ে খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে রাকিবের কাঁধে ঢলে পড়তে পড়তে বলছিলো তার বন্ধু সজীব…

“ভাগ্য মানে ভাগ্য? ভার্সিটি যাওয়ার লাইগা সিএনজিতে উইঠা সিএনজির পিছে তিন বান্ডিল টাকা পাইয়া যাওয়া কি মুখের কথা? তবে যাই বলোস,বহুদিন পর এমন একটা পার্টি পাইলাম মামা! দিল খুশ হয়া গেসে..বিদেশী জিনিসগুলা তো কোনদিন ছুঁইয়া দেখতেও পারি নাই..আজকে রাকিব বন্ধু তোর লাইগা এক বোতল কইরা হলেও পাইলাম সবাই!!আহা!” এলকোহলের নেশায় মত্ত হয়ে প্রলাপ বকে চলে রাকিবের আরেক আসক্ত বন্ধু জাবের…

মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির সন্তান রাকিব..কলেজ অবধি নিজেকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলার পর অবশেষে সঙ্গদোষে বখে গিয়েছে ভার্সিটির প্রথম সেমিস্টারেই..তবে মধ্যবিত্ততার কিছু বাধ্যবাধকতা তো ছিলোই..তাই তার বখাটেপনা গুলো ঠিক প্রশ্রয় পাচ্ছিলো না..যেমনটা আজ পেয়ে গিয়েছে..নেহায়েৎই ভাগ্যের বশে সিএনজির পেছন থেকে পেয়ে যায় এক হাজার টাকার নোটসমৃদ্ধ তিনটে চকচকে টাকার বান্ডেল..ব্যাংক থেকে সদ্য তোলা..টাকাগুলো চোখে পড়ার পর সেগুলো কে তার ব্যাগে ঢুকাতে সময় লেগেছে ১৫ সেকেন্ড..এর মাঝে পাঁচ সেকেন্ড শুধু ভেবেছে এগুলো নিয়ে সে একাই নিজের নিষিদ্ধ ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে নামবে নাকি তার ফ্রেন্ড নামক তারই মতো বাকি পাঁচটা স্পয়েল্ট ব্র্যাটকে ডেকে নেবে..

এতগুলো টাকা নিয়ে একা একা কোথাও বেরুনোর সাহস হলো না..দ্বিতীয় অপশনটাই বেছে নিলো রাকিব..নির্ধারিত ভাড়ার ডাবল দিয়ে তৎক্ষণাৎ সিএনজি ছাড়ে সে..এর আধ ঘন্টা পরই তাদেরকে দেখা গেল নিউ মার্কেটের পেছনের গলিতে..ব্রাউন কালারের প্যাকেটে মোড়ানো চকচকে রঙ্গিন সুদৃশ্য একাধিক কাঁচের বোতল হাতে..মুখে চোখে জ্বলজ্বল করছিলো নিষিদ্ধ আনন্দের উত্তেজনা..

কলিংবেলটা চাপতে গিয়েই হঠাৎ রাকিবের খেয়াল হলো,বাসার সদর দরজাটা রোজকার মতো লাগানো নেই..নিতান্ত অবহেলায় ভেজিয়ে রাখা..আস্তে করে ঠেলে ঢুকে আবার নিঃশব্দে দরজাটা বন্ধ করে দেয় ও..ঘড়িতে বাজছে নয়টা পঁয়ত্রিশ মিনিট..সে অলরেডি তার বাসায় ঢুকার লিমিটের চেয়ে এক ঘন্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট লেট..ড্রয়িং রুমে গম্ভীর মুখে তাকে তুখোড় কয়টি ঝাড়ি দেবার জন্য তার বাবা বসে আছে,এ ব্যাপারে সে মোটামুটি নিশ্চিত ছিল..

হ্যাঁ, হলো ঠিক সেরকমটাই..তবে অবাক হলো তখন,যখন সে চোরের মতো এত দেরিতে বাসায় ঢুকার পরও সোফায় মূর্তির মতো বসে থাকা তার বাবা একবার মুখ উঠিয়ে টু শব্দও করলেন না…ছোট ভাইটা আরেক সোফায় বসে থাকা মায়ের কোলে গুটিশুটি মেরে আছে..আপু এক কোনায় দেয়ালে হেলান দিয়ে এক মনে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে..ভাইয়াকে দেখলো কেবলই অস্থির মনে পায়চারি করে চলেছে ড্রয়িং রুমের এমাথা থেকে ওমাথা..

একটা দিনের মাঝে যেন গোটা বাসার আবহাওয়া বদলে গেছে..কেমন একটা সাদাকালো নির্মম ছায়ায় যেন ম্রিয়মান হয়ে কুঁকড়ে আছে তার হাসিখুশি পরিবারটা..

রাকিবকে ঢুকতে দেখেই তার ছয় বছরের ছোটভাইটা লাফ দিয়ে উঠে বসে..ছুটে যায় তার কাছে..”ভাইয়া ভাইয়া! তুমি কোথায় ছিলা সারাদিন?আজকে না আমি অনেক কষ্ট..আমরা আমরা..”

উত্তেজনা আর কান্নার দমকে ফোঁপাতে ফোঁপাতে কথা বলতে পারছে না ছেলেটা..আস্তে করে মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে রাকিব,”কি হইসে তোর আবার?”

“আব্বু না আজকে অফিস থেকে এসেই আমাকে খুব মারছে..এই যে এই যে আমার গালে দেখো?খুব জোরে মারছে আমাকে আব্বু..আমি অনেক ব্যাথা..অনেক অনেক কষ্ট..” এতক্ষন হয়তো কাঁদতে কাঁদতেই শুয়ে পড়েছিল..রাকিবকে জড়িয়ে ধরে আবার কান্না ঝরতে লাগলো তার শুকিয়ে আসা বাচ্চা চোখ দুইটা থেকে..

“হইসে চিৎকার থামাও তুমি..আব্বু বাইরে থেকে আসা মাত্রই এরকম শুরু করে দিছিলা কেন?” এগিয়ে এসে ওকে কাছে টেনে নিতে নিতে বলে রাকিবের আপু..

আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,রাকিব..”কি হইসে রে আপু?”

ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলে ওর আপু..”কই ছিলি তুই সারাদিন?আজকে বেতন উঠাতে ব্যাংকে গেছিলো আব্বু..আসার সময় ভুল করে বেচারা বেতনের প্যাকেটটাই ফেলে চলে আসছে সিএনজির পেছনে..আজকে বেতন পেয়ে সাদিবকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়ার কথা দিছিলো বোধয় আব্বু..তো,এসেই দেখে সাদিব তো একদম রেডি হয়ে বসে আছে..আব্বু আসতেই লাফালাফি শুরু করে দিলো..এমনিতেই লোকটা একদম মানসিকভাবে শেষ হয়ে গেসে..এর মধ্যে ওর এসব দেখে একদম রাগ কন্ট্রোল করতে পারে নাই হয়তো..মাসের শুরু..বাসায় বাজার কিচ্ছু নাই..তোর আমার ফিজ,সাদিবের স্কুল-টিউশন ফিজ..এরপর বাসার আর সবকিছুই এখন একদম অনিশ্চয়টায় পড়ে গেসে,বুঝলি?আচ্ছা,তুই ভাবিস না এসব নিয়ে..আম্মুর স্বর্ণের চেইনটা আর দুল দুইটা নিয়ে কালকে ভাইয়া যাবে স্বর্ণের দোকানে..দেখা যাক,কদ্দুর পাওয়া যায়..আব্বুর দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না..একদম মুষড়ে পড়ছে রে মানুষটা…আচ্ছা যা গিয়ে ফ্রেশ হ..খাবার বেড়ে দিতেসি আমি”

“আচ্ছা আপু!! আব্বু কি কিছু বলছে যে সিএনজিটার সামনের পার্টটা লাল রঙ করা ছিল..বা এজাতীয় কিছু?” একটা তীব্র অশুভ আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে রাকিব জিজ্ঞেস করে কথাটা..

“আরে হ্যাঁ! আসার পর তো কয়েকবার বলসে আব্বু..লাল রঙের সামনের দিক সিএনজিটার..পেছনে নাম্বার প্লেট ভাঙা..আব্বু আর ভাইয়া তো অনেকক্ষন খুঁজেও আসছে সিএনজিটাকে,পায় নাই..কিন্তু তুই কিভাবে জানলি?”

“নাহ এমনি আরকি..” বলেই সোজা রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয় রাকিব..

বন্ধ দরজার এপাশে যখন বছর বিশেকের এক তরুণ তীব্র অনুশোচনা আর অপরাধবোধে বালিশে মুখ গুঁজে গগনবিদারী চিৎকারে ভোকাল কর্ড ছিঁড়ে ফেলছিলো..ওদিকে হয়তো পাড়ার কোন এক অবৈধ মাদক ব্যবসায়ী তখন মুখ ভর্তি প্রশান্তির হাসি নিয়ে তার সারাদিনের বেচাঁকেনার হিসেব কষছিলো..মাশাল্লাহ, আজ তার বেশ ভালো বেচাকেনা হয়েছে..

error: দুঃখিত!