২১শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
শুক্রবার | রাত ৪:০৯
মন্দির ঘেষে কাঁটাতারের বেড়া, উৎকন্ঠা
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ৬ এপ্রিল, ২০২২, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)

মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার মালখানগর ইউনিয়নের ফেগুনাসার গ্রামে অবস্থিত শতবছরের ‘শ্রী শ্রী ফেগুনাসার শিব মন্দির’ ঘেষে পাশ্ববর্তী জমির মালিকানা দাবি করে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে স্থানীয় জহিরুল হক বেপারীর পক্ষের লোকজন।

অন্যদিকে মন্দির কমিটির লোকজন বলছে, যে প্রক্রিয়ায় জহিরুল হক বেপারী মন্দির পাশ্ববর্তী জমির মালিকানা দাবি করছেন সেটি অবৈধ। এ নিয়ে আদালতে মামলা চলমান। কয়েকদিন আগে বিরোধপূর্ণ ঐ জমিতে কোরআন শরীফ রেখে দেওয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গাছ লাগানোকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি হয়। পরে উপজেলা পুলিশ-প্রশাসন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দুই পক্ষকে শান্ত থাকতে বলে।

সর্বশেষ গত সোমবার বিরোধপূর্ণ ঐ জমির মালিকানা দাবি করে কাঁটাতারের বেড়া দেয় জহিরুল হক বেপারী পক্ষের লোকজন। এ নিয়ে বর্তমানে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা কাজ করছে স্থানীয় হিন্দু পরিবারগুলোর মাঝে।

জানা যায়, আনুমানিক আটশত বছরের পুরনো ফেগুনাসার শিব মন্দির। উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শিব লিঙ্গটি এই মন্দিরে অবস্থিত বলে প্রচলিত রয়েছে। এটি মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার মালখানগর ইউনিয়নের ফেগুনাসার গ্রামে অবস্থিত। মন্দিরের জমি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে স্থানীয় একটি পক্ষের সাথে বিরোধ চলছে। ইতিমধ্যে জমির মালিকানা দাবি করে মন্দিরের পাশ ঘেষে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে স্থানীয় জহিরুল হক বেপারী। বর্তমানে এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা চলছে, উৎকন্ঠায় রয়েছে স্থানীয় হিন্দু পরিবারগুলো।

স্থানীয় সমির দাস বলেন, এই মন্দিরটি দীর্ঘদিন যাবৎ এই এলাকায় অবস্থিত। দূরদুরান্ত থেকে এই মন্দিরে লোকজন আসে শিবের পূজা করতে। কিন্তু মন্দিরের জায়গা একটি মহল কারসাজির মাধ্যমে দখল করতে চায়।

স্থানীয় দ্বীপা দাস বলেন, এই শিব মন্দির বিক্রমপুরের একটি ঐতিহ্যবাহী মন্দির। শুধু বিক্রমপুর না, এশিয়া মহাদেশের ঐতিহ্য এটি। আশপাশের কিছু মানুষ আমাদের মন্দিরের জায়গা দখল করে রেখেছে। এবং বলছে যে, এটা তারা ক্রয় করেছে। কিন্তু মন্দিরের সম্পত্তি ক্রয় করা যায় না। এটাই আমরা জানি। সরকার কি কোন পদক্ষেপ নেবে না? সরকারের তো উচিৎ, সরকার তো নিরপেক্ষ। মুসলমান হোক, বৌদ্ধ হোক, হিন্দু হোক, সরকারতো নিরপেক্ষভাবে মন্দির, মসজিদ, গীর্জা রক্ষা করবে। আমরা চাই, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের এই মন্দিরের সম্পত্তি উদ্ধার করে আমাদেরকে সুন্দরভাবে পূজা করার পরিবেশ তৈরি করে দিক।

স্থানীয় শিউলী মুখার্জী বলেন, আমি ৪০ বৎসর যাবৎ এই মন্দিরে শিবের পূজা করতে আসি। মন্দিরের চারপাশে আগে আরও অনেক জায়গা ছিলো। সেগুলো দখল হতে হতে এখন মন্দিরের দেয়ালে এসে ঠেকেছে। কোনদিন মন্দিরও দখল হয়ে যাবে সেই শঙ্কায় আছি। এদিকে, ফেগুনাসার মৌজার ৩৯৭ খতিয়ানে প্রায় ২০২ শতাংশ জমিটি সিএস পর্চা অনুযায়ী ‘খাজনা বৃদ্ধির অযোগ্য ও দান-বিক্রয় ক্ষমতা রহিত’ মর্মে লিখিত রয়েছে। তবে কি করে জমিটি ক্রয়-বিক্রয় হলো এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছে মন্দির কমিটি।

তাদের দাবি, তৎকালীন মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকায় জরিপে হেমন্ত কুমার শর্মা, অনন্ত কুমার শর্মা এবং কামিনী সুন্দরী দেব্যার নামে সিএস পর্চা লিপিবদ্ধ হয়। পরবর্তীতে সিএস পর্চা অনুযায়ী এসএ ও আরএস পর্চায় লিপিবদ্ধ হয়। এতে হেমন্ত কুমার শর্মা, অনন্ত কুমার শর্মা এবং কামিনী সুন্দরী দেব্যা ফেগুনাসার মৌজার ৩৯৭ খতিয়ানে প্রায় ২০২ শতাংশ জমি বিভিন্ন মানুষের কাছে বিক্রি করে দেয়। আরএস পর্চা অনুযায়ী জহিরুল হক বেপারী ১৯৯৩ সালে তাদের কাছ থেকে ১০২ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। পরে ২০১৪ সালে তিনি নামজারি করেন। তিনি ১৯৯৩ সাল থেকে জমির কিছু অংশ দখল করে বাড়ি তৈরী করে বসবাস করছেন। জহিরুল হক মন্দিরের পাশ ঘেষে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ায় মন্দির কমিটির লোকজনের মাঝে উত্তেজনা বিরাজ করছে। যে কোন দিন মন্দির কমিটির লোকজন ও জমির মালিকানা দাবিদারদের সাথে রক্তক্ষয়ী সংর্ঘষের আশঙ্কা করা হচ্ছে।

মন্দির কমিটির লোকজন বলছে, সিএস পর্চায় এই সম্পত্তিটি ‘খাজনা বৃদ্ধির অযোগ্য ও দান-বিক্রয় ক্ষমতা রহিত’ মর্মে লিখিত রয়েছে। তাহলে কি করে পরবর্তীতে এই সম্পত্তি বিক্রি করে। আর জহিরুল হক কিভাবে কিনে। যেহেতু জমিটি বিক্রির অযোগ্য।

মন্দির কমিটি ও স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বলছেন, শ্রী শ্রী শিবমন্দিরটি প্রায় ৮০০ বছরের পুরনো। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, এই মন্দিরটির ভেতরে যে শিবলিঙ্গ রয়েছে সেটি দৈর্ঘ্যর মাপে এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় শিবলিঙ্গ। মাটির নিচে এটি ঠিক কত ফুট তার কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধারনা করা যায়, মাটির নিচে এর গভীরতা প্রায় ২০০ ফুট। যার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন হিন্দু ধর্মগুরুদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে লেখা বিভিন্ন বইতে। তাই একে এশিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় শিবলিঙ্গ বলে অনেকে। মহারাজ রাজবল্লভ ১১৫৯-১১৮৫ সালে তার রাজত্বকালে এই শিব মন্দিরটি নির্মাণ করেন।

প্রাচীন বিক্রমপুর সংক্রান্ত বিভিন্ন বইয়ে উল্লেখ আছে, উচ্চাভিলাষী ও অত্যন্ত ক্ষমতাধর মহারাজা রাজবল্লভ সন্ধ্যা-বন্দনার জন্য এই শিবমন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করে এখানে একসময় তালতলা বন্দরও ছিলো। যা বর্তমানে বিলুপ্ত। প্রতিবছর ফাল্গুন মাসের পূর্ণিমা রাতে রাজা রাজভল্লব সেনের এই ‘শিব মন্দিরে’ ধুমধাম করে শিবরাত্রি ব্রত ও পূজা অনুষ্ঠিত হয়। দিনব্যাপী চলে মহাউৎসব। দূরদূরান্ত থেকে এসে ভিড় করেন অসংখ্য পুণ্যার্থী। শিবের মাথায় জল ঢালতে ভোর থেকেই এই মন্দিরচত্বরে শুরু হয়ে যায় ভক্তদের ঢল। মেলাও বসে মন্দির-চত্বরে। এক সময় বিশাল এলাকা নিয়ে রাজা রাজ বল্লভ মন্দিরটি নির্মাণ করলেও বর্তমানে মন্দিরের চত্বর বাদে বাকি জায়গা প্রভাবশালীরা বিভিন্ন উপায়ে দখল করে নিয়েছে। প্রাচীন বিক্রমপুরের ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষায় এই শিব মন্দিরটি সংস্কার ও দখলমুক্ত করার দাবি স্থানীয়দের।

স্থানীয়রা বলছেন, সিএস পর্চায় এই সম্পত্তিটি ‘খাজনা বৃদ্ধির অযোগ্য ও দান-বিক্রয় ক্ষমতা রহিত’ মর্মে লিখিত রয়েছে। তাহলে কি করে পরবর্তীতে এই সম্পত্তি বিক্রি করে। আর জহিরুল হক কিভাবে কিনে। সিএস পর্চা অনুযায়ী জমিটি হেমন্ত কুমার শর্মা, অনন্ত কুমার শর্মা এবং কামিনী সুন্দরী দেব্যা শিব মন্দিরটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে থাকাকালীন পর্চায় নাম উঠে। পরবর্তীতে এস এ ও আর এস পর্চায় তাদের নামই লিপিবদ্ধ হয়। এই সূত্রে হেমন্ত কুমার শর্মা অনন্ত কুমার শর্মা এবং কামিনী সুন্দরী দেব্যা মন্দিরের জায়গাটি বিভিন্ন জনের কাছে অবৈধ পন্থায় বিক্রি করে। তিনি আরও জানান, একইদিনে আরএস পর্চা অনুযায়ী আরও দশটি দলিলের মাধ্যমে জমি বিক্রি করেন তারা।

ফেগুনাসার শ্রী শ্রী শিব মন্দির কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট অজয় কুমার চক্রবর্তী বলেন, মন্দির পাশ্ববর্তী জমি নিয়ে জেলা যুগ্ম জজ দ্বিতীয় আদালতে মামলা চলমান। যার মামলা নং ১৩৮/২০২০। মামলা চলমান থাকা অবস্থায় বিরোধপূর্ণ জায়গায় কিভাবে কাঁটাতারের বেড়া দিলো সেটাই আমার প্রশ্ন। তিনি বলেন, মন্দিরের সিএস পর্চায় মন্তব্যের কলামে উল্লেখিত জমি ক্রয় বিক্রয় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেই হিসাবে এই জমি বিক্রি করার মত অধিকার কারও নেই। তাছাড়া দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রি করাও যায় না। এই মন্দিরটি রাজা রাজবল্লভ আমলে নির্মিত। এটিকে হিন্দু প্রত্নত্বত্ত্ব সম্পদ হিসাবে ঘোষণা করা উচিৎ। কিভাবে মন্দিরকে ঘিওে পর্যটন এরিয়া করা যায় সেটি নিয়েও আমাদের ভাবা উচিৎ। বর্তমানে জমি সংকুলানের কারণে মন্দিরের সামনে আমরা লোকজনকে দাড়াতে দিতে পারি না। এর মধ্যে আবার তারা জমি দখলের পায়তারা করছে।

এসব অভিযোগের বিষয়ে অভিযুক্ত জহিরুল হক বেপারী’র কাছে বক্তব্য জানতে চাইলে শারিরীক অসুস্থতার কারণে তিনি কথা বলতে পারেননি। তার উপস্থিতিতে তার মেয়ে জহুরা বেগম ‘আমার বিক্রমপুর’ কে বলেন, ১৯৯৩ সালে হেমন্ত কুমার শর্মা, অনন্ত কুমার শর্মা এবং কামিনী সুন্দরী দেব্যার কাছ থেকে ১০২ শতাংশ জমি আমার বাবা ক্রয় করে। তখন জমির মালিকদেরই একটি ঘরোয়া ছোট পরিসরে শিব মন্দির ছিল। জমি ক্রয় করার কয়েক বছর পর গ্রামের কয়েকজন মুরব্বীদের উপস্থিতিতে আমার বাবা ক্রয়কৃত জমি থেকে মন্দিরের জন্য কিছু জমি ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে মন্দির কমিটি আমার বাবার ক্রয়কৃত সম্পত্তি জোর করে দখলে নিতে চায়।

সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার মন্দির এলাকা পরিদর্শনে যান সিরাজদিখান উপজেলা চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ। তার কাছে মুঠোফোনে ঐ এলাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি গতকাল দুপুরে ‘আমার বিক্রমপুর’ কে জানান, মন্দিরের বেশ কিছু জায়গা অবৈধভাবে মন্দিরের সেবায়েত বিক্রি করে গেছে। কিন্তু সে মালিক না, তার অধিকারও নেই মন্দিরের জমি বিক্রি করার। এটা নিয়ে মামলা চলমান। কিন্তু মন্দিরের বিরোধপূর্ণ জায়গা নিজেদের মালিকানা দাবি করে স্থানীয় জহিরুল হক বেপারী বারবার উত্তেজনা তৈরির চেষ্টা করছে। মন্দিরের স্বাভাবিক কার্যক্রমেও তারা বাঁধা দিচ্ছে। আমি কয়েকবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তাদের শান্ত থাকতে বলেছি। তারা আমার কথা শুনেনি। গতকালকে গিয়েও তাদের শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বলেছি।

মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুল ‘আমার বিক্রমপুর’ কে বলেন, বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত। যেহেতু মামলা চলমান। বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে যাতে কোন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি না হয় সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

error: দুঃখিত!