২২শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
শনিবার | রাত ৪:১৪
বাংলাদেশের একমাত্র স্পোর্টস কমপ্লেক্স হবে শ্রীনগরে
খবরটি শেয়ার করুন:

পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, ইছামতি, শীতলক্ষ্যা নদীবেষ্টিত জেলা মুন্সীগঞ্জ। এ জন্যই হয়তো এ জেলা থেকে বেরিয়ে এসেছেন কিংবদন্তি সাঁতারু ব্রজেন দাস। সাফ গেমসের এক আসরে পাঁচ সোনা জেতা সাঁতারু মোশাররফ হোসেনও এ জেলার। সাঁতারের পাশাপাশি ঢাকার অদূরের এ জেলার ঐতিহ্য আছে ফুটবল, খো খো, ব্যাডমিন্টন, অ্যাথলেটিকস, ক্রিকেটেও। ঐতিহ্যের পাশাপাশি নতুন ইতিহাসও লেখা হতে যাচ্ছে মুন্সীগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গনে।

বাংলাদেশের একমাত্র স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মিত হবে এ জেলায়। পদ্মা সেতুকে ঘিরে হংকংয়ের মতো আধুনিক নগরী গড়ার পরিকল্পনা আছে সরকারের। যেখানে থাকবে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, কনভেনশন সেন্টার, বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও পর্যটনকেন্দ্র। এরই অংশ হিসেবে মুন্সীগঞ্জে আধুনিক সুযোগ-সুবিধাসহ স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণে বিওএকে আগেই প্রস্তাব দিয়ে রেখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাই স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণের বাস্তব পদক্ষেপ নেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। লৌহজংয়ে পদ্মাপারে জায়গাও পরিদর্শন করে এসেছেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট বীরেন শিকদার। পদ্মাপারের একাধিক স্থান চিহ্নিত করে এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়েছে প্রতিবেদন। এতে নতুন হাওয়া লাগে এশিয়ান অলিম্পিক কমিটির সভাপতি গত জানুয়ারিতে স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণে সাহায্যের আশ্বাস দেওয়ার পর। চাইনিজ একটি কম্পানির সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনাও করেছে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়।

এ নিয়ে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম জানালেন, ‘আমরা আশাবাদী দ্রুতই এর কাজ শুরু হবে। খুব সম্ভবত শ্রীনগরে হতে পারে এ কমপ্লেক্স।’ ঢাকার অদূরে হওয়ায় মুন্সীগঞ্জ ফুটবল লিগটা হতো জমজমাট। ঢাকা থেকে নামি খেলোয়াড়রা আসতেন নিয়মিত। স্টেডিয়ামে দর্শকদের সামাল দিতে হিমশিম খেতেন আয়োজকরা। সেই চিত্রটা নেই আর। ডিএফএ গঠনের পর গত আট বছরে নিয়মিত হয়নি আটটি লিগ। তবে গত চার বছরে হয়েছে তিনটি লিগ। সেই লিগগুলো করতে গিয়েও যথেষ্ট ঝক্কি পোহাতে হয়েছে বলে জানালেন জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক আয়নাল হক, ‘আমাদের এখানে মাঠ সংকট প্রকট। স্টেডিয়াম ছাড়া টুর্নামেন্টের জন্য তেমন মাঠ নেই। পাওয়া যায় না স্পন্সরও। বাফুফে গত লিগের জন্য যত টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার পুরোটা দেয়নি। তাতে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। তার পরও স্থানীয় উদ্যোগে ফুটবলসহ অন্য খেলাগুলো চালিয়ে নিচ্ছি আমরা।’ লিগ আগের মতো জমজমাট না হলেও উপজেলাগুলোকে নিয়ে জেলা প্রশাসক কাপটা নিয়মিত এবং আগের মতোই আবেদনময়।

গত জেলা প্রশাসক কাপের সময় সাবেক কৃতী ফুটবলারদের সংবর্ধনাও দেওয়া হয় স্থানীয়ভাবে। মুন্সীগঞ্জের ‘বড় মাঠ’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিবিজড়িত। এ মাঠে রাজনৈতিক সমাবেশ ছাড়াও মঞ্চনাটক, সাংস্কৃতিক সপ্তাহ, প্রদর্শনী হতো নিয়মিত। আর ক্রীড়াঙ্গনের প্রাণ তো ছিলই। ১৮৮৫ সালে শহরের মুন্সীগঞ্জ হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই এ মাঠের উৎপত্তি। তৎকালীন এ অঞ্চলের জমিদার আক্রামুন্নেছার পরিবারের জমিতে গড়ে ওঠা স্কুলটি লেখাপড়ার মতো শিক্ষার্থীদের খেলাধুলার ওপরও সমান গুরুত্ব দিত। যে ‘বড় মাঠ’ সৃষ্টি করেছিল দেশ কাঁপানো ক্রীড়াবিদদের, বর্তমান প্রজন্মের কাছে সেটি স্টেডিয়াম।

১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্বাচনী সমাবেশটি এ মাঠের স্মরণকালে বড় সমাবেশ। পঞ্চাশের দশকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এ মাঠে সমাবেশ করেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ও এ মাঠ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম ট্রেনিং সেন্টার। ১৯৯৩ সাল থেকে বড় মাঠের বিলুপ্তি হয়ে যাত্রা শুরু স্টেডিয়ামের। বড় মাঠের পূর্বদিক ছিল হাই স্কুলের মালিকানায় আর পশ্চিমের অংশ টাউন কমিটির। দুই মাঠের মাঝখানেই ছিল টিন-কাঠের বিশাল প্যাভিলিয়ন। উত্তর-দক্ষিণে এমনভাবে প্যাভিলিয়নটি ছিল যে দুই পাশের মাঠের খেলাই দেখা যেত। তবে আগে নানা কারণে হাই স্কুলের অংশেই খেলাধুলা হতো বেশি। হাই স্কুল মাঠের পাশে বর্তমান হরগঙ্গা কলেজের জায়গাটিও মুন্সীগঞ্জ হাই স্কুলের। এ জমি কিনেই প্রতিষ্ঠা করা হয় হরগঙ্গা কলেজ।

পাকিস্তান শাসনামলে ১৯৬৭ সালে মাঠে মাটি ভরাট করা হয়। তখন মহকুমা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সেন্টু মিয়া। সরকারি সাহায্য ছাড়াই স্থানীয়দের উদ্যোগে মাঠের উন্নয়ন হয় ১৯৭৩ সালে। ১৯৯৩ সালে কাজ শুরু হয় এ মাঠ স্টেডিয়ামে রূপান্তরের। পৌরসভার মাঠের সঙ্গে স্টেডিয়ামের জন্য মুন্সীগঞ্জ হাই স্কুলের অনেক জায়গারই দখল নেওয়া হয় এ জন্য। ঐতিহাসিক ‘বড় মাঠ’ অবিকৃত রেখে সার্কিট হাউসের পাশে থাকা জমিতে স্টেডিয়াম করার জন্য দাবি উঠলেও লাভ হয়নি তাতে। তবে স্টেডিয়ামের গ্যালারি আর প্যাভিলিয়ন নিম্নমানের হওয়ায় এগুলোর পেছনের অংশ দোকান হিসেবে ব্যবহার করাও কঠিন হয়ে পড়ে। এখন যে নামেই ডাকা হোক ১৯৭৮ সালে এশিয়ান গেমসের বাছাই পর্বের অনূর্ধ্ব-১৮ জাতীয় দলের প্রদর্শনী ম্যাচ হয় এ মাঠে। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৩—তিন বছর অনুষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশের আলোচিত ‘কালিপদ দাস স্মৃতি ফুটবল টুর্নামেন্টে’। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান, ওয়ান্ডারার্স, ওয়ারী ও ভিক্টোরিয়া ক্লাবের পুরো শক্তির দল খেলে গেছে এ টুর্নামেন্টে। কৃতী ফুটবলার স্বপন দাসের বাবার নামে হতো এ টুর্নামেন্ট। স্বাধীনতার আগে ‘বিক্রমপুর শিল্ড’ পুরো বাংলায় ছিল আলোচিত ফুটবল টুর্নামেন্ট। ধারণা করা হয়, বৈদিক যুগ থেকে ভাওয়াল ও সোনারগাঁ রাজধানী হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার আগে বিক্রমপুরই ছিল বাংলার প্রাচীনতম রাজধানী।

চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের দশকে ফুটবলে মন্মথ মুখোপাধ্যায়, আইজি রকিব খন্দকার, কালিপদ ধর, কালিপদ দাস, লোকমান, শিবু, আকরাম, নুরুল ইসলাম অনু মিয়া, নুরুদ্দিন চৌধুরী অনু, আবুল বাশার, পোক্রা দাস, সবদর আলীরা উঠে এসেছেন মুন্সীগঞ্জ থেকে। ষাটের দশকে ছিলেন আরজান খান, প্রভাত দাস, প্রদ্যুৎ দাস, প্রতাপ শংকর হাজরা, নজরুল ইসলাম, নারু চক্রবর্তী, সুভাষ কর্মকার, ছাবেদ, সাবের। সত্তরের দশকে সুনাম অর্জন করেছেন মাসুম চৌধুরী, কিসলু, খোকা, পিকলুস, রশিদ, অভয় সাহা, ইস্টঅ্যান্ডের কাপ্টেন ফিরোজ। আশির দশকে জাতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন স্বপন দাস। জাতীয় পর্যায়ে আলো ছড়িয়েছেন তারিক কাসেম খান মুকুল, আরিফ, আশরাফ, বাচ্চু, শঙ্কর দাস মুকুল, মইন কাদের রবিন, বাহারুল আলমরা। নব্বইয়ের দশকে মিজানুর রহমান ডন, রোকনুজ্জামান কাঞ্চন, মিলনদের পর সেভাবে উঠে আসেনি কেউ।

সাত বছর আগে সর্বশেষ জাতীয় দলে খেলেছিলেন তারেক। ক্রিকেটে গাজী আশরাফ হোসেনের (লিপু) মতো তারকা উপহার দিয়েছে মুন্সীগঞ্জ। তবে গাজী আশরাফ হোসেনের পর জাতীয় দলে আর কেউ নেই এ জেলার। যদিও ক্রিকেট লিগ মোটামুটি নিয়মিত এখানে। একটা সময় হতো শুধু প্রথম বিভাগ ক্রিকেট। এরপর যোগ হয়েছে প্রিমিয়ার ক্রিকেট। এ বছর থেকে দ্বিতীয় বিভাগও চালু হয়েছে মুন্সীগঞ্জে। এ লিগগুলো করতে হিমশিম খাওয়ার কথাটা এড়ালেন না জেলা ক্রীড়া সংস্থার তিন দশকের বেশি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা নজরুল ইসলাম, ‘১০টা ক্লাবের জন্য অন্তত ২০০ ক্রিকেটার দরকার। ফুটবলেও ব্যাপারটা একই। এত বেশি খেলোয়াড় আমাদের ছোট জেলায় পাওয়া কঠিন। তাই ক্রিকেটে একটি দলে তিন-চারজন বাইরের খেলোয়াড় রাখার নিয়ম করতে হয়েছে। তেমন পৃষ্ঠপোষক না থাকায় লিগগুলো করা খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। তবে বিসিবির অর্থায়নে স্কুল আর বয়সভিত্তিক ক্রিকেট নিয়মিত আমাদের জেলায়।’ খো খো-তে বেশ সুনাম আছে এ জেলার মেয়েদের। সর্বশেষ জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জিতেছে তারাই। সব মিলিয়ে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে মুন্সীগঞ্জ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ছয়বার।

সর্বশেষ বাংলাদেশ গেমসের শিরোপাও তাদের। তবে ছেলেদের দল শিরোপা জেতেনি একবারও। এ নিয়ে জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক ঢালী জানালেন, ‘মুন্সীগঞ্জের মেয়েদের দলের দায়িত্বটা থাকত আমারই। তবে আমি ছেলেদের দলটা গড়ি ঢাকা জেলার। আর ঢাকা ছেলেদের খো খো-তে সব সময় সমীহ জাগানিয়া দল।’ এখানকার সমস্যা অবশ্য মাঠ সংকট। স্টেডিয়াম ছাড়া প্রতিযোগিতামূলক খেলার জন্য মানসম্পন্ন মাঠ নেই। এমনকি শ্রীনগর ছাড়া উপজেলাগুলোতেও জেলা ক্রীড়া সংস্থার নিজস্ব মাঠ নেই। এরই মধ্যে গড়ে উঠেছে দুটি ক্রিকেট একাডেমি। একটি মুন্সীগঞ্জ জেলা ক্রিকেট একাডেমি, অন্যটা রিকাবী বাজার ক্রিকেট একাডেমি। সাঁতারে ব্রজেন দাস, মোশাররফ হোসেনের মতো তারকা থাকায় একটি সুইমিংপুলও পেয়েছে মুন্সীগঞ্জ।

২০০০ সালের দিকে গড়ে ওঠা এ সুইমিংপুল ঘিরে স্বপ্ন থাকলেও আর সেভাবে উঠে আসেনি তেমন সাঁতারু। তবে জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি ও মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক সাইফুল হাসান বাদল আশাবাদী জেলার ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে, ‘এ জেলা থেকে অনেক কৃতী খেলোয়াড় জাতীয় দলে সুযোগ করে নিয়েছেন। পেয়েছেন জাতীয় পুরস্কার। তবে ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়েছে ক্রীড়াঙ্গন। উঠতি বয়সের তরুণরা এখন প্রবাসমুখী। জেলা ক্রীড়া সংস্থা ও জেলা প্রশাসন চেষ্টা করছে এ জেলায় আবারও খেলার ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে। তারই ধারাবাহিকতায় কিছু কিছু প্রতিযোগিতামূলক খেলা আবারও চালু করা হয়েছে। জেলাটিতে ধনাঢ্য ব্যক্তিতে ভরপুর। প্রশাসনের পাশাপাশি তারাও এগিয়ে এলে উন্নতির ধারায় ফিরবে মুন্সীগঞ্জ।’

ফেইসবুকে আমরা
ইউটিউবে আমরা
error: দুঃখিত!