জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা ছিলেন বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। তার ছোট ভাই মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান। তার কনিষ্ঠপুত্র হাজ্বী মোহাম্মদ ফয়সাল বিপ্লব মুন্সিগঞ্জ শহর পৌরসভার অা.লীগ মনোনিত নির্বাচিত মেয়র।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সময় তিনি ছিলেন তার সরকারি বাসভবন সোনালিতে।
বঙ্গবন্ধু কে নিয়ে তার অাবেগঘন কিছু স্মৃতিচারণ পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলোঃ
১৫ আগস্টের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ১৭ বা ১৮ আগস্ট নাগাদ ড. মসিউর রহমান ও মনোয়ারুল ইসলামের ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়ার জন্য বিদেশ যাওয়ার কথা ছিল। সেই উপলক্ষে তারা ১৪ আগস্ট রাতে গণভবনে ডিনারের আয়োজন করেন। ডিনার শেষে বঙ্গবন্ধু উপস্থিত বেশ কয়েকজন অতিথির সঙ্গে গল্প করছিলেন। পর দিন ১৫ আগস্ট সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল। ওই ভাষণের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুকে বাসায় নিয়ে যেতে মহিউদ্দিনকে তাগিদ দেন ড. মতিন চৌধুরী।
এ সময় মহিউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর পেছনে গিয়ে দাঁড়ান। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোনো সাড়া দিলেন না। মহিউদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধুর পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেই তিনি বুঝতেন তার যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু সেদিন তিনি কোনো সাড়া না দেওয়ায় আমি ফিরে এলাম। মতিন চৌধুরী আবারও আমাকে যেতে বললেন। আমি আবারও গেলাম। বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত তামাকের প্যাকেট, পাইপ ও ম্যাচ গোছানো শুরু করলাম। তিনি আমাকে ধমক দিলেন। আমি ফিরে এলাম। এবার মতিন চৌধুরী নিজে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আগামীকাল আপনার ভাষণ দেওয়ার কথা, প্রস্তুতি নিতে হবে না? বঙ্গবন্ধু জবাব দেন, আপনিও আমার পিছে লেগেছেন। এ কথা বলেই তিনি উঠে দাঁড়ান। মহিউদ্দিন বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নম্বর বাড়িতে পেঁৗছে দেন।
৩২ নম্বর বাড়ি থেকে আবার ডিনার অনুষ্ঠানে যান মহিউদ্দিন। সেখানে গিয়ে তিনি ডিনার শেষে বাসায় ফেরার সময় তোফায়েল আহমেদ তাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আবার যেতে বললে প্রথমে তিনি যেতে চাননি। কারণ বঙ্গবন্ধু তাকে আবার দেখলে ক্ষেপে যেতে পারেন। শেষ পর্যন্ত তোফায়েল আহমেদের চাপের মুখে তিনি আবার ওই বাড়িতে যান। মহিউদ্দিন বলেন, তোফায়েল আহমেদ, ফরাস উদ্দিন আহমেদ, কাজী গোলাম মোস্তফাসহ অনেকেই সেই রাতে ঘড়ির কাঁটায় ১২টা পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা সেরে চলে আসেন। আমিও আমার সরকারি বাসভবন সোনালিতে ফিরে আসি। আমি যথানিয়মে বাসায় শুয়ে পড়ি।
সে সময় আমার সঙ্গে ছিলেন মুন্সীগঞ্জের ডা. ইকবাল, আমার সহকারী সঞ্জয়। শেষ রাতে গোলাগুলির শব্দে সঞ্জয় আমাকে ঘুম থেকে ডেকে উঠায়। গোলাগুলির শব্দ ক্রসফায়ারের মতো লাগছিল। আমি ভাবলাম, জাসদের ছাত্ররা বঙ্গবন্ধুকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে দেবে না বলে হয়তো ফাঁকা গুলি করছে। এর কিছুক্ষণ পরেই বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশী সেলিনা হক আমাকে ফোন করেন। আমাকে বঙ্গবন্ধুর বাসায় গ্রেনেড হামলার কথা জানান। আমি বিচলিত হয়ে পড়ি। বিভিন্ন জায়গায় ফোন করে খবর নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু সে রাতে সঠিক কোনো তথ্যই পেলাম না। সকাল ৮টায় ডা. ইকবালকে সঙ্গে নিয়ে আমার মোটরবাইকযোগে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়ির দিকে রওনা দিই। সঙ্গে আমার নাইন এমএম পিস্তল ছিল। ২৭ নম্বর রোডের ধানমন্ডি বয়েজ হাইস্কুলের সামনে গেলেই একদল লোক আমাকে থামিয়ে দেয়। তারা আমাকে ্বঙ্গবন্ধুর দেহরক্ষী হিসেবে চেনে। তাদের বাধা উপেক্ষা করে সামনের দিকে এগোতে থাকি। কিছুদূর এগোলেই প্রচণ্ড গোলাগুলির ধোঁয়ায় পথ দেখা যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে আমি পিছুটান হই।
এরপর আমি আমার সরকারি বাড়ি সোনালিতে ফিরে আসি। আসার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা কান্নায় ভেঙে পড়ে। সে রেডিওর মাধ্যমে জানতে পেরেছে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর। বঙ্গবন্ধুর কথা বলতে গিয়ে মহিউদ্দিন কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেলফোনে কথা বলতে গিয়ে আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা মহিউদ্দিন বলেন, সেদিন ছিল ৬ মার্চ। পর দিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন বঙ্গবন্ধু। পূর্ব-প্রস্তুতির জন্য সিরাজুল আলম খান, আ স ম আবদুর রব বঙ্গবন্ধুকে পরামর্শ দিতে চাইলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কারও পরামর্শ নিতে চাননি। পরামর্শদাতারা চেয়েছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে ৭ মার্চে আওয়ামী লীগের পক্ষে স্বাধীনতার ডাক দিতে। পর দিন ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সাদামাটা ভঙ্গিতে মঞ্চে উঠলেন। তার পেছনেই ছিলাম আমি। কোনো রকম বিচলিত দেখা যায়নি তাকে। অবিচল ভঙ্গিমায় মঞ্চে উঠে শুরু করলেন_ এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। ঐতিহাসিক ওই ভাষণ শেষে বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে নিয়ে গেলাম। এরপর অনেক পটপরিবর্তন ঘটে। দেশ স্বাধীন হলো। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব এলো বঙ্গবন্ধুর কাঁধে। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন দেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুকে অপরিসীম পরিশ্রম করতে হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক। দেশের জন্য দিন-রাত খাটতেও তিনি ক্লান্তিবোধ করতেন না।
মহিউদ্দিন বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে কোন কোন বিশ্বাসঘাতক জড়িত ছিল তা সবার জানা। এদের পালের গোদা খন্দকার মোশতাক। তাকে নিয়ে একটা ঘটনার কথা বলি। গল্পের মতো হলেও যা সত্যি। জাতির জনক একদিন বঙ্গভবনের লেকের পাড়ে দাঁড়িয়ে মাছের জলকেলি দেখছিলেন। এ সময় দূরে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে অপলক চোখে দেখছিলাম। ঠিক কিছু পর খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর পেছনে এসে দাঁড়ালেন। এমন সময় হঠাৎ লেকের মাছগুলো জলকেলি বন্ধ করে দিল। ডুব দিল পানির গভীরে। বঙ্গবন্ধু পেছনে তাকিয়ে দেখেন খন্দকার মোশতাক দাঁড়িয়ে। এ সময় মোশতাকের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু মন্তব্য করলেন_ ‘কী রে কুটি মিয়া। আরে কুটি মিয়া, মাছেও তোরে চেনে।…’ এ কথায় বঙ্গবন্ধু হয়তো বোঝাতে চেয়েছিলেন খন্দকার মোশতাক আসলে বেইমান প্রকৃতিরই একজন মানুষ।