মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসা পাঁচ কিশোরের বর্ণনায় সুন্দর জীবনের আশায় সমুদ্রপথে অবৈধ বিদেশযাত্রার নির্মম কাহিনী উঠে এসেছে। সাগরে ও মিয়ানমার নৌবাহিনীর ক্যাম্পে ছোলা, কলা গাছের বাদাল (শাঁস), বাঁশের কচি ডিগ (সবজি হিসেবে ব্যবহৃত বিশেষ বাঁশ) ও কাঁচা শুঁটকি খেয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছে নারায়ণগঞ্জের পাঁচ কিশোর। পানি চাইলে নেমে আসত অত্যাচারের খড়গ। প্যান্টের বেল্ট ও লোহার রড দিয়ে মারধর করা হতো। শব্দ করলেও পেটানো হতো। তিন মাস জাহাজে গাদাগাদি করে থাকতে হয়েছে। দুই মাস মিয়ানমারের ক্যাম্পেও সহ্য করতে হয়েছে নির্যাতন। বুধবার দেশে ফিরে নারায়ণগঞ্জ রেড ক্রিসেন্ট কার্যালয়ে নির্যাতনের বর্ণনা দেয় ওই পাঁচ কিশোর। সোনার হরিণ ধরতে গিয়ে পাঁচ মাসের প্রতিটি মুহূর্তেই তারা ছিল জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। কিশোর আবু হানিফা জানায়, আমাদের এক দালালের কাছে বিক্রি করে দিল আর আমরা হাটের পশুর মতো চেয়ে রইলাম, কিছু করার ছিল না। সে জানায়, আমাদের তিন মাস সাগরের মধ্যে ভাসমান রেখেছে, বোটের উপরতলায় বাচ্চাসহ ১৮ জন বাঙালি নারী ও ৪০ জন মিয়ানমারের নারী ছিল। অত্যাচার সইতে না পেরে তাদের গগনবিদারী চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠত। পরে জানতে পেরেছি, জাহাজের লোকজন ওইসব নারীকে ধর্ষণ করত। অনেক শিশুকে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে পাষণ্ডরা।
কিশোর নাঈম জানায়, প্রতিদিন আমাদের একমুঠো ভাত, তিনটা শুকনা মরিচ আর দুইটা কাঁচা শুঁটকি দিয়ে দিনে একবার ভাত খেতে দিত। না খেলে বেল্ট নতুবা চাবুক দিয়ে মারত। কিশোর সুমন জানায়, জাহাজে আমাদের সঙ্গে থাকা নরসিংদীর এক লোক অসুস্থ হয়ে মারা যায়। পরে পলিথিনে পেঁচিয়ে পেট কেটে তার লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হয়।
মৃত্যুকূপ থেকে ফেরত আসা মোঃ সেলিম বলেন, গার্মেন্টে কাজ করতাম। এলাকার মানব পাচারকারী আলামিন বলেছে, মালয়েশিয়া গেলে অনেক বেশি টাকা আয় করতে পারবি। বিদেশ যেতে টাকাও লাগবে না। আলামিন নিজের টাকায় বিদেশ পাঠাবে। পরে টাকা পরিশোধ করতে হবে। এতে তাই রাজি হই। বাবা মোঃ জলিল ফার্নিচার দোকানের মজুর। মা মোসাঃ চন্দু বেগম গৃহিণী। চার ভাইয়ের মধ্যে সেলিম দ্বিতীয়। মৃত্যুকূপ সম্পর্কে সেলিম বলেন, প্রথমে রূপগঞ্জ থেকে নরসিংদী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার হয়ে টেকনাফ থেকে জাহাজে ওঠানো হয়। জাহাজে আমাদের সবাইকে মারধর করা হয়। কেউ বাথরুম করতেও নড়াচড়া করতে পারেনি। ঠায় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। কেউ কোনো কথা বলতে পারত না। প্রথমে প্যান্টের বেল্ট দিয়ে মারত। পরে লোহার চিকন রড দিয়ে আঘাত করত। কয়েকজনের চোখ গুঁতো দিয়ে নষ্ট করে ফেলেছে। আবার কয়েকজনের হাত, পা ও কোমর ভেঙে ফেলেছে। মিয়ানমার শিবিরে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে পরে ভালো হয়েছে।
মৃত্যুকূপ থেকে ফিরে আসা সুমন মিয়া বলেন, স্থানীয় মামুন দালাল ওরফে মামুন হারবাল নামে বেশি পরিচিত। মালয়েশিয়ায় অনেক টাকা আয় করার প্রলোভন দেখিয়ে সে তাকে রাজি করায়। এরপর নিয়ে যায় নরসিংদীর নুর আলমের কাছে। তার কাছে নিয়ে যাওয়া হয় ১১ জনকে। ছয়জনকে কোথায় পাঠিয়েছে জানি না। বাকি পাঁচজনকে চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া হয়। পরে টেকনাফ নিয়ে দালালের কাছে তাদের ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দেয় সে। আমাদের বলে কথা বলবি না। বিদেশ যাওয়ার যাবি। মালয়েশিয়া ভালো কাজ পেলে টাকা দিয়ে দিবি। জাহাজে ওঠানোর সময় বলে কথা বললে মেরে সাগরে ফেলে দেব। প্রতিদিন খুব মারধর করত। কেউ কোনো কথা বললেই মারধর শুরু করত। তাদের ভাষাও কেউ বুঝতে পারে না। তারাও আমাদের ভাষা বোঝে না। শব্দ করলেই মারধর। দিনে দুই বেলা খাবার দিত। সকালে একবার অল্প সাদা ভাত ও কাঁচা শুঁটকি। বিকালেও সাদা ভাত ও শুঁটকি; কিন্তু ওই সময় পানি দিত না। খাওয়ার অনেকক্ষণ পর অল্প পানি দিত। কেউ পানি চাইলে মেরে রক্ত বের করত। ভয়ে কেউ কিছুই বলত না। সব সময় মারত। জাহাজের নিচ থেকে কেউ ওপরে উঠতে চাইলে মেরে হাত-পা ভেঙে দিত। ১৫ দিন তো ভাতও দেয়নি, চাল খেয়ে বেঁচেছিলাম। একসঙ্গে প্রায় ৭৫০ থেকে ৮০০ জন ছিলাম জাহাজে। ইলিশ মাছের মতো সোজা করে ফেলে রাখা হতো। একজনের গলায় ভাত আটকে গেলেও পানি দেয়নি। পানির জন্য কাতরাতে থাকলে ওরা গলায় পারা দিয়ে ধরে। পরে রড দিয়ে মারতে থাকে। পরে ওই ছেলে মারা যায়। তার লাশ সাগরে ফেলে দিয়েছে। তাদের জাহাজের মাঝি বাংলা বলতে পারত। পরে সেও আমাদের ফেলে পালিয়ে চলে আসে। আমরা বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে চেয়েছিলাম। ওরা তখন বলে, ১০ টাকা দিয়ে কিনে ৩ টাকায় ফেরত দেব না। তোদের মাইরা সাগরে ফেলে দেব। একজনকে মেরে চোখ নষ্ট করে দিয়েছে। পরে নৌবাহিনী আটক করলে কিছুটা ভালো ছিলাম।