৩০ মে, ২০২০, (আমার বিক্রমপুর)
৩০ মে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী। ১৯৮১ সালের এই দিনে চট্টগ্রামে এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টায় জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছিলেন। জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার ৩৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত জিয়াউর রহমান হত্যার মূল রহস্য যেমন উদঘাটিত হয়নি, তেমনি বেসামরিক আদালতে জিয়া হত্যার বিচারও হয়নি।
আওয়ামী লীগ যেমন ১৯৭৫ এর পর থেকে জাতির পিতা হত্যার বিচারকে তাদের প্রধান রাজনৈতিক এজেন্ডা হিসেবে রেখেছিল এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের যে বাধাগুলো, সে বাধাগুলোকে রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে অপসারিত করেছিল এবং ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করার মাধ্যমে প্রচলিত আইনে জাতির পিতা হত্যার বিচার করেছিল। কিন্তু বিএনপি সেই পথে যায়নি। বরং বিএনপির রাজনীতিতে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারকে ধামাচাপা দেওয়ার এক অদ্ভুত প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
প্রতিবছর জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকীতে তারা জিয়ার সৈনিক হওয়ার স্লোগান দেয় এবং জিয়ার কবরে গিয়ে দোয়া মাহফিল করে। কিন্তু জিয়া হত্যার মূল রহস্য কী ছিল, সেই হত্যার বেসামরিক বিচার কিভাবে সম্পন্ন হবে তা নিয়ে কোন কথাবার্তা বলে না। বিএনপির এই অনীহা কেন?
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানকে চট্টগ্রামে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পর পাদপ্রদীপে আসেন হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এবং এরশাদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা জেনারেল মঞ্জুরের নেতৃত্বে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেছে। এরশাদ সে সময় জিয়াউর রহমানের হত্যার বিচারের নির্দেশনা দেন সেনাপ্রধান হিসেবে। ঐ নির্দেশনায় মুক্তিযোদ্ধা অনেক সেনা কর্মকর্তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এমনকি তৎকালীন চট্টগ্রামের জিওসি জেনারেল মঞ্জুর যখন ঢাকা আসছিলেন আত্মসমর্পণ করার জন্য, সেসময় তাকে আটক করা বা প্রচলিত আইনে তার বিচার না করে তাকেও নির্মমভাবে হত্যা করে এই হত্যা ষড়যন্ত্রের শেষ নিশানাটুকু উপড়ে ফেলা হয়।
সে সময় বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন যে, জিয়াউর রহমানের হত্যার তদন্ত করতে হবে এবং বেসামরিক আদালতে হত্যার বিচার করতে হবে। বেগম জিয়ার এই দাবি আরো জোরদার হয় যখন এরশাদের বিরুদ্ধে ১৯৮৩ সাল থেকে আন্দোলন শুরু করেন। তখন তিনি এরশাদকেই জিয়াউর রহমানের ঘাতক হিসেবে চিত্রিত করেন এবং বলেন যে এরশাদের ষড়যন্ত্রেই জিয়াউর রহমান নিহত হয়েছিলেন। যদিও হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন।
মূলত জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডে সেনাবাহিনীতে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি এবং মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বন্দের কথাই আলোচনা করা হয় এবং মনে করা হয় জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে যেভাবে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন এবং সেনাবাহিনীতে যেভাবে পাকিস্তান ফেরতদেরকে ভালোভাবে পোস্টিং দিচ্ছিলেন, তাতেই মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা ক্ষুব্ধ হয়ে জিয়াউর রহমানকে হত্যা করেছিল। কিন্তু বিষয়টি এতো সরলকৃত নয় বলে মনে করেন গবেষকরা। বিশেষ করে জিয়াউর রহমান যখন চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে নিহত হন, সেসময় সার্কিট হাউজের অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরী, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার মতো বিএনপির হেভিওয়েট নেতারাও উপস্থিত ছিলেন, তাদের গায়ে আঁচড়টি লাগেনি কেন? এই হত্যাকাণ্ডটি শুধুই কিছু সংক্ষুব্ধ সামরিক কর্মকর্তার হঠকারিতা ছিল? নাকি এর পেছনে সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ছিল? সেই বিষয়টি নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনরকম অনুসন্ধান-গবেষণা হয়নি এবং বিএনপির পক্ষ থেকে এই নিয়ে কোন বেসামরিক বিচার ব্যবস্থার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, জিয়া হত্যার পর বিএনপির যে রাজনৈতিক ধারা, সেই রাজনৈতিক ধারায় হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যারা যুক্ত তারা বিভিন্নভাবে সুবিধা পেয়েছেন। আর এ কারণেই এই হত্যাকাণ্ডে কার কি ভূমিকা ছিল তা জানা প্রয়োজন। কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এই হত্যাকাণ্ডে কেবল ফায়দা লুটতে চেয়েছে। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে চায়নি। এর মাধ্যমে বিএনপি প্রমাণ করেছে যে তারা বিচারহীনতার সংস্কৃতিতেই বিশ্বাস করে এবং সেটাকেই ধারণ করতে চায়।