একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের ‘নির্বাচনী প্রচার’ শুরু হয়েছে সিলেট থেকে।
ভোটের বছরের শুরুতে মঙ্গলবার সিলেটে গিয়ে তিন আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করে জনসভায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
সিলেট আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে বিকালের এই জনসভায় শেখ হাসিনা বলেন, “আমাদের নির্বাচনী প্রচার চালানো এখান থেকেই শুরু।”
বাংলাদেশকে উন্নত দেশে উন্নীত করার লক্ষ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “এ লক্ষ্য পূরণ করতে হলে আগামী ডিসেম্বর মাসে যে নির্বাচন হবে সেই নির্বাচনে আমরা আপনাদের কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চাই।”
নৌকা মার্কায় ভোট দিতে জনসভায় আগত সবাইকে হাত তুলে ওয়াদা করার আহ্বান জানান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী।
“আপনারা হাত তুলে ওয়াদা করেন নৌকা মার্কায় ভোট দেবেন।”
মাঠভরতি মানুষ হাত তুলে শেখ হাসিনার কথায় সায় দেন।
আওয়ামী লীগ আয়োজিত এই জনসভায় সরকারি ৩৫টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রীর এভাবে ভোট চাওয়ার সমালোচনা করে আসছে বিএনপি। দলটির নেতা মওদুদ আহমেদ মঙ্গলবারই বলেছেন, নির্বাচন কমিশনের উচিৎ হবে সরকারি দলের এই প্রচারণা বন্ধ করে দেওয়া।
আওয়ামী লীগের পক্ষে ভোট চেয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “অতীতে নৌকায় ভোট দিয়েছেন। নৌকায় ভোট দিয়েছিলেন বলেই আন্তর্জাতিকভাবে দেশের সুনাম হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হয়েছে।”
বিএনপির সমালোচনা করে তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগের চিন্তা-চেতনা আর ওদের চিন্তা-চেতনার তফাতটা আপনারাই বুঝতে পারেন।
“যারা এতিমের টাকা মেরে খায়, যারা জনগণকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারে, তারা দেশকে ধ্বংস করতে জানে, দেশের মানুষকে ধ্বংস করতে জানে। তারা কীভাবে একটা দেশকে উন্নত করবে?”
টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর সিলেটে শেখ হাসিনার তৃতীয় সফর এটি। এ উপলক্ষে পুরো শহর সাজানো হয় ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন, বিলবোর্ড আর তোরণে।
জনসভায় যোগ দিতে সিলেট ও আশেপাশের জেলাগুলো থেকে জনসমাগম ঘটে।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তার বক্তব্যের শুরুতেই সিলেটের প্রয়াত রাজনীতিক আবদুস সামাদ আজাদ, হুমায়ূন রশীদ চৌধরী, শাহ এ এম এস কিবরিয়া, দেওয়ান ফরিদ গাজী ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে স্মরণ করেন।
বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে ২০০৫ সালের শুরুতে হবিগঞ্জে নিজ নির্বাচনী এলাকায় গ্রেনেড হামলায় নিহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী কিবরিয়া, ২০০৪ সালে যুক্তরাজ্যের তৎকালীন রাষ্টদূত আনোয়ার চৌধুরী এবং বদর উদ্দিন আহমেদ কামরানের উপর গ্রেনেড হামলার কথাও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
দশম জাতীয় সংসদ বানচাল করতে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভোট কেন্দ্রে আগুন দেওয়াসহ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডের কথাও বলেন শেখ হাসিনা।
২০১৩, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলনের সময়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তারা প্রায় ৫০০ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। হাজার হাজার গাড়ি পুড়িয়েছে। তিন হাজার মানুষ তাদের অগ্নিসন্ত্রাসে অগ্নিদগ্ধ হয়েছে।
“পোড়া মানুষের লাশ দেখে খালেদা জিয়া উৎফুল্ল হয়েছে। বিএনপি ধ্বংস করতে জানে, সৃষ্টি করতে জানে না।”
আওয়ামী লীগ আমলের বিভিন্ন খাতের উন্নয়নচিত্র তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা মানে উন্নয়ন। আর, বিএনপি আসা মানেই ধ্বংস। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশ পুরস্কৃত হয়, আর বিএনপি থাকলে তিরস্কৃত হয়।”
সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা, বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক করা এবং বিভিন্ন অবকাঠামোসহ সিলেটের উন্নয়নে নেওয়া নানা পদক্ষেপও জনসভায় তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না আসলে দেশের এত উন্নয়ন হত না। লুটেরা আসলে লুটেপুটে খেত।”
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধ করে শান্তি বজায় রাখতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ‘হাত মিলিয়ে’ চলতেও জনগণের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
সকালে সিলেটে পৌঁছে সরাসরি শহরের দরগাহ মহল্লায় যান শেখ হাসিনা। সেখানে তিনি হজরত শাহজালালের মাজার জিয়ারত ও মোনাজাত করেন।
শাহজালালের মাজার থেকে শেখ হাসিনা যান শহরের প্রান্তে খাদিম নগরে, হজরত শাহপরাণের মাজারে। এরপর সুরমা পারের কুশিঘাট এলাকায় গিয়ে হজরত গাজী বুরহান উদ্দীনের মাজার জিয়ারত করেন তিনি।
তিন মাজার জিয়ারত শেষে সিলেট সার্কিট হাউজে যান প্রধানমন্ত্রী। সেখানে নামাজ ও মধ্যাহ্ন বিরতির পর আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে আওয়ামী লীগের জনসভাস্থলে পৌছান।
জনসভার শুরুতেই প্রকল্প উদ্বোধন ও ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী।
হজরত গাজী বুরহান উদ্দিনের মাজার উন্নয়ন, নারীদের জন্য ইবাদতখানা নির্মাণ, মাজারের সৌন্দর্য বর্ধন এবং মাজারের যাতায়াতের প্রধান রাস্তা প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন, সিলেট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের নতুন অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক ভবন, পিরোজপুরে সার পরীক্ষাগার ও গবেষণাগার ভবন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জেলা অফিস, সিলেট বিভাগীয় ও জেলা এনএসআই কার্যালয় ভবন, সিলেট মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন, জকিগঞ্জ উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
ভিত্তিফলক উন্মোচন করেন হজরত শাহজালালের মাজারে নারীদের জন্য ইবাদতখানা ও অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রম, শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেসা হল নির্মাণ, গোয়াইনঘাট উপজেলা পরিষদ ভবন ও হলরুম নির্মাণ, ওসমানী মেডিকেল কলেজে ছাত্র ও ছাত্রীদের দুটি হোস্টেল ভবন নির্মাণ, ২৫০ শয্যার জেলা হাসপাতাল নির্মাণ, ওসমানী মেডিকেলের নার্সিং হোস্টেল ভবন নির্মাণ, সিলেট পুলিশ লাইনসে ব্যারাক ও অস্ত্রাগার নির্মাণ, কোতোয়ালি মডেল থানা কম্পাউন্ডে ডরমিটরি ভবন নির্মাণ, তামাবিল ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট ভবন, সিলেটের লালাবাজারে রেঞ্জ রিজার্ভ পুলিশ লাইনস নির্মাণ, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য হোস্টেল নির্মাণসহ বেশ কিছু প্রকল্পের।
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি লুৎফর রহমানের সভাপতিত্বে জনসভায় আরও বক্তব্য দেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ও দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ, দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আবদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন ও মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, কার্যনির্বাহী সদস্য ও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদরউদ্দিন আহমেদ কামরান, অর্থ প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ, যুব মহিলা লীগের সভাপতি নাজমা আক্তার, ছাত্রীলগের সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন।
উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম, তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও তারিক আহমেদ সিদ্দিক, আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম, খালিদ মাহমুদ চৌধুরী ও মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, বন ও পরিবেশ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, উপ-দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া এবং কাযনির্বাহী সংসদের সদস্য এস এম কামাল হোসেন, ইকবাল হোসেন অপু, সংসদ সদস্য শেখ হেলাল প্রমূখ।
এছাড়া প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব নজিবুর রহমান, সামরিক সচিব মিয়া মোহাম্মদ জয়নুল আবেদীন, প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, সহকারী একান্ত সচিব সাইফুজ্জামান শিখর উপস্থিত ছিলেন।