মুন্সিগঞ্জ ২১ ডিসেম্বর, ২০১৯, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জ সদরের শালিমা বেগম সৌদি আরবে বিভিন্ন ভোগান্তি, নির্যাতন আর মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দেশে ফিরে চেষ্টা করছেন স্বাবলম্বী হওয়ার। এতে তাকে সহযোগিতা করছে মুন্সিগঞ্জে কর্মরত নিরাপদ অভিবাসন আন্দোলনের সাথে যুক্ত একটি বেসরকারি সংস্থা।
অভাব অনটনের সংসারে উন্নত ভবিষৎয়ের আকাঙ্খা ও আর্থিক অনটন কাটাতে ২০১৬ সালে সৌদি আরবে যান মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার পঞ্চসার ইউনিয়নের ডিঙ্গাভাঙ্গা এলাকার শালিমা (৫০)।
শালিমা আক্তারের সাথে একান্ত আলাপে উঠে আসে তার জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতার বর্ণনা।
শালিমা’র স্বামীর ছিল এটি দ্বিতীয় বিয়ে। তাই বিয়ের পর থেকেই শালিমা বেগমের কোন সুখ ছিল না, অশান্তির মূল ছিল স্বামী। তিনি কোন কাজ করতেন না। ছোট একটি মুদি দোকান চালিয়ে সংসার চলতো।
এতগুলো ছেলে মেয়েকে মানুষ করা, বিয়ে দেওয়া পুরোটাই শালিমার দায়িত্বে। এর মধ্যে ছেলেরা কথা শুনে না, স্বামীও অসুস্থ। অন্যদিকে স্বামী বলে বিদেশ যাও।
এলাকার দালাল মোস্তফা তাকে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। শালিমা সেই দালালের মাধ্যমে ২৫,০০০/- (পঁচিশ হাজার) টাকা খরচ করে ২০১৬ সালের ১৯ অক্টোবর গৃহকর্মীর কাজের ভিসা নিয়ে সৌদি আরবে যান। কিন্তু দালাল মোস্তফা তাকে কোন চুক্তিপত্র সরবরাহ করেনি। বেতন সম্পর্কেও দালাল নির্দিষ্ট কোন তথ্য দেন নি, কখনো বলেছেন ২০,০০০ টাকা, আবার কখনো বলেছেন ১৬,০০০ টাকা।
শালিমা বেগমের নিয়োগকর্তাও তাকে নির্দিষ্ট অঙ্কের কোন বেতন দেননি। কখনো তাকে দেওয়া হয়েছিলো ১২ হাজার, আবার কখনো ১৪ হাজার টাকা।
এর মধ্যে নিয়োগকর্তার মন চাইলে বেতন দেওয়া বন্ধ করে দিতেন। বেতনের জন্য শালিমা তাগিদ দিলে নিয়োগকর্তা তাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিতেন, শালিমা ভয়ে চুপ হয়ে যেত।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় শালিমা বেগমের কোন রোগ ধরা পড়েনি। সৌদি আরব যাওয়ার পর থেকেই নিয়োগকর্তা শালিমাকে দিয়ে তিন বাসায় কাজ করতেন। শারীরিক নির্যাতনের ভয়ে বিনা প্রশ্নে শালিমা বেগম কাজ চালিয়ে যান।
এরই মধ্যে একদিন নিয়োগকর্তার সাথে নিয়োগকর্তার মায়ের ঝগড়া হয়। বিষয় ছিল শালিমা। মূলত নিয়োগকর্তার মা চাচ্ছিলেন শালিমা যেন শুধু তার বাসাতেই কাজ করে, অন্যদিকে নিয়োগকর্তা চাচ্ছিলেন একজন গৃহকর্মীকে দিয়েই বাসার সব কাজ করাতে।
অবস্থার অবনতি হলে নিয়োগকর্তা শালিমাকে মকতবে রেখে আসেন। সেখান থেকে তাকে কাজের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয় অন্য বাসায়।
দ্বিতীয় নিয়োগকর্তার বাসায় শালিমা বেগম প্রথম থেকেই প্রচন্ড কষ্টের মধ্যে বাস করতে থাকেন।
তিনি জানান, নিয়োগকর্তার স্ত্রী তার সাথে রীতিমতো অমানবিক আচরন শুরু করেন। এখানেও তাকে একের অধিক বাসায় কাজ করানো হতো।
নিয়োগকর্তার স্ত্রী রোজ সকালে শালিমাকে তার বোনের বাসায় কাজের জন্য নিয়ে যেতেন। সেখানে সারাদিন কাজ শেষে আবার নিয়োগকর্তার বাসায় তাকে কাজ করতে বাধ্য করানো হতো।
প্রচন্ড শীতের মধ্যেও তাকে গভীর রাতে ঘুম থেকে তুলে কাপড় পরিস্কার করাতেন। কিছু বললেই নিয়োগকর্তার স্ত্রী তাকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতেন। নিয়োগকর্তার স্ত্রী একদিন রান্নাঘর অপরিষ্কার দেখে, তাকে প্রচন্ড জোরে কানের মধ্যে থাপ্পর মারেন। সাথে সাথে কান থেকে গড়িয়ে রক্ত পড়েছিল।
সেদিন শালিমা বাসা থেকে পালিয়ে যান এবং পুলিশে ধরা দেন। পুলিশ নিয়োগকর্তাকে ডেকে এনে শালিমাকে চিকিৎসা করানো হবে এই শর্তে তাকে নিয়োগকর্তার হাতে তুলে দেন।
বাসায় আনার পরে নিয়োগকর্তা আর কখনোই শালিমা বেগমকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে যাননি।
চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ২০১৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর তারিখে শালিমা বেগম বাংলাদেশে ফেরত আসেন। নিয়োগকর্তা তাকে সর্বশেষ চার মাসের বেতন দেননি।
এর প্রেক্ষীতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা-ওকাপ মুন্সিগঞ্জ তাকে মানব পাচারের সারভাইভার হিসেবে শনাক্ত করে ও প্রাথমিক কাউন্সেলিং প্রদান করে। পাশাপাশি, সৌদি-আরব মালিকের নিকট থেকে ৪ মাসের বেতন আদায়সহ আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে বিএমইটিতে আবেদন করতে সহায়তা করে।
বর্তমানে অভিযোগটি শুনানীর অপেক্ষায় আছে।
শালিমা পরবর্তীতে বেসরকারি সংস্থা ওকাপের “জীবন দক্ষতা প্রশিক্ষণ”এ অংশগ্রহণ করেন ও নতুন প্রত্যয়ে জীবন শুরু করতে উদ্বুদ্ধ হন। চিন্তা করেন তার এলাকায় মুদি দোকান চালিয়ে সাবলম্বী হবেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাড়ায় তার অর্থনৈতিক দৈন্যতা। এরপর এগিয়ে আসে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা-ওকাপ। চলতি মাসের ১৫ তারিখে মুদি দোকান পরিচালনার জন্য প্রায় ২২ হাজার টাকার পণ্য কিনে দেয়া হয়।
শালিমা বলেন, ‘ওকাপ আমার দূর্দিনে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে তাই তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। আমি চেষ্টা করবো তাদের এই সহযোগিতায় স্বাবলম্বি হয়ে ওঠার।’