মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা বাস্তবায়নকারী ছিলেন আলবদর বাহিনীর প্রধান মতিউর রহমান নিজামী। মানবতাবিরোধী এই অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানেরা। তাঁরা এখন রায় কার্যকরের অপেক্ষায়।
আজ বুধবার সকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ড বহাল রেখে রায় দেন।
বিকেলে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছোট ছেলে আসিফ মুনীর বলেন, এই রায় একদিকে জাতিকে দায়মুক্ত করেছে, অন্যদিকে শহীদ পরিবারগুলোর জন্য ন্যায়বিচার নিয়ে এসেছে।
রায় বাস্তবায়নের দিন অনেক বেশি ভালো লাগবে উল্লেখ করে আসিফ মুনীর বলেন, ‘বুদ্ধিজীবী হত্যায় আরও যারা জড়িত ছিল, যারা এখন বিদেশে পলাতক তাদেরও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনা হোক। প্রত্যেকের বিচার হোক’।
শহীদ বুদ্ধিজীবী রাশিদুল হাসানের মেয়ে রোকাইয়া হাসিনা বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে এই রায়ের জন্য অপেক্ষা করেছি। বিশেষ করে বাবাসহ লাখো মুক্তিযোদ্ধার রক্তের বিনিময়ে আনা লাল-সবুজের পতাকা যখন নিজামীর গাড়িতে তুলে দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া তখন থেকে এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলাম’।
রোকাইয়া হাসিনা বলেন, ‘নিজামী সব সময় দম্ভোক্তি দেখিয়ে মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার করতেন। আজকে সমগ্র জাতি জানল তিনি অপরাধী। এই রায় যখন কার্যকর হবে তখন আরও ভালো লাগবে’।
শহীদ জহির রায়হানের ছেলে অনল রায়হানও রায় নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁর মতে, নিজামী শুধু সাধারণ গণহত্যা নয় বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা প্রণয়নে সরাসরি জড়িত। তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে খালেদা জিয়া শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক তুলেছেন। আর গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বুদ্ধিজীবীদের নিয়েই কটূক্তি করলেন। আজকের রায়ে প্রমাণিত তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করতে চাইছেন। কাজেই শহীদ পরিবারের সন্তান হিসেবে আমি চাই মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন হোক’। একই সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের দাবি জানান তিনি।
সুরস্রষ্টা আলতাফ মাহমুদের মেয়ে শাওন মাহমুদ বলেন, ‘এই বাংলাদেশে নিজামী-মুজাহিদরা যখন মন্ত্রী হয়েছিল সেটা ছিল আমাদের জন্য গ্লানির। এই রায় একটা মাইলফলক। যাঁরা বলেন বুদ্ধিজীবীরা নির্বোধের মতো মারা গেছে তাদের জন্য চপেটাঘাত। আমার মনে হয় মানবতাবিরোধীদের যেমনি ফাঁসি হচ্ছে তেমনি তরুণ প্রজন্মের ধারাবাহিক আন্দোলনে জামায়াত নিষিদ্ধ হবে, মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন হবে, যুদ্ধাপরাধীদের সম্পত্তি ক্রোক হবে।’
শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের ছেলে তৌহিদ রেজা নূর বলেন, ‘সুপরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য আলবদর গঠিত হয়েছিল; যার প্রধান ছিলেন নিজামী। এর আগে তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা ছিলেন। তাদের পরিকল্পনাতেই বিজয়ের আগমুহূর্তে ঘাতকেরা বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এই রাজাকাররা’ ৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর আবার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়। মন্ত্রীও হন। শহীদ পরিবারের জন্য এটি ছিল মারাত্মক যন্ত্রণার। আজকের রায়ে শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিবার সুবিচার পাচ্ছে। যে নরঘাতকেরা জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে এই রায় তাৎপর্যপূর্ণ। আগামী প্রজন্মসহ সারা পৃথিবীর জন্য এই রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে’।