মুন্সিগঞ্জ, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২, নাদিম হোসাইন (আমার বিক্রমপুর)
স্বাধীনতার ৫১ বছর চলছে। রাজধানীর কাছের জেলা মুন্সিগঞ্জ তথা বিক্রমপুরে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধা চলাকালে পাকসেনারা ব্যাপক নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছে। তবে ৫১ বছরেও জেলায় কয়টি বধ্যভূমি তার তালিকা নেই প্রশাসনের কাছে। নেই শহীদদের কবরের তালিকাও।
বেসরকারিভাবে যে বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোও বছরের ১১মাস অযত্ন আর অবহেলায় থাকে। শুধু বিজয়ের মাস ডিসেম্বর আসলেই চলে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা। জেলায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প আসলেও জেলা প্রশাসনের আগ্রহের অভাবে বধ্যভূমিগুলো ও শহীদদের কবরে স্মৃতিস্তম্ভ বা নামফলক স্থাপন করা যায়নি।
মুক্তিযোদ্ধা ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭১ সালের ৯ মে মুন্সিগঞ্জে প্রবেশ করে পাক হানাদার বাহিনী। প্রবেশকালে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় ফুলদি নদীর পাড়ে বেশ কিছু গ্রামের ৩৬০জন মানুষকে নৃশংসভাবে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে পাকসেনারা। একই দিন মুন্সিগঞ্জ শহরের হরগঙ্গা কলেজে শান্তি কমিটির মাধ্যমে ক্যাম্প স্থাপন করে তারা। এর পরপরই ক্যাম্পের পাশের একটি ডোবায় (বর্তমান পাঁচঘড়িয়া কান্দি বধ্যভূমি) অগণিত মুক্তিকামি বাঙালিকে হত্যা করে ফেলে দেয়। সেই বধ্যভূমিটি সংরক্ষণার্থে দীর্ঘ বছর পর ২০১২ সালে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়। তবে কতজনকে এই বধ্যভূমিতে এনে হত্যা করা হয়েছে তার কোন সঠিক তথ্য সরকারিভাবে লিপিবদ্ধ নেই।
১০ মে পাকহানদার বাহিনী টংগিবাড়ী উপজেলার আব্দুল্লাপুরের পালবাড়িতে হামলা চালিয়ে রাতের আধারে ১৯ জনকে হত্যা করে এবং পালবাড়ির পুকুর পারে ফেলে রাখে। সেখানে ১৯৯৮ সালে আব্দুল্লাপুর ইউনিয়ন পরিষদের উদ্যোগে একটি নাম ফলক নির্মাণ করা হয়। নামফলকে অনেকের নাম-পারিচয় নেই। ১৪ মে ১৯৭১ মুন্সিগঞ্জের শহরতলী মহাকালি ইউনিয়নের কেওয়ার চৌধুরী বাড়িতে ঘটে আরও এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। সে দিন ওই বাড়িতে আশ্রিত অনিল মুখার্জী, শচীন মুখার্জী, বাদল মুখার্জী, হরনাথ চক্রবর্তী, অধ্যাপক সুরেশ, ডা: মুরেন্দ্র চন্দ্র সাহা, সুনীল চন্দ্র সাহা, দ্বিজেন সাহা ও বাড়ির মালিক আইনজীবী কেদার চৌধূরীসহ ১৭ জনকে ধরে দক্ষিণ কেওয়ারের সাতানিখিল এলাকার সিকদার বাড়ির খালের পাড়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে পাক বাহিনী। খোজঁ নিয়ে জানা গেছে, স্বাধীনতার ৫১ বছরেও আজ অবধি সেখানে বধ্যভূমি সংরক্ষণে কোন চিহ্ন পর্যন্ত স্থাপন করা হয়নি।
এদিকে, গজারিয়া উপজেলায় অন্তত ৭টি বধ্যভূমি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে গজারিয়া টিএন্ডটি অফিসের কাছের পাকা ব্রিজের কাছের গোসাইরচর বধ্যভূমি, এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় গণকবর। এখানে শতাধিক শহীদদের গণকবর দেয়া হয়। ৭১ সালের ৯ মে গোসইরচর গ্রামে ১৩৫ জন নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করে হানাদার বাহিনী। অনেক লাশ পার্শ্ববর্তী ফুলদী নদীতে ভেসে যায়। এর দক্ষিণের দিকে নয়ানগর বধ্যভূমি। ৭১ সালের মে মাসে গজারিয়ার যে ১০টি গ্রামে গণহত্যায় ৩৬০ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়েছিল তার একটি গ্রাম হচ্ছে নয়ানগর। এছাড়াও প্রধানের চর, বালুরচর, নাগেরচর, কলসেরকান্দি ও দড়িকান্দি এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গণকবর।
এছাড়া ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর শৃংখল থেকে মুক্তির অর্থাৎ বিজয়ের ১৭ দিনে আগে মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার পূর্ব দক্ষিণের তিনটি গ্রামে পাক বাহিনী হত্যাকান্ড চালায়। এই তিনটি গ্রামে পৃথক পৃথকভাবে তিনজন নিরীহ মানুষকে পাক বাহিনী গুলি করে হত্যা করে। একই দিনে পাকবাহিনী যোগিনীঘাট এলাকার ৪জন ও মাঠপাড়া এলাকার একজনকে গুলি করে হত্যা করে।
সাতানিখিল ব্রীজের খালপাড়ে ১৬জন নিরীহ মুক্তিকামী বাঙালিকে হত্যা করা হয়। সেখানে প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন চম্পা বেগম। তিনি বলেন, পালবাড়ি থেকে ১৩-১৪জন মানুষ ধরে নিয়ে এসে আমাদের বাড়ির পাশের ডোবার সামনে সবাইকে গুলি করে হত্যা করে পাকসেনারা। পরে আমার স্বামী, চাচা শশুর, দেবররা মিলে বাঁশের আগায় কাচি লাগিয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয় শহীদদের লাশগুলো।
একই বাড়ির প্রত্যক্ষদর্শী তিন সন্তানের জননী সালেহা বেগম বলেন, যখন হত্যা করা হয় তখন ছেলে মেয়ে নিয়ে খুব ভয়ে ছিলাম। তখনতো আমরা বউ মানুষ। তখন খুব ভয় করছিল। এই বধ্যভূমি গুলো সরকারের উচিৎ সংরক্ষণ করা।
প্রত্যক্ষদর্শী মো. লাল মিয়া সিকদার বলেন, মার্চ মাসে চৌধুরী বাজার থেকে অনেক লোক ধরে নিয়ে আসে পাকসেনারা। সেখানে ১৩ থেকে ১৪জন হবে হাতে হাত ধরে রাখা হয়েছে। পরে তাদের এক সাথে হত্যা করে পাকবাহিনী। দূর থেকে স্ট্যান গান ফিট করে পরে তাদের একত্রে হত্যা করে। এক একজনের ৫ থেকে ৬ রাউন্ড গুলি লাগছে। লাশগুলো কয়েকদিন পরে ফায়ার সার্ভিসের লোক ও কিছু গ্রামবাসী নদীতে ফেলে দেয়।
যুদ্ধকালীন সময়ের ফ্রিডম ফাইটার (এফএফ) বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন আনু বলেন, মে মাসে পাকবাহিনী ঢুকে পড়ে মুন্সিগঞ্জে। তারা গজারিয়ায় হানা দিয়ে ফুলদী নদীর তীরে শতশত মানুষকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। ওইদিনই পাকবাহিনীরা মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে অবস্থান নেয় এবং মো. আব্দুল হাকিম বিক্রমপুরীকে আহবায়ক করে শান্তি বাহিনী গঠন করে। এছাড়া অন্যান্য থানা শান্তি কমিটিও গঠন করে।
তিনি বলেন, রতনপুরে সম্মুখযুদ্ধে পাক হানারদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় আসে মুক্তিযোদ্ধাদের। সম্মুখযুদ্ধে স্থানীয় ১৫ জন বাঙ্গালী নিহত হয়। এর পরেই ১১ ডিসেম্বর চুড়ান্ত ভাবে মুক্তি পায় মুন্সিগঞ্জ।
তিনি বলেন, মুন্সিগঞ্জে এখন অগণিত মুক্তিযোদ্ধা দেখা যায়। অথচ মুক্তিযুদ্ধকালীন এসব মুক্তিযোদ্ধা কোথায় ছিলেন। তাই জীবনের শেষ সময়ে একটাই চাওয়া মুন্সিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা করা হোক। দেশে আর আর কতদিন মুক্তিযোদ্ধা থাকবে। কিন্তু ইতিহাস রয়ে যাবে। তিনি বলেন, সঠিকভাবে মুক্তিযোদ্ধদের তালিকা প্রকাশ পাক। আর বধ্যভূমিগুলো সঠিকভাবে নতুনদের কাছে তুলে ধরা হোক।
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল কাদের মোল্লা বলেন, যে সকল বধ্যভূমিগুলো রয়েছে সেগুলোতে যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায় অযত্ন আর অবহেলায় থাকে। বর্তমানে মাদক সেবীদের আড্ডায় পরিণত হয়েছে বধ্যভূমিগুলো। তিনি বলেন, বধ্যভূমিগুলো সরকারিভাবে চিহ্নিত করে সংরক্ষণ করা দরকার। বধ্যভূমি সংরক্ষণ করার জন্য ভিন্ন একটি দপ্তরের কাছে হস্তান্তর করা অতি জরুরী। না হয় নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস থেকে বঞ্চিত হবে।
সরকারিভাবে বধ্যভূমি চিহ্নিতকরণ ও মুক্তিযুদ্ধের সময় শহীদদের কবর শনাক্তের বিষয়ে জানতে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসুলকে সরকারী নাম্বারে ফোন করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। পরে তিনি এসএমএস’র মাধ্যমে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আব্দুল কাদের মিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে বলেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আব্দুল কাদের মিয়া এ বিষয়ে বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, আমি সকল সহযোগিতা করতে পারবো। তবে বক্তব্য দিতে পারবো না। পরে তিনি জেলা প্রশাসনের সাধারণ শাখায় পাঠালে সাধারণ শাখার অফিস সহকারি জান্নাতুল ফৈরদৌস বলেন, বধ্যভূমি সংক্রান্ত কোন তথ্য নেই আমাদের কাছে।
মুন্সিগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী নাজমুল হাসান হিরা জানান, জেলার বধ্যভূমি ও শহীদদের কবর সংরক্ষণ, স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য তালিকা চেয়ে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা পর্যায়ে দফায় দফায় চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু সেই চিঠির উত্তর এখনো পাওয়া যায়নি। ফলে বরাদ্দ থাকলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।