১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
শনিবার | রাত ৩:০১
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
মুন্সিগঞ্জে আ.লীগের দুই পক্ষের দ্বন্দ্বে পঙ্গুত্বের পথে জিয়া
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ২৮ জানুয়ারি, ২০২৩, বিশেষ প্রতিনিধি (আমার বিক্রমপুর)

মুন্সিগঞ্জ সদরের মোল্লাকান্দিতে গত মঙ্গলবার ইউনিয়ন যুবদল নেতা জিয়া সরদারকে কুপিয়ে ও গুলি করে জখমের ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব।

আজ শনিবার দৈনিক সমকালে প্রকাশিত বকুল আহমেদের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

মোল্লাকান্দির লোকজন ও আহতের স্বজনরা জানিয়েছেন, জিয়া যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হলেও গত মোল্লাকান্দি ইউপি নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মহসিনা হক কল্পনার পক্ষে কাজ করেন। এ কারণে জিয়া মুন্সিগঞ্জ সদর থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও ইউপি চেয়ারম্যান রিপন হোসেন পাটোয়ারীর টার্গেটে পরিণত হন।

রিপন হোসেন ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত ওই নির্বাচনে কল্পনাকে পরাজিত করে বিজয়ী হন। কল্পনা মুন্সিগঞ্জ সদর থানা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি একই ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান।

জিয়া গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর মুক্তারপুর পুরোনো ফেরিঘাটে পুলিশের ওপর বিএনপি নেতাকর্মীর হামলা মামলার আসামি। গত মঙ্গলবারের ঘটনার পর তিনি ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি বলে প্রচার করে তাঁর লোকজন। তবে এখন জিয়ার দাবি, তিনি ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি নন বরং সভাপতি প্রার্থী ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেত্রী কল্পনাও একই দাবি করেছেন।

জেলা যুবদলের সদস্য সচিব মাসুদ রানা জানান, জিয়া যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে তাঁর কোনো পদ-পদবি আছে বলে আমার জানা নেই। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, যুবদলের রাজনীতি করেন জেনেও কেন জিয়াকে আওয়ামী লীগ নেত্রী কল্পনা আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন।

আহত জিয়া বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গতকাল শুক্রবার হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, দুই পা, দুই হাতে ব্যান্ডেজ জড়ানো অবস্থায় বেডে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন তিনি। পাশে মলিন চেহারায় স্বজনদের কেউ বসে, কেউবা দাঁড়িয়ে। তাঁদের শঙ্কা, জিয়ার পা ভালো হবে তো? নাকি পঙ্গুত্ব নিয়েই কাটাতে হবে বাকি জীবন।

স্বজনরা জানান, জিয়া সরদারের বাড়ি মোল্লাকান্দি ইউনিয়নের নোয়াদ্দা গ্রামে। তিনি ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি প্রার্থী ছিলেন। সেরাজাবাদ গ্রামে রড, সিমেন্ট, বালুর ব্যবসা করেন। গত মঙ্গলবার দুপুরে নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে একটি অটোরিকশায় মেয়েকে স্কুল থেকে আনতে যাচ্ছিলেন। পথে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে কিছু লোক জিয়াকে একটি মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যায়।

জিয়া জানান, গাড়িতে ইউপি চেয়ারম্যান রিপন হোসেন পাটোয়ারীর ভাই শিপন পাটোয়ারীকে দেখে চমকে ওঠেন তিনি। এর পর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ইউপি চেয়ারম্যানের নিজ গ্রাম আমঘাটা বাঘবাড়ী। সেখানে শিপন ও তাঁর সহযোগীরা তাঁকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে। এ ছাড়া তাঁর দুই পা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে তাঁকে গুলিও করা হয়। গুলিটি ডান হাতের আঙুলে লাগে। মারধরের সময় ওই এলাকা দিয়ে সাইরেন বাজিয়ে একটি অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছিল। সেটি পুলিশের গাড়ি মনে করে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয় কয়েকজন নারী আহত জিয়াকে একটি ভ্যানে উঠিয়ে দেন। পরে খবর পেয়ে স্বজনরা তাঁকে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান। অবস্থার অবনতি হলে ওই দিন রাতেই তাঁকে স্থানান্তর করা হয় ঢামেক হাসপাতালে। হামলার ঘটনায় জিয়ার স্ত্রী সুমী রহমান গত বৃহস্পতিবার মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় মামলা করেছেন। এতে ইউপি চেয়ারম্যান রিপনের ভাই শিপনসহ ১৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।

জিয়ার স্ত্রী সুমী রহমান বলেন, হামলাকারীরা কুপিয়ে আমার স্বামীর ডান হাতের একটি আঙুল বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। বাঁ হাতের একটি আঙুলের রগ কেটে গেছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বাঁ হাতের আঙুলটি কেটে ফেলতে হতে পারে। এ ছাড়া দুই পায়ের অবস্থাও গুরুতর। ডান পায়ের হাঁটুর হাড় এবং বাঁ পায়ের হাড় ভেঙে গেছে।

যুবদলের রাজনীতি করেও কেন আওয়ামী লীগ নেত্রী কল্পনার পক্ষে নির্বাচনে কাজ করেছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে জিয়া বলেন, ইউপি নির্বাচনে বিএনপির কোনো প্রার্থী ছিল না। আর আওয়ামী লীগ নেত্রী কল্পনা আমার পূর্বপরিচিত। আমরা একই এলাকার। তিনি আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী হিসেবে স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিলেন। তাই আমি তাঁর পক্ষে নির্বাচনে কাজ করেছি। কিন্তু কল্পনা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী রিপন পাটোয়ারীর কাছে হেরে যান। আমি কল্পনার পক্ষে কাজ করায় রিপন পাটোয়ারী বিষয়টি ভালোভাবে নেননি। হামলার সময় চেয়ারম্যান রিপন হোসেনের ভাই শিপন বলতে থাকেন, ‘তুই কল্পনার নির্বাচন কইরা আমাগো ১০ লাখ টাকা ক্ষতি করছস। তোর কারণেই এত টাকা বেশি খরচ হইছে।’

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী কল্পনার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, গত ১৩ জানুয়ারি পোড়াবাজারে একটি কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল। সেখানে জিয়াসহ আমার লোকজন দাওয়াতে যান। রিপন চেয়ারম্যানও দাওয়াতি ছিলেন। সেখানে তাঁর কর্মী রতনের সঙ্গে পাওনা টাকা নিয়ে জাকির নামে এক ব্যক্তির ঝগড়া হয়। চেয়ারম্যান রিপন এ খবর শুনে জিয়াসহ আমার অনুসারীদের গালাগাল করেন। এ সময় হেনস্তার শিকার হন রিপন চেয়ারম্যান। ওই ঘটনার ক্ষোভ এবং গেল ইউপি নির্বাচনে আমার পক্ষে কাজ করার কারণে জিয়ার ওপর হামলা হয়েছে। আর যুবদলের রাজনীতি করলেও জিয়ার কোনো পদ-পদবি নেই। তাই নির্বাচনে তিনি আমার পক্ষে কাজ করেছেন।

অভিযোগ প্রসঙ্গে রিপন পাটোয়ারী বলেন, আওয়ামী লীগ নেত্রী কল্পনা বিএনপি-যুবদলের লোকজনকে নিয়ে রাজনীতি করেন। ইউপি নির্বাচন নিয়ে তাঁর সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয় আমার। এ কারণে তিনি মিথ্যাভাবে আমার ভাই শিপনকে ফাঁসিয়েছেন। শিপন কিংবা আমার কোনো লোক এই হামলার সঙ্গে জড়িত নয়।

এদিকে মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) খান্দার খাইরুল হাসান বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই মারধরের ঘটনা ঘটেছে। মামলা হয়েছে। জড়িতদের গ্রেপ্তারে পুলিশের একাধিক টিম মাঠে রয়েছে।’ ডিবি পুলিশ পরিচয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, অপরাধারী নানা কৌশল নিয়ে থাকে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

চেয়ারম্যান রিপনের ভাই ও মোল্লাকান্দি ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি শিপনের ব্যবসা রয়েছে কাতারে। শিপন এর আগে আলোচনায় আসেন ২০১৬ সালের ৩০ জানুয়ারি মুন্সিগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে। ভোট গ্রহণের দিন শহরের পিটিআই স্কুল মোড়ের কেন্দ্র দখল করতে গিয়ে প্রকাশ্যে অস্ত্র বের করেন তিনি। শিপনের অস্ত্রসহ ওই ছবি স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ৭ অক্টোবর মোল্লাকান্দির চরডুমুরিয়া বাজার সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে আসার সময় কাতার প্রবাসী ব্যবসায়ী ও যুবলীগ নেতা ইউসুফ হাসানের সমর্থকদের ওপরও হামলার অভিযোগ আছে শিপন ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে।

error: দুঃখিত!