মুন্সিগঞ্জ, ৩০ জুন, ২০২০, (আমার বিক্রমপুর)
আফরিন ক্যাথি:
ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ২৫ কিলোমিটার। নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব এর অর্ধেক হবে। ঢাকা টু মুন্সিগঞ্জের যাতায়াত ব্যবস্থার বর্ণনা দেয়ার ইচ্ছাশক্তি আমার নাই। এইটুকু রাস্তায় যদি আপনি প্রাইভেট কারে না আসেন – তবে এর চেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা পুরো মাসে আপনার আর হবেনা। দূরত্ব কম হওয়ায় অধিকাংশেরও বেশি কর্মজীবী মানুষজন প্রতিদিন যাতায়াত করেন।
মুন্সিগঞ্জ সদর থেকে নারায়নগঞ্জ – ঢাকা যাওয়ার দুটি রাস্তা-১) সিএনজি করে স্থলপথে ২) লঞ্চে করে নদীপথে। প্রতিবছরই রমজান মাস আসলে শুনি মুন্সিগঞ্জ টু নারায়নগঞ্জের লোকাল সিএনজি ভাড়া ১০ থেকে ২০ টাকা বেড়ে যায়। ঈদ কাছাকাছি আসলে বা ঈদের পরপর এ ভাড়া কত হবে সেটা ঠিক করে একমাত্র সিন্ডিকেট!! যাত্রীরা এখানে সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মী,অসহায়! এ বিষয়টা বরাবরই খারাপ লাগে। অথচ কখনোই এটা নিয়ে কাউকে কথা বলতে দেখিনি!!!
আর নদীতে যেই লঞ্চটা যাত্রীদের পারাপারের জন্য আছে ওটা রীতিমতো একটি খেলনা। ফিটনেসবিহীন এই লঞ্চগুলোতে প্রতিদিন শত শত স্টুডেন্ট, চাকুরিজীবী, সাধারণ লোকজন যাতায়াত করেন। এই লঞ্চে মাথা টা সোজা করে ঠিকমত দাঁড়ানোও যায়না। হালকা জোরে বাতাস বইলেই লঞ্চটা উল্টে যায় কি না এই ভয়ে যাত্রীরা আল্লাহ আল্লাহ করে। এটা নিয়েও কাউকে কখনো কথা বলতে দেখিনি!!!
এবার ঢাকা টু মুন্সিগঞ্জের কথায় আসি। দিঘীড়পাড়ের যেই বাসটা মুন্সিগঞ্জে আসে যায়, সেটায় উঠার সৌভাগ্য আমার এখনো হয়নি। পঞ্চবটী দিয়ে যাতায়াত করা এই বাসের যারা নিয়মিত যাত্রী – এই তিক্ত অভিজ্ঞতা তারাই ভালো বর্ণনা করতে পারবেন। এতো শত শত যাত্রী প্রতিদিন এই রুটে যাতায়াত করে অথচ একটা ভালো একটা বাস সার্ভিস নেই মুন্সিগঞ্জে।
আর যদি কোন যাত্রী মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা করে, তবে তাকে একটা ট্রলারে করে মাঝ নদীতে গিয়ে চলন্ত লঞ্চে উঠা লাগে।
কল্পনা করা যায়?
আবহাওয়া যেমনই হোক না কেনো, প্রতিদিনই অসংখ্য যাত্রী এই ভয়াবহ মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চের রাস্তা টা বেছে নেন।
একটা ঘটনা বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বাস প্রতিদিন মুন্সিগঞ্জে আসে ছাত্রছাত্রীদের আনা নেওয়ায়। বিশ্বাস করেন, দিনের/মাসের/বছরের কত ঘন্টা সময় যে এই স্টুডেন্টগুলা রাস্তায় নষ্ট করে, কল্পনাও করতে পারবেন না!!
ট্রাফিক জ্যাম? না এটাই মূল সমস্যা না! চানখারপুল থেকে ফ্লাইওভারে উঠে গেলে এই বাসটা সরাসরি সাইনবোর্ড হয়ে নারায়ণগঞ্জ পার হয়ে যায় অনেক অল্প সময়ে। মূল সমস্যা টা হয় নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জে পৌঁছাতেই। একদিনের একটা ঘটনার বর্ণনা দেই, একদিন সকালে গিয়ে ক্লাস ধরতে হবে, তাই সহজ আর নিরাপদ হিসেবে ক্যাম্পাসের বাস ধরলাম ভোর ৬:০০ টায়! মোট দুইবারের অভিজ্ঞতার মধ্যে অইদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে আমার প্রথম ঢাকায় যাওয়া। স্বভাবতই ভোর বেলা আর সহযাত্রী সব পরিচিত লোকজন হওয়ায় সিটে হেলান দিয়ে আমি চোখ বন্ধ করে আছি। হঠাৎ করেই জানালা দিয়ে বাইরে থেকে আসা বালি – কণায় আমার চোখ-নাক-চুল-গায়ের বেহাল দশা হলো!
পরিস্থিতি দেখার জন্যেও আমার তাকানো প্রয়োজন ছিলো অথচ চোখে বালিকণা যাওয়ায় আমি তা পারিনি!!
পরবর্তীতে শুনলাম, আমাদের বাসের পাশ দিয়ে এক স্বনামধন্য সিমেন্ট ফ্যাক্টরির ট্রাক যাওয়ার সময় ইচ্ছা করেই এ কাজ করেছে।
কারন? কারণ যেটা শুনেছি সেটা শোনার জন্যে আমি একদম ই প্রস্তুত ছিলাম না। মুন্সিগঞ্জ টু নারায়ণগঞ্জ যে রাস্তা টা আছে এর প্রশস্ততা খুব কম। বাস এবং ট্রাক যুগপৎভাবে ক্রস করা কষ্টসাধ্য। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস যখন সকালে স্টুডেন্ট নিয়ে ঢাকার জন্য রওনা করে তখন সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর ট্রাকগুলো মুন্সিগঞ্জের দিকে আসে এবং তাদের বেপরোয়া – উদ্দ্যমী চলাফেরায় অসুবিধা হয়!!! সেদিন বাসে অনেক সিনিয়র ভাইয়েরা ছিলেন। তাদের চেহারায় তাকিয়ে বুঝেছিলাম মাফিয়া ট্রাক ড্রাইভারদের সামনে নিজেদের অসহায়ত্ব! এমন ঘটনা নাকি বেশ কয়েকবার ঘটেছে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবহন অফিসে কমপ্লেইনও করা হয়েছিলো কয়েকবার!!! কই কোন সমাধান তো আসেনি!!!
এতোদিন পরে এই ঘটনা টা কেনো লিখলাম বলি! ‘ মর্ণিং বার্ড ‘ নামের যেই লঞ্চটা বুড়িগঙ্গা নদীতে ডুবেছে সেটা মুন্সিগঞ্জের যাত্রী দিয়ে ভর্তি ছিলো। ট্রলার ভর্তি করে যে লাশগুলো উদ্ধার করা হয়েছে এদের অনেকেই হয়তো কাটপট্টি থেকে ছেড়ে যাওয়া এই লঞ্চটার নিয়মিত যাত্রী ছিলেন, কারো বাবা, কারো মা, আর শিশু বাচ্চাগুলা?
আমার মনে আছে, অনেক বায়না করে একবার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাড়ি ফেরার সময় নানা ভাইকে নিয়ে জোর করে এই লঞ্চে করেই মুন্সিগঞ্জে এসেছিলাম। কত্ত খুশী ছিলাম আমি!!! হয়তো আজকের লঞ্চেও এমন কেউ ছিলো। আগ্রহ নিয়ে প্রথমবার লঞ্চে উঠা শিশুর শৈশব টা কেড়ে নেয়া কত সহজ!!!
এই দেশে মানুষের জীবন কত তুচ্ছ!!! লকডাউনের মাঝামাঝি থেকেই সংবাদ দেখা বন্ধ করে দিয়েছি, সকালে চিটাগং থেকে পাওয়া একটা ফোনে জানতে পারলাম মুন্সিগঞ্জের লঞ্চ ডুবির কথা। আমি নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। যারা নিয়মিত যাতায়াত করে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম।
পরিচিত একজন আজকের দুর্ঘটনায় আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। একটা স্ট্যাটাসে দেখলাম, ‘৫ মিনিটের জন্যে আজকের লঞ্চ টা মিস করেছিলাম, নয়তোবা কাফনের কাপড়ে আজকে আমাকেও মোড়া হতো! ‘ জীবন এখানে কত অনিশ্চিত!!!! স্বাভাবিক শুধুমাত্র মৃত্যুই!!! আহা জীবন!!!
মাঝেমধ্যেই অবাক হয়ে ভাবি, সবকিছুতেই আমরা কত অভ্যস্ত!!! এইযে, আজকের লঞ্চ ডুবি না ঘটলে হয়তো আমিও হয়তো লিখতাম না। চলুন, আপনি – আমি আজকের পর থেকে আবার চুপ থাকি পরবর্তী দুর্ঘটনায় একটা স্ট্যাটাস দেয়ার জন্য।
লেখকঃ আফরিন ক্যাথি, শিক্ষার্থী, ৩য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ।