শহরের মধ্যকার চারটি খালের সবই প্রায় ভরাট। যেটুকু বাকি আছে, সেখানেও পানির বদলে শহরের সব ময়লা-আবর্জনা স্থান পেয়েছে। দুর্গন্ধে দাঁড়ানো দায়। পুকুরগুলোর দুরবস্থা চোখে পড়ে।
ধলেশ্বরী নদীর তীরের একসময়ের ঐতিহ্যবাহী বন্দর মীরকাদিম পৌরসভার বর্তমান চিত্র এটা। অথচ একসময়ে মীরকাদিমের কমলাঘাট বাণিজ্য বন্দর দিয়ে কলকাতার সঙ্গে বাণিজ্য চলত এই অঞ্চলে। বাংলাদেশের বড় বড় চালকলগুলোও এখানেই ছিল। কিন্তু এখন মীরকাদিমে ঘুরলে মনে হবে, এ বুঝি ধুলো জমা কোনো পুরোনো বিবর্ণ ছবি।
এলাকার মানুষজন জানালেন, এই পৌরসভার প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। বৃষ্টি হলে শহরের খালগুলো দিয়ে পানি বের হয়ে নদীতে যেতে পারে না। এ ছাড়া বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ, পয়োনিষ্কাশন কিংবা পরিচ্ছন্নতার মতো ন্যূনতম সুবিধাও পাচ্ছেন না অন্তত ৬০ শতাংশ মানুষ। মূল রাস্তা বাদ দিলে পৌরসভার অনেক রাস্তা এতটাই সরু যে রিকশা চলাও কষ্টকর। অনেক জায়গা আবার ভাঙাচোরা।
বর্ণনা শুনে মনে হতে পারে এটি পিছিয়ে পড়া কোনো পৌরসভা। কিন্তু বাস্তবে এটি প্রথম শ্রেণির পৌরসভা। তাহলে এই বেহাল দশা কেন জানতে চাইলে বর্তমান পৌর মেয়র শহিদুল ইসলাম শাহিন বলেন, ‘এখন পৌরসভার যে অবস্থা দেখছেন, পাঁচ বছর আগে এর চেয়েও বাজে অবস্থা ছিল। এখন যতটুকু উন্নয়ন দেখছেন, সেগুলো গত পাঁচ বছরে আমি করেছি। আমি আবার নির্বাচিত হলে বাকি সমস্যাগুলোও থাকবে না। তবে নির্বাচনকে সামনে রেখে আমার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।’
মুন্সিগঞ্জ পৌরসভা থেকে মুন্সিগঞ্জ-মুক্তারপুর সড়ক ধরে সামনে এগোলে পঞ্চসার ইউনিয়ন। এরপরই মীরকাদিম পৌরসভা। পৌর কর্তৃপক্ষ জানাল, পৌরসভা অধ্যাদেশ ১৯৭৭ অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের শতকরা ৭৫ ভাগের অধিক লোক অকৃষি পেশায় নিয়োজিত থাকায় এবং প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যার ঘনত্ব দুই হাজারের অধিক ও সর্বমোট জনসংখ্যা ১৫ হাজারের বেশি হওয়ায় রিকাবীবাজার ইউনিয়ন পরিষদের ১৪টি মৌজা নিয়ে ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি মিরকাদিম পৌরসভা কার্যক্রম শুরু করে।
২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি এটিকে ‘গ’ থেকে ‘খ’ শ্রেণির পৌরসভা করা হয়। আর ২০১৩ সালের ১০ মার্চ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এটিকে ‘ক’ বা প্রথম শ্রেণির পৌরসভা করে।
মীরকাদিমের মউরাপাড়া, গোপালনগর ও কালিন্দীপাড়া পড়েছে ২ নম্বর ওয়ার্ডে।
কালিন্দিপাড়া যাওয়ার আগে মূল সড়কে কালভার্টের দুই পাশে খালটি আবর্জনায় ভরা। একটু দূরেই খাল ভরাট হয়ে গেছে। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের গোবিন্দনগর, নগরকসবা (হিন্দুপাড়া), গোপপাড়া, সূত্রধরপাড়ায় যেখানে-সেখানে আবর্জনা পড়ে আছে। পুকুরগুলোতেও আবর্জনা। অধিকাংশ জায়গায় সড়কবাতি নেই।
৫ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্বপাড়া ও পশ্চিমপাড়া বেশ ঘনবসতিপূর্ণ হলেও এখানে পানি ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের নৈদীঘিরপাথর ও কমলাঘাটের প্রধান সমস্যা জলাবদ্ধতা। ৭ নম্বর ওয়ার্ডের জিরানন্দপট্টির ড্রেনগুলো খুব সরু। ৮ নম্বর ওয়ার্ডের অধিকাংশ এলাকা ভালো হলেও কাতলাপাড়ায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। ৯ নম্বর ওয়ার্ডের তিলার্দি ও সুধারচরের নাগরিকেরাও পানি ও পয়োনিষ্কাশনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
মীরকাদিম বাজারের ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, বাজারটা এই পৌরসভার প্রাণকেন্দ্র হলেও সেখানকার রাস্তাঘাটের তেমন কাজ হয়নি। জসীম মিয়া, রাহিদুলসহ কয়েকজন দোকানদার বললেন, এই বাজারে একটা পাবলিক টয়লেট জরুরি। কিন্তু সেটিও হচ্ছে না।
নির্বাচনকে ঘিরে পৌরবাসীর এসব সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিচ্ছেন প্রার্থীরা। তবে এলাকাবাসী জানালেন, মীরকাদিমের প্রাণ ছিল নয়নের খাল, গোপপাড়া খাল, রিকাবীবাজার খাল ও ফেচুন্নির খাল। কিন্তু সেই খালগুলো ক্রমেই দখল হয়ে যাওয়ায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। ফলে সমস্যা সমাধানে এই খালগুলোই উদ্ধার করতে হবে।
জেলা আওয়ামী লীগের মানবসম্পদ-বিষয়ক সম্পাদক ও এই নির্বাচনের স্বতন্ত্র প্রার্থী মনসুর আহমেদও তাই মনে করেন। তিনি বলেন, পৌরবাসীর একটা বড় সমস্যা জলাবদ্ধতা। এ ছাড়া মাদকও একটা সমস্যা। সেটিও দূর করতে হবে।
মীরকাদিমের প্রথম নির্বাচিত মেয়র মোহাম্মদ হোসেন এবার জাতীয় পার্টির (জেপি) প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তিনি বলেন, ‘২০০৪ সালে আমি যখন প্রথম মেয়র হই, তখন রাস্তাগুলো কাঁচা ছিল। আমি সব পাকা করেছিলাম। কিন্তু তখন জলাবদ্ধতা ছিল না। এরপরে খালগুলো দখল করায় জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। হাইকোর্টের নির্দেশের পর এগুলো উচ্ছেদ হয়। মামলা হয় ৫৭ জনের বিরুদ্ধে। কিন্তু এখন আবার পৌরসভাই খাল ভরাট করে পাকা করছে।’ তিনি বলেন, ‘জেলা প্রশাসনে আমি অভিযোগ দিয়েছি। আমি চাই খালগুলো পুনরুদ্ধার হোক, মীরকাদিমবাসী জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাক।’