মুন্সিগঞ্জ, ৩০ অক্টোবর ২০২৪, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
আন্দোলনে গিয়ে ঝাঝড়া খাদ্যনালী, বন্ধ হয়ে গেছে স্বাভাবিক পায়খানার রাস্তা। ৪ আগস্ট মুন্সিগঞ্জের সুপারমার্কেটে পিঠ, হাত ও পেটে গুলিবিদ্ধ হন মঞ্জিল মোল্লা (৫৩)। বর্তমানে তার দিন কাটছে নিদারুণ কষ্টে।
একদিকে ১০ সদস্যের পরিবার নিয়ে হিমশিম, অন্যদিকে পরবর্তী চিকিৎসা ব্যায় নিয়ে রয়েছেন দুশ্চিন্তায়। দুই দফা অপারেশনে প্রাণ বাঁচলেও অর্থ সংকটে বন্ধ পরবর্তী চিকিৎসা। পূর্ণাঙ্গ ব্যায় বহন ও পুনর্বাসনের দাবি জানিয়েছেন স্বজন ও স্থানীয়রা।
জানা গেছে, গত ৪ আগস্ট মুন্সিগঞ্জ শহরের সুপারমার্কেটে এক দফা দাবিতে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। খবর পেয়ে প্রতিহতের ঘোষণা দেয় মুন্সিগঞ্জ ৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ফয়সাল বিপ্লব ও তার অনুসারী আওয়ামী লীগ- ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। পুলিশও কঠোর অবস্থান নেয় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে শিক্ষার্থীরা শহরের সুপারমার্কেট সংলগ্ন পাতাল মার্কেটের সামনে এলে তাদের উপর চড়াও হন ফয়সাল বিপ্লব অনুসারীরা। এসময় লাঠিপেটা ও ককটেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে শহরের কৃষি ব্যাংক এলাকা ও উত্তর ইসলামপুর থেকে শত শত আন্দোলনকারী বেড়িয়ে পড়েন। তারা আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে শহরের মূল কেন্দ্র অঙ্কুরিত যুদ্ধ ১৯৭১ ভাস্কর্যের সামনে পর্যন্ত এলে চরকেওয়ার, আধারা, মোল্লাকান্দি, শিলই থেকে আসা শত শত আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা পিস্তল-রাইফেল, শর্টগান, হাতে বানানো অস্ত্র নিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। সেসময় আহত মঞ্জিলের ডান হাতে গুলি লাগলে তার হাতে থাকা ইটের সুড়কি পড়ে গিয়ে হাড় ফেটে বের হয়ে যায় সেটি। দ্বিতীয় গুলি লাগে পিঠে। এরপর তৃতীয় দফায় পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে অবস্থা গুরুতর হলে মাটিতে লুটে পড়ে যান তিনি।
ওইদিন গুলিতে মারা যান মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার উত্তর ইসলামপুরের সজল মোল্লা (৩১), রিয়াজুল ফরাজী (৩৮) ও নুর মোহাম্মদ ওরফে ডিপজল (২২)।
আন্দোলনকারীদের মধ্যে কয়েকজন মঞ্জিলকে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পিঠের গুলি সহসা বের হলেও খাদ্যনালীতে আটকে যাওয়া গুলি নিয়ে বেগ পেতে হয় চিকিৎসকদের। পরবর্তীতে বিডিআর হাসপাতালে খাদ্যনালীর ৪টি নাড় কেটে গুলি বের করলেও জায়গাটি শুকানোর জন্য স্বাভাবিক রাস্তা দিয়ে পায়খানা বন্ধ রেখে পেটের সাইড দিয়ে কেটে ব্যাগ বসিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসকরা। দেড় মাস চিকিৎসার পর বাড়ি ফিরেছেন উত্তর ইসলামপুরের মঞ্জিল মোল্লা। পরবর্তী অপারেশন হলে তার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাওয়ার কথা।
তবে, অর্থ সংকটে পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন স্বজনরা। অন্যদিকে, ১০ সদস্যের সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি অসুস্থ থাকায় উভয় সংকটে রয়েছে পরিবারটি।
আহত মঞ্জিল মোল্লা বলেন, ‘আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে আমিও অংশ নিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমার শরীরে ৩টি গুলি লাগে। এরপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। লোকজন আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কোনমতে আমার প্রাণটা বেঁচে গেছে। যে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা প্রকাশ্যে আমার উপর গুলি ছুড়েছে আমি তাদের বিচার চাই।’
আহত মঞ্জিল মোল্লার বড় মেয়ে রুপা আক্তার বলেন, ‘আমার বাবার পরবর্তী অপারেশনের জন্য ২-৩ লাখ টাকা প্রয়োজন। এই ব্যায় মিটানো আমাদের পক্ষে সম্ভব না। সরকারিভাবে বহন করা হবে কি না তারও কোন নিশ্চয়তা পাচ্ছি না। আমার এক ভাই বিবাহিত, সেও বেকার। আমাদের দাদা-দাদীসহ ১০ সদস্যের পরিবার। বাবাই একমাত্র উপার্জন করেন। তার আয়ে সংসার চলে। এভাবে কতদিন চলতে পারবো জানিনা। সরকারের প্রতি আহবান আমাদের পরিবারটির দিকে তারা যেন নজর দেয়।’
প্রতিবেশী রবিউল মাষ্টার বলেন, ‘উনার একটা ছেলে আছে, অনেক কষ্ট করে বাড়ির পেছনের জমি বিক্রি করে তাকে এইচএসসি পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়েছেন। কিন্তু ওই ছেলের কাজ নেই, বেকার। সরকারের কাছে আমাদের আশা- তারা যদি ছেলেটাকে একটা কাজ দেয় তাহলে সংসারটা বেঁচে যাবে। নাহলে কয়দিন পরে তাদের পথে বসতে হবে।’
স্থানীয় ফয়সাল হোসেন বলেন, ‘উনার দুইটা সহযোগিতা দরকার। এমন একটা ব্যবস্থা হোক যাতে উনার পরিবারটা চলতে পারে আরেকটা বিষয় হচ্ছে সরকার এমন দায়িত্ব নিক যেন যে পর্যন্ত উনি পুরোপুরি সুস্থ না হয় সে পর্যন্ত সকল ব্যায়ভার বহন করে।’ জেলা সিভিল সার্জন ডা. মো. মঞ্জুরুল আলম বলেন, ‘আহত মঞ্জিলের বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে আহতদের তালিকা করতে আমাদের উপর নির্দেশনা রয়েছে। সেখানে মঞ্জিলকেও তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। আশা করছি- তিনি সরকারের প্রতিশ্রুত সহায়তা পাবেন। এছাড়া তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল বা সিএমএইচে যোগাযোগ করলে পরবর্তী চিকিৎসাটি বিনামুল্যে সম্পন্ন করতে পারবেন বলে আশা করছি।’
এদিকে, আন্দোলনে এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়ে আহতের ঘটনায় মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় লিখিত অভিযোগের প্রস্তুতি নিয়েছে মঞ্জিলের পরিবার।
মুন্সিগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খলিলুর রহমান বলেন, ‘৪ আগস্টের ঘটনায় এখন পর্যন্ত সদর থানায় ৩টি হত্যা মামলা একটি ভাঙচুরের মামলা ও আহতের ঘটনায় আরও একটি মামলা দায়ের হয়েছে। আহত মঞ্জিলের ঘটনায় অভিযোগ পেলে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।’