১৩ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
শুক্রবার | রাত ৯:৪৬
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
শ্রীনগরের ২০০ বছরের পুরনো জমিদারবাড়ী
খবরটি শেয়ার করুন:

হোসনে আরা রহমান: ভাগ্যকুলের জমিদারবাড়ির মাথায় তখন সূর্য সটান। যদুনাথ সাহা গড়েছিলেন পুবমুখো বাড়িটি। সম্মুখভাগে আটটি বিশাল থাম। দোতলার ছাদে গিয়ে ঠেকেছে। ভবনটির চারদিকেই এমন আরো থাম আছে। মনে হচ্ছিল গ্রিস দেশে চলে এসেছি। সেই যে পার্থেনন আর ডেলফির মন্দিরের ছবি দেখেছি, তা মনে পড়ল বেশি। সারা বাড়িতে নানা নকশা_সাপ, ময়ূর, ফুল, পাখি। বিশাল দরজা পার হয়ে ভেতরে ঢুকলে অন্য জগৎ।
মাঝখানে উঠান রেখে চারধারে ভবন। একদিকে মন্দির, এখনো পূজা হয় নিয়মিত। দোতলা বাড়ির দরজা-জানালা সবই কাঠের। মজার ব্যাপার হলো, বাড়ির দরজা-জানালা সব সমান উঁচু। কোনটি যে দরজা আর কোনটি জানালা বন্ধ থাকলে বোঝার উপায় নেই। রঞ্জু ভাই একবার ঠোক্কর খেয়ে ফিরে এলেন। আসলে ওটা জানালা ছিল। দোতলায় বারান্দার রেলিং ঢালাই লোহায় তৈরি। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি কাঠের।

গদিঘর নবকুঠি
বাড়ির সামনে নদীর পাড় ঘেঁষে আছে ‘নবকুঠি’। অনুমান করি এটি ছিল গদিঘর। নির্মাণকাল খোদাই করা আছে ১৩৪৬ বঙ্গাব্দ। যদুনাথ সাহার বংশের চতুর্থ প্রজন্ম দীপক চন্দ্র সাহার মেয়ে সোমা সাহা জানালেন, যদুনাথ সাহার ছিল পাঁচ ছেলেমেয়ে। তাঁদের মধ্যে চারজনকে আরো চারটি বাড়ি তৈরি করে দিয়েছিলেন পশ্চিমপাড়ায়, লোকজন বলে তেলিবাড়ি। আর জমিদার বাড়িটি দিয়ে যান ছোট ছেলে নবকুমারকে। তাঁদের অনেকে এখন মুর্শিদাবাদে থাকেন। প্রায় পৌনে ২০০ বছরের পুরনো বাড়িটিতে এখন পাঁচটি পরিবার বাস করে। বাড়ির পাশে একটি চায়ের দোকানে বসে ছিলেন বুড়ো শিবঠাকুর। বয়স এক শ-র কাছাকাছি। তিনি জানালেন, যদুনাথ ছিলেন মারোয়ারি ব্যবসায়ী। ব্যবসা করতেন সুপারি, লবণ আর শাড়ি কাপড়ের। বরিশাল থেকে কিনে চালান দিতেন কলকাতা ও মুর্শিদাবাদে।

নবকুঠির পশ্চিমে তেলিবাড়ি
নবকুঠি থেকে পশ্চিমের রাস্তা ধরে কিছু দূর পর বাঁয়ে গেছে আরেকটি রাস্তা। রাস্তার শেষ মাথায় আছে জোড়া পুকুর। পুকুরের ওপর তেলিবাড়ি, এখনকার নাম জজবাড়ি ও উকিলবাড়ি। ‘পুকুর দিয়ে যায় চেনা’ ধরনের পুকুরের আকার দিয়েই বাড়ির ঠমক ঠামক আন্দাজ হয় বান্দুরায়। কোনো কোনো বাড়িতে চার থেকে ছয়টি পুকুরও থাকত। ড. হুমায়ুন আজাদ ভাগ্যকুল জমিদারবাড়ির সৌন্দর্য বলেছেন এভাবে_’বাড়িতে রয়েছে বিশালাকৃতির দিঘি, নাটমন্দির, দুর্গামন্দির এবং এক পাশে রয়েছে সরকারি শিশু সদন। এখানে আছে হুবহু একই ধরনের দুটি দ্বিতল ভবন। বাড়িগুলোর সামনেই আছে দুটি পুকুর। পেশায় একজন জজ বাড়িটি কিনেছেন বলে এর নাম এখন জজবাড়ি। অন্যটি এক উকিল কিনেছেন, যার নাম হয়েছে উকিলবাড়ি।’
বাড়ির সামনে বাগান, বাগানের এক কোণে বেড়ায় ঘেরা জায়গায় চারটি হরিণ। এ বাড়িগুলোও গ্রিক ধাঁচে তৈরি। বারান্দার থামগুলোয় চিনিটিকরির (চিনামাটির ভাঙা থালার নকশা) ঝকমারি। বাড়ির দরজা-জানালা সবই কাঠের। তবে দরজার চেয়ে জানালার নকশা বেশি। বাড়ি দুটিকে বাঁয়ে রেখে আরেকটু এগোলে ভগ্নপ্রায় আরেকটা বাড়ি। এটি যে একসময় খুবই সুন্দর ছিল তা আন্দাজ করতে কষ্ট হয় না। বাড়িটি স্কুলঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। চারপাশ গাছে ছাওয়া। সামনের দিকে একটু তফাতে আছে দুটি সমাধিমন্দির। এখানে গোলাকৃতির দুটি কাচের ঘরে নাকি দুটি মূর্তি ছিল মালিকের। এখন একটি মূর্তি আছে, তবে মুণ্ডুহীন। আমরা মূর্তিতে মাথা লাগিয়ে ছবি তুলে গেলাম একে একে। এরপর চায়ের দোকানে পেট ভারী করার কাজ করলাম কিছুক্ষণ। কিছুক্ষণ কাছের একটা সেলুনে নরসুন্দরের কেরামতি দেখলাম। মাথাগুলো কী সুন্দর খালি করে দিচ্ছে!

খেলারাম দাতার বাড়ি
সামনে একটি বিরাট দিঘি। কাঠামোটাই আছে শুধু। দরজা-জানালা গায়েব হয়েছে বহু আগে। ভাঙা দেয়াল জানান দিচ্ছে, বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল চুন-সুরকি আর ছোট ইট দিয়ে। দোতলায় উঠলে বাড়িটিকে অন্য রকম লাগে। পুরো বাড়ির মধ্যখানে একটি বড় ঘর। ছাদে গম্বুজ আছে। লোকজন বলাবলি করে, ঘরটিতে টাকার মটকি আছে। মন্দিরাকৃতির এই ঘরের চারপাশে চারটি দোচালা ঘর। দোতলায় সব মিলিয়ে ঘর আছে ৯টি। দস্যু হলেও খেলারাম ছিলেন ধার্মিক। একটি ঘর ছিল মন্দির, দেয়ালের গায়ে লেখা দেখে বোঝা যায়। ‘হরে কৃষ্ণ, হরে রাম’ পুরো দেয়ালজুড়ে।
খেলারাম নাকি ধনীদের ধন লুট করে তা বিলিয়ে দিতেন গরিবকে। গায়ের লোক বিশ্বাস করে_বাড়িটি এক রাতের মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। ছিল নাকি ৯ তলা, সাত তলা মাটির নিচে দেবে গিয়ে এখন টিকে আছে মাত্র দুই তলা। বাড়িটির নিচতলা অন্ধকার। ঘরের ভেতর ছিল একটি সুন্দর চৌবাচ্চা। সেটি নিয়েও গল্প আছে_খেলারামের মা একবার আম-দুধ খেতে চেয়েছিলেন। মায়ের সাধ পূরণ করতে চৌবাচ্চা তৈরি করা হয়। সেই চৌবাচ্চায় দুধ আর আম ছেড়ে দিয়ে মাকে নামিয়ে দিয়েছিলেন। দাতার বাড়ির পুকুরটিও বিশাল। এক পাড়ে দাঁড়ালে অন্য পাড়ের মানুষের চেহারা বোঝা যায় না। দাতার মা অনেক গহনা পরতেন। গহনার ভারেই নাকি তাঁর জীবন গেছে_গোসল করতে পুকুরে নেমে আর উঠতে পারেননি।

এবার একটু ইতিহাস
ভাগ্যকুলের জমিদাররা ব্রিটিশ আমলে উপমহাদেশে প্রসিদ্ধ ছিলেন। জমিদারদের মধ্যে হরলাল রায়, রাজা শ্রীনাথ রায় ও প্রিয়নাথ রায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশের তাঁবেদারি করায় তাঁরা রাজা উপাধি পেয়েছিলেন। তাঁদের মতো ধনী বাঙালি পরিবার সে সময়ে কমই ছিল। জমিদারদের প্রায় সবাই উচ্চ শিক্ষিত ছিলেন। ঢাকা, কলকাতা এবং ইংল্যান্ডে তাঁরা পড়াশোনা করেছেন। জমিদারদের কীর্তির বেশির ভাগই পদ্মা কেড়ে নিয়েছে। জমিদার যদুনাথ রায়ের বাড়িটিই যা টিকে আছে।
‘অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন’ বাড়িটি রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে এখন। নির্মাণ করা হচ্ছে বিক্রমপুর জাদুঘর ও সংস্কৃতিকেন্দ্র। পর্যটনকেন্দ্র, গেস্ট হাউস এবং নৌ জাদুঘরও হবে। বালাসুর চৌরাস্তার কাছে ভাগ্যকুল বাজার। এখানকার মিষ্টি বেশ নামকরা। ভরপেট খেয়ে ঢাকার পথ ধরলাম।

error: দুঃখিত!