কয়েকদিন আগে একটি পত্রিকায় দেখলাম মাননীয় প্রধান বিচারপতি নাকি যানজট নিরসনের দাবিতে পায়ে হেঁটে অফিসে যাবেন বলে মন্তব্য করেছেন। প্রধান বিচারপতির এধরণের মন্তব্যই বলে দেয় ঢাকা শহরের প্রধান নাগরিক সমস্যা ‘যানজট’।
যে ব্যক্তি মিরপুর থেকে মতিঝিলে অফিস করেন তাকে সকাল দশটার অফিসের জন্য বাসা থেকে বের হতে হয় সকাল ৭টা বা সাড়ে ৭টার মধ্যে। আর সন্ধ্যা ৬টায় ছুটি হলে বাসায় ফিরতে হয় ৯টায়। তার মানে অফিসে যাওয়ার সময় ৩ঘণ্টা ও আসার সময় ৩ঘণ্টা মোট ৬ঘণ্টা অসহনীয় যানজটের মধ্যে গাড়িতে বসে নিয়তিকে দোষারোপ করে ও কর্তৃপক্ষকে গালমন্দ করেই ভোগান্তি সহ্য করতে হয়। ৮ঘণ্টা কর্মসময়ের বিপরীতে ৬ঘণ্টা যানজটের দুর্ভোগে ভোগার হ্যাপা যে কতটা তা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছাড়া অন্যদের পক্ষে কল্পনা করাও দুরুহ। এতে প্রতিদিন একজন চাকরিজীবীর ৬ঘণ্টা অতিরিক্ত শারীরিক ও মানসিক শ্রমের অপচয় হচ্ছে। মানুষের শারীরিক সক্ষমতার সীমবদ্ধতা আছে। ফলে ওই ব্যক্তি কর্মক্ষেত্রেও যে পরিমাণ শ্রম দেয়ার কথা স্বাভাবিকভাবেই তা দিতে পারছেন না। প্রতিষ্ঠান তার কর্মচারি / কর্মকর্তার কাছে উপযুক্ত শ্রম পাচ্ছে না।
চলন্ত গাড়িতে বসে থাকতে যত না বিরক্ত ও অস্বস্তি লাগে যানজটে আটকে থেকে গাড়িতে বসে থাকতে তার চেয়েও অনেক বেশি বিরক্ত ও অস্বস্তি লাগে। কারণ গাড়ি চলতে থাকলে শরীরের রক্ত চলাচলে খুব একটা বিঘ্ন ঘটে না। কিন্তু যানজটে আটকে থাকলে একটা আঁটোসাঁটো সিটে বসে থাকার কারণে শরীরের রক্ত চলাচল দারুণভাবে ব্যাহত হয়। ফলে, যানজটে আটকে থাকা ব্যক্তি অসুস্থ বোধ করেন। এমনকি সময়মত নাওয়া খাওয়াও করতে পারেন না। কারণ দুপুর ১টা থেকে ২টার মধ্যে লাঞ্চ করে রাত ৯টা পর্যন্ত কিছু না খেয়ে থাকলে একটানা ৭/৮ঘণ্টা উপবাস থাকা হয়। যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই বলা যায় যানজটে ঢাকা শহরের সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। অফিসের বাইরে সংসারের কোন কাজও কেউ করতে পারছেন না। এসকল সমস্যার মেরুকরণ ঘটে তার আয়ুষ্কালের ওপর। তাই বলা যায় ক্রমে ক্রমে নগরবাসি মানসিক ও শরীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে উঠছেন। যানজটের কারণে কর্মীর কাছে যথাযথ সেবা তার প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে না বলে পরোক্ষভাবে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
অন্যদিকে, মানুষের নানাবিধ শারীরিক কষ্ট ও রোগ বাড়ছে। এখন কথা হচ্ছে এই অসহনীয় যানজট কি ঢাকাবাসির জন্য অদৃষ্টের পরিহাস না মানবসৃষ্ট দুর্ভোগ? স্বীকার করতেই হয় যে বিপুল জনসখ্যার ভারে ন্যুজ ঢাকার যানজট নিরসন সহজসাধ্য নয়। আবার যানজটের স্থায়ী সমাধান করতে হলে মেগা পরিকল্পনা দরকার, সেটাও আছে বলে বাস্তবদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় না। কিন্তু তাই বলে কি আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবো? আমাদের কী কিছুই করার নেই? উত্তর আছে। ঢাকা উত্তরের মাননীয় মেয়র সাহেব বোধ করি এব্যাপারে খুবই আন্তরিক। এজন্য তিনি কিছু কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। যেমন কিছু কিছু রাস্তার অযাচিত ক্রসিং বন্ধ করে দেয়া, বেগুনবাড়ি থেকে অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ড উচ্ছেদ, শ্যামলী-গাবতলি রুটের রাস্তার দুই পাশ পার্কিংমুক্ত করা উল্লেখযোগ্য। মেয়র মহোদয়ের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। এই উদ্যোগের ফলে কিছুটা হলেও নগরবাসি সুফল ভোগ করতে শুরু করেছেন।
তবে কথা হচ্ছে দ্রুত সময়ের মধ্যে আর কী কিছুই করা যায় না? নিশ্চয়ই করার অনেক কিছুই আছে। কী করার আছে তা জিজ্ঞাসা করলে সবাই বলেন-ফুটপাত হকারমুক্ত করতে হবে ও বড় রাস্তায় ধীরগতির যান চলাচল বন্ধ করতে হবে। নিঃসন্দেহে এদুটো সিদ্ধান্তের বিপরীত দিকও আছে। কারণ তাতে প্রশ্ন উঠে-তাহলে ফুটপাতের স্বল্প আয়ের হকারদের উপার্জনের কী ব্যবস্থা হবে? তারা পরিবার পরিজন নিয়ে কীভাবে জীবন যাপন করবেন? আর ধীরগতির যান চলাচল বন্ধ করে দিলে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কিছুটা অসুবিধা হবে। যেমন রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালার উপার্জনের পথ কিছুটা সংকীর্ণ হয়ে যাবে, রোগী, বয়ষ্ক মানুষ ও শিশুদের জন্য অসুবিধা হবে। আবার কেউ কেউ বলেন প্রতিদিন যে বিপুল পরিমাণ প্রাইভেট কার রাস্তায় নামছে তা রোধ করতে হবে। হ্যাঁ, তা হয়তো করা যায়। গাড়ি ব্যবহারকারিদের উপর ও গাড়ির উপর উচ্চহারে কর ধার্য করা যেতে পারে। তাতে অরিহার্যতার গুরুত্ব বুঝে মানুষ গাড়ি ব্যবহার করবেন।
আবার হতে পারে যে প্রাইভেট গাড়ি, ও তার যন্ত্রাংশের দাম বাড়িয়ে দিয়ে গাড়ি বিলাসিতার লাগাম টেনে ধরা যেতে পারে। আবার কখনও কখনও শুনেছি যে, একেক ধরণের সিরিয়ালের নম্বরধারি গাড়ি একেক দিন ঢাকা শহরে চলাচলের অনুমতি দেওয়া হবে। তাতে সমস্যা আরো বাড়বে বৈ কমবে না। কারণ অনেকেই হয়তো অপরিহার্যতার বাইরেও বিলাসিতার জন্য গাড়ি ব্যবহার করেন, কিন্তু সেই অনেকের জন্য তো অপরিহার্য ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত বা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কাজে ব্যবহৃত গাড়ি বন্ধ করা যায় না। তাতে দেশের উন্নয়নের পথ বাধাগ্রস্ত হবে। আর যাদের সামর্থ সীমিত থাকার কারণে একটি মাত্র গাড়ি ব্যবহার করেন তাদের ক্ষেত্রে দুই ধরণের সমস্যা হবে। এক অতি প্রয়োজনের দিন যদি গাড়িটি বের করতে না পারেন তবে ভোগান্তি হবে। দুই স্কুলগামি শিশুদের জন্য ব্যবহৃত একমাত্র গড়িটি যদি হঠাৎ একদিন বের করতে না পারেন তবে স্কুলে যাওয়া আসার সমস্যা হবে। যা অমানবিকও বটে।
তাই বলে কী হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে? না, বৃহত্তর স্বার্থে কিছু ছোটো-খাটো অসুবিধা মেনে নিতে হবে। তবে তাত্ক্ষণিভাবে যানজট কমানোর জন্য তারচেয়েও ফলপ্রসূ ও সহজ কিছু পথ আছে। এই ফলপ্রসূ কাজটির প্রধান কাজ হচ্ছে সিগনাল ও বাসস্ট্যাণ্ড সমস্যা। যানজট প্রধানত বাঁধে সিগনালের কাছে ও বাসস্ট্যাণ্ডের কাছে। তাতে সহজেই বোঝা যাচ্ছে সিগনাল ও স্ট্যাণ্ডই যানজটের প্রধান কারণ। সিগনালের সাথে ট্রাফিকের সম্পর্ক নিবিড়। অভিজ্ঞতা বলে কিছুদিন আগেও মিরপুর শেওড়াপাড়া থেকে মিরপুর ১২নং পর্যন্ত অসহনীয় যানজটে পড়তে হতো। কিন্তু পুরবী সিনেমা হলের সামনে দিয়ে কালশি রোডে ঢোকার রাস্তাটি বন্ধ করে দেয়া ও আরো কিছু ছোট ছোট পাসিং বন্ধ করে দেয়ার কারণে ১০নং গোলচত্বরের পর থেকে যে অসহনীয় যানজট বাঁধতো তার ৯০%কমে গেছে। তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে যানজটের অন্যতম প্রধান কারণ পাসিং-ক্রসিং। এখন কথা হচ্ছে এই পাসিং-ক্রসিং সমস্যার সমাধান কী? সহজ সমাধান হচ্ছে এগুলো বন্ধ করে দেয়া। তাই বলে সব পাসিং-ক্রসিংই তো আর বন্ধ করা যাবে না। যেমন মিরপুর ১০নং এর গোলচত্বর মিরপুরের বিষফোঁড়া। তাই বলে তো এই বিষফোঁড়া বন্ধ করা সম্ভব নয়।
তাহলে কী করণীয়? করণীয় হলো এসকল অতি প্রয়োজনীয় পাসিং-ক্রসিংগুলো আন্ডারপাসিং ও ওভারপাসিং করে দিতে হবে। এটা সময় ও অর্থ সাপেক্ষ ব্যাপার। তাহলে তাত্ক্ষণিক করণীয় কী? তাত্ক্ষণিক করণীয় ট্রাফিকিং ঠিক করা, মানে ট্রাফিক আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ করা। এসকল গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোর সিগনালের আগে ও পরে কমপক্ষে দুই/তিনশ গজের মধ্যে কোন ধরণের যাত্রী উঠা-নামা করানো চলবে না। এই একটি মাত্র আইন প্রয়োগে কঠোর হলেই যানজট অনেকাংশে কমে আসবে। তবে মনে রাখতে হবে কোন অবস্থাতেই এই দুই / তিনশ গজের মধ্যে সিগনালে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলেও যাত্রী ওঠা-নামা করা যাবে না।
অরেকটা সমস্যা হলো বাসস্ট্যাণ্ড। ঢাকা শহরের সারা রাস্তাই যেন বাসস্ট্যাণ্ডে পরিণত হয়েছে! যাত্রী যেখানে দাঁড়িয়ে হাত উঁচু করছেন ড্রাইভার সেখানেই রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠাচ্ছেন! আবার যেখানে নামতে চাচ্ছেন সেখানেই নামানো হচ্ছে! এক্ষেত্রে ড্রাইভারেরা পেছনের গাড়িকে সাইড না দিয়ে বরং রাস্তা বন্ধ করে দাঁড়াচ্ছেন! ভাবখানা এমন রাস্তায় যেন একমাত্র তিনিই গাড়ি চালাচ্ছেন! ড্রাইভার সাহেব এটা করেন পরিকল্পিতভাবেই। কারণ তিনি পিছনের সকল গাড়ির আগে যেতে চান এবং রাস্তায় অপেক্ষমান সকল যাত্রী একাই বহন করতে চান! যাতে ভাড়া বেশি আদায় করতে পারেন। অতি লোভ আর কি! তাই নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর বাসস্ট্যাণ্ড করতে হবে। এবং বাসস্ট্যাণ্ডের বাইরে সকল ধরণের যাত্রী ওঠা-নামা বন্ধ করতে হবে।
ভালো হয় যদি বাসস্ট্যাণ্ড গুলো মূল রাস্তার বাইরে করা যায়। প্রয়োজনে বাসস্ট্যাণ্ড গুলোর কাছে আণ্ডার পাস ওভার পাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বাসস্ট্যাণ্ডে গাড়ি দাঁড় করিয়ে ডেকে ডেকে যাত্রী উঠানো যাবে না। কোন বাস নির্দিষ্ট লেনের বাইরে কোন অবস্থাতেই দাঁড়াতে পারবে না। আর শুধুমাত্র যাত্রী উঠা-নামার জন্য ন্যূনতম যেটুকু সময় না হলেই নয় কেবলমাত্র সেই সময়টুকুই বাস স্ট্যাণ্ডে দাঁড়াতে পারবে।
যতদিন আন্ডার পাস ওভার পাসের ব্যবস্থা করা না যাচ্ছে ততদিন অন্তত এই আইনগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর থেকে কঠোরতর হতে পারলেও যানজট অনেক কমে আসবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, আইন প্রয়োগে কোন রকমের শৈথিল্য দেখালে এর সুফল ভেস্তে যাবে।
নূরুজ্জামান : লেখক, কলামিস্ট।
nuruzzaman7585@gmail.com