১৯৭৫-এর ১৬ আগস্ট। এ দিন ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে দুপুরে টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ এসে পেঁৗছায়। কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে হেলিকপ্টার থেকে কফিন নামিয়ে টুঙ্গিপাড়া সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন ম্যানেজার কাসেম, ক্যাশিয়ার (নাম জানা যায়নি), আবদুল হাই মেম্বার, আকবর কাজী, মো. ইলিয়াস হোসেন, জহর মুন্সি, সোনা মিয়া কবিরাজ, শেখ নুরুল হক গেদু মিয়া, সোহরাব মাস্টারসহ কয়েকজন তার পৈতৃক বাড়িতে লাশ বহন করে আনেন। কফিন খুলে লাশ বের করে ৫৭০ সাবান দিয়ে গোসল করানো হয়। রেড ক্রিসেন্টের রিলিফের কাপড় দিয়ে কাফন পরানো হয়। জানাজা শেষে পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা শেখ সাহেরা খাতুনের কবরের পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। জানাজা ও দাফন শেষে বিশেষ মোনাজাত পরিচালনা করেন মরহুম মৌলভী আবদুল হালিম। দাফন অনুষ্ঠানে টুঙ্গিপাড়া, পাটগাতী ও পাঁচকাহনিয়া গ্রামের ৩০-৩৫ জন অংশ নেন। সেনা ও পুলিশ হেফাজতে তড়িঘড়ি করে এ কাজ সম্পন্ন করা হয়। জানাজায় গ্রামবাসী অংশগ্রহণ করতে চাইলেও দেওয়া হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর দাফনকারী টুঙ্গিপাড়া পৌরসভার মেয়র মো. ইলিয়াস হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে শুনেই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসি। সেদিন টুঙ্গিপাড়ার মানুষ শোকে বিহ্বল হয়ে পড়ে। দুপুরের দিকে টুঙ্গিপাড়া থানা সংলগ্ন হ্যালিপ্যাডে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে আসা হয়। কফিন বহন করার জন্য আমাদের ডাকা হয়। আমরা হেলিকপ্টারের মধ্য থেকে কফিন বের করি। পরে কফিন বহন করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে আসি। এর পর সেনাসদস্যরা কফিনসহ লাশ কবর দেওয়ার কথা বলে। মরহুম মৌলভী আবদুল হালিম লাশ না দেখে দাফন করতে আপত্তি জানান। একজন মুসলমানকে ইসলামী বিধিবিধান মেনে দাফনের দাবি জানান। সেনা অফিসাররা ১৫ মিনিটের মধ্যে লাশ দাফনের অনুমতি দেন। পরে কফিন খোলা হয়। বঙ্গবন্ধুর বুক গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। গুলিগুলো বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে। হাতেও গুলি লেগেছিল। তখনও তার শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছিল। গায়ে ছিল সাদা গেঞ্জি ও পাঞ্জাবি। পরনে ছিল সাদা চেক লুঙ্গি। পাঞ্জাবির এক পকেটে ছিল চশমা ও প্রিয় পাইপ। আইয়ুব মিস্ত্রিকে দিয়ে কফিন খুলিয়ে লাশ বের করে আনা হয়। আশরাফ মোল্লার দোকান থেকে একখানা ৫৭০ সাবান কিনে আনা হয়। এ সাবান দিয়ে শেখ আবদুল মান্নাফ, সোনা মিয়া, ইমান উদ্দিন গাজী বঙ্গবন্ধুকে গোসল করান। টুঙ্গিপাড়া শেখ সাহেরা খাতুন রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে রিলিফের মালা শাড়ি আনা হয়। শাড়ির লাল ও কালো পাড় ছিঁড়ে কাফনের কাপড় বানানো হয়। এ কাপড় পরিয়ে জানাজা দেওয়া হয়। জানাজা শেষে তাকে বাবা ও মায়ের কবরের পাাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। লাশ দাফন শেষে সেনাসদস্যরা ডায়েরিতে শেখ আবদুল মান্নাফের স্বাক্ষর গ্রহণ করে চলে যায়।
টুঙ্গিপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আবুল বশার খায়ের বলেন, বঙ্গবন্ধুকে দাফনের জন্য আগে থেকেই টুঙ্গিপাড়ায় কবর খুঁড়ে রাখা হয়। তাকে দাফনে গ্রামের মানুষ অংশ নিতে এগিয়ে আসেন।
কিন্তু পথেই পুলিশ, সেনাসদস্যরা তাদের বাধা দিয়ে আটকে দেয়। তারা দাফনে অংশ নিতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর গোসল, জানাজা ও দাফনে টুঙ্গিপাড়া, পাঁচকাহনিয়া ও পাটগাতী গ্রামের ৩০-৩৫ জন অংশ নেন। কবর দেওয়ার পর সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। কবরের কাছে কাউকে ঘেঁষতে দেওয়া হতো না। টুঙ্গিপাড়াবাসী বঙ্গবন্ধুর জন্য মিলাদ ও কোরআনখানির আয়োজন করে।
ওই দিন বঙ্গবন্ধুর দাফনে অংশ নিতে টুঙ্গিপাড়া আসতে গেলে পথেই আবুল বশার খায়েরকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজন আটকে দেয়। দাফনের পর বঙ্গবন্ধুর কবর জিয়ারত বা শ্রদ্ধা নিবেদন নিষিদ্ধ ছিল। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদনে গিয়ে অনেকেই পুলিশের হাতে নাজেহাল হয়েছেন। তার পরও পুলিশের বাধা অতিক্রম করে বঙ্গবন্ধুর অনুরাগীরা কবরে এসে তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে লাশ টুঙ্গিপাড়া গ্রামে দাফন করে ওরা বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলতে চেয়েছিল। তাদের সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বঙ্গবন্ধু শ্রেষ্ঠ বাঙালি হয়েছেন। জীবিত বঙ্গবন্ধুর চেয়ে মৃত বঙ্গবন্ধু বাঙালির শানিত চেতনায় চিরঅম্লান হয়ে রয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধকে ঘিরেই নিভৃত টুঙ্গিপাড়া গ্রাম এখন নবালোকে উদ্ভাসিত। জাতির পিতার সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স টুঙ্গিপাড়াকে বদলে দিয়েছে। টুঙ্গিপাড়া এখন বাঙালি জাতির তীর্থস্থান।
টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বাইগার নদীর পাড়ে গড়ে উঠেছে সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স। লাল সিরামিক ইট আর সাদাকালো টাইলস দিয়ে গ্রিক স্থাপত্য শিল্পের আদলে নির্মিত সমাধিসৌধের কারুকাজে ফুটে উঠেছে বেদনার করুণ চিত্র। কমপ্লেক্সের সামনের দু’পাশের উদ্যান পেরোনোর পরই বঙ্গবন্ধুর কবর। পাশে তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা শেখ সাহেরা খাতুনের কবর। এই তিন কবরকে ঘিরেই নির্মাণ করা হয়েছে সমাধিসৌধের মূল স্তম্ভ। সাদা পাথর দিয়ে গোলাকার এক গম্বুজবিশিষ্ট সমাধিসৌধের ওপরের দেয়ালে জাফরিকাটা। এই জাফরি দিয়েই সূর্যের আলো প্রবেশ করে । ওপরে কাচের কারুকাজ দিয়ে আলো ছড়িয়ে পড়ে কবরে। চারদিকে কালো টাইলস ও মাঝখানে শ্বেতশুভ্র টাইলসে বঙ্গবন্ধুর কবর বাঁধানো। ওপরের অংশ ফাঁকা। কবর তিনটি ঘিরে রাখা হয়েছে সংক্ষিপ্ত রেলিং দিয়ে। প্রতিদিন রেলিংয়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে শত শত শোকার্ত মানুষ বঙ্গবন্ধুর প্রতি হৃদয়ের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছেন। সেখানে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার পর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালির জন্য দোয়া ও মোনাজাত করেন। শোকে বিহ্বল এসব মানুষের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে বেদনার অশ্রু।
বঙ্গবন্ধুর সমাধিসৌধ কমপ্লেক্সে রয়েছে বঙ্গবন্ধু ভবন, পাঠাগার, সংগ্রহশালা, গবেষণা কেন্দ্র, প্রদর্শনী হল, মসজিদ, পাবলিক প্লাজা, প্রশাসনিক ভবন, ক্যাফেটারিয়া, উন্মুক্ত মঞ্চ, বকুলতলা চত্বর, স্যুভেনির কর্নার, প্রশস্ত পথ, মনোরম ফুলের বাগান, কৃত্রিম পাহাড় ও ঝর্ণাধারা। পাশেই রয়েছে বঙ্গবন্ধুর পিতৃপুরুষের আদি বাসভবন।