২৪শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
শুক্রবার | সন্ধ্যা ৬:১৫
পদ্মায় কোটি কোটি টাকার বালু বাণিজ্য, সেতু ঘিরে ড্রেজার ও বাল্কহেডের মহড়া
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ২৯ নভেম্বর, ২০২২, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)

মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলা ও শরীয়তপুরের শিবচর ও জাজিরা এলাকার পদ্মা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে সেতুর আশপাশ ঘিরে নদী থেকে ড্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলন ও প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার বালু বাণিজ্যে মেতে উঠেছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট।

প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে নানা কৌশলে বালু বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে দুবৃত্তরা। সেতু কতৃপক্ষের অনুমোদনের দোহাই দিয়ে বৈধ-অবৈধ ৪০-৫০টি ড্রেজারের মাধ্যমে নদী থেকে প্রতিদিন দেড় থেকে ২ কোটি ঘনফুটের বেশি বালু বিক্রির উদ্দেশ্যে তুলে নেয়া হচ্ছে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে রীতিমত ড্রেজার ও বাল্কহেডের মহড়ায় শঙ্কা প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।

বালু উত্তোলন ছাড়াও পদ্মায় অবৈধ বাল্কহেড চলাচল ঠেকাতে প্রশাসন, নৌ-পুলিশ কিংবা কোস্ট গার্ডের কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। ছবি: আমার বিক্রমপুর।

গতকাল সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, জেলার লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়াঘাটের অদুরে ও শরীয়তপুরের শিবচর ও জাজিরা এলাকায় পদ্মা সেতুর ২৫ থেকে ৩০ নং পিলার বরাবর ২০০ মিটারের মধ্যে ৪০-৫০টি ড্রেজার ব্যবহার করে বালু উত্তোলন করে বিক্রির উদ্দেশ্যে বাল্কহেডে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

অনুমোদিত ড্রেজারের পাশাপাশি একাধিক অননুমোদিত ড্রেজার পদ্মার বুক থেকে অবাধে বালু উত্তোলনের পর সেগুলো বাল্কহেডে করে বিক্রি করছে। ছবি: আমার বিক্রমপুর।

পদ্মা নদীর লৌহজং অংশ হয়ে বালুবাহী বাল্কহেডগুলো চলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের নদী শাসন কাজের জন্য ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সিনোহাইড্রো করপোরেশন এর কাজের সুবিধার্থে পদ্মা সেতুর ২৭নং পিলার থেকে ৩৮নং পিলার পর্যন্ত ৭নভেম্বর হতে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এম এস চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ ও নুর বিজনেস লাইন নামের দুইটি বালি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ১৬ টি ড্রেজারকে বালু কাটার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সূত্রটি জানিয়েছে, মূল সেতু ও নদীশাসন কাজের সুবিধার্থে ১৬টি ড্রেজারকে বালু উত্তোলনের অনুমতি প্রদান করা হলেও এই বালু তারা বিক্রি করতে পারবে না।

প্রতিদিন পদ্মার তলদেশের কোটি কোটি ফুট বালু লুটে নেওয়া হচ্ছে। এতে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে না। ছবি: আমার বিক্রমপুর।

নিয়ম অমান্য করে বালু বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে এম এস চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী চৌধুরী জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বালু বিক্রির সাথে আমরা জড়িত নই। বৈধ বালু উত্তোলনকারী ছাড়াও এখানে অবৈধভাবে অনেকে বালু উত্তোলন করছে। তারা বিক্রি করে থাকতে পারে। আমরা বালু বিক্রি করি না। চায়নিজদের প্রজেক্ট আছে সেখানে দেই। হয়তো বিক্রি করি-মিথ্যা কথা বললে ভুল হবে। খুব রেয়ার কেস-আমরা বিক্রি করি।’

তিনি বলেন, আমি প্রশাসনকে বলেছি এদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে। আমার ১৬টা ড্রেজারের সাথে অনেকে নেমে যায়। দূূর থেকে তারাও দেখে চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ লেখা। কিন্তু অবৈধ ড্রেজারের গায়ে লেখা নাই।’

জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমি নিক্সন চৌধুরীর বড় ভাই। আমাদের ওয়াদাবদ্ধ, আমরা মানুষের কাছে, জাতীর কাছে ২ নাম্বারি করে, ঝগড়া করে আমরা কোন কাজ করবো না। ২ নাম্বারি করে আমি বালু তুলতে যাবো কেন? এর চেয়ে কত বড় বড় কাজ আমাদের কাছে আছে ‘

নিক্সন চৌধুরী নামে পরিচিত মজিবুর রহমান চৌধুরী ফরিদপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য। তার বড় ভাই নূর-ই-আলম চৌধুরী মাদারীপুর-১ আসনের সংসদ সদস্য। তিনি জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ। এছাড়াও নিক্সন চৌধুরীর আরও ২ ভাই রয়েছেন। তারা হলেন, লিপন চৌধুরী ও লিখন চৌধুরী।

জালাল উদ্দিন আহমেদ নিক্সন চৌধুরীর চাচাতো ভাই বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। এ বিষয়ে মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

বালু উত্তোলনের বিষয়ে জানতে চাইলে পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান আব্দুল কাদের জানান. পদ্মা সেতুর ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের টেষ্ট পাইল ড্রাইভের যন্ত্রাংশ নদীর তলদেশ থেকে উঠানোর জন্য ১৬ টি ড্রেজারকে বালু উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছে পদ্মা সেতু কতৃপক্ষ। সেতুর নির্দিষ্ট পিলার তথা ২৭ থেকে ৩৮ নং পিলারের ২৫০ মিটারের মধ্যে ওই ড্রেজার গুলো বালু উত্তোলন করবে শুধুমাত্র। বালু তুললে সেতুর কোন ক্ষতি হবে না। তবে এই বালু বিক্রি করতে পারবে না। তিনি বলেন, ১৬ টি ড্রেজারের বাইরে যা আছে-তা সব অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

লৌহজং উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আব্দুল আউয়াল বলেন, আমাদের পক্ষ হতে পদ্মা নদীর মুন্সিগঞ্জ অংশে কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে বালু মহালের ইজারা দেওয়া হয়নি। গেল ৬ মাসের তথ্য যদি দেখা যায় তবে অবৈধ বালু উত্তোলন, অবৈধ ড্রেজার বা অবৈধ বাল্কহেড যা-ই বলুন বিভিন্ন সময়ের অভিযানে ৭৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ১৫০ টি নৌযান চলাচলের অনুপযোগী করে দেয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের মাওয়া স্টেশন কমান্ডার বুলবুল আহমেদ বলেন, আমরা অভিযানে গেলেই ড্রেজার ও বাল্কহেডগুলো সেতু কর্তৃপক্ষের অনুমোদনের কাগজপত্র দেখাচ্ছে। এতে আমরা কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারছি না।

পদ্মা নদী জুড়ে অবাধে বাল্কহেড চলাচলের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নৌ-পুলিশের অতিরিক্ত আইজি শফিকুল ইসলাম বলেন, এর আগেও ড্রেজারের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়েছি। বরাবরই সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে সেগুলো তাদেরই। তিনি আরও বলেন, অবাধে বাল্কহেড চলাচল আর করবে না। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

error: দুঃখিত!