বাংলাদেশ কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহের মতে, কন্ডিশনের ভাবনা থাকে না দল সাজানোয়। একাদশ বেছে নেওয়া হয় নিজেদের শক্তির জায়গা অনুযায়ী। প্রাসঙ্গিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, বাংলাদেশের শক্তির জায়গা কোনটি? গত কয়েকটি টেস্টের একাদশ এ নিয়ে শুধু বিভ্রান্তিই বাড়াচ্ছে।
গত কয়েকদিন ধরেই চট্টগ্রামের আকাশ কেঁদে চলেছে অবিরাম। উইকেটও তাই ঢাকা, রোদের ছোঁয়া পেয়েছে সামান্যই। সোমবার রাতে বা মঙ্গলবার সকালে যদি আর বৃষ্টি নাও হয়, তবুও হয়ত শুরুতে চেনা চেহারায় থাকবে না চট্টলার উইকেট। এই সময়ের উইকেট বলে ময়েশ্চার হয়ত থাকবে না, তবে শুরুর দিনে উইকেট কিছুটা নরম থাকবে তো বটেই।
ম্যাচের আগের দিন তাই বাংলাদেশের সম্ভাব্য একাদশ নিয়ে ডালপালা মেলল অনেক গুঞ্জন। মেঘলা আকাশ, আর্দ্রতা, উইকেট সব মিলিয়ে তিন পেসার খেলাবে কিনা বাংলাদেশ, এমন প্রশ্ন উঠল জহুর আহমেদ চৌধুরীর স্টেডিয়ামের সংবাদ সম্মেলনে।
কিন্তু এই প্রশ্নে কোচ চন্দিকা হাথুরুসিংহের উত্তরে পাত্তাই পেল না কন্ডিশন।
“আমরা কন্ডিশন ভেবে দল সাজাই না। নিজেদের শক্তির জায়গা ভেবে মাঠে নামি। কন্ডিশনতো ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে বদলে যেতে পারে। স্পিন যদি আমাদের শক্তির জায়গা হয়, তাহলে একাদশে স্পিনারই বেশি থাকবে। সবকিছু ভেবে আমরা আগামীকাল সকালে (মঙ্গলবার) সিদ্ধান্ত নেব।”
ভারতের বিপক্ষে সবশেষ টেস্টের একাদশ বলছে, বাংলাদেশের মূল শক্তি স্পিন। ফতুল্লা টেস্টে বাংলাদেশের একাদশে ছিল তিনজন স্পেশালিস্ট স্পিনার। শুভাগত হোমকেও বিবেচনায় নিলে সংখ্যাটি ছিল আসলে চারজন। নির্বাচকদের চোখে শুভাগত তো তখন দেশের সেরা অফ স্পিনার।
এবার ১০ মাস পেছনে যাওয়া যাক। গত সেপ্টেম্বরে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে সেন্ট লুসিয়া টেস্টে খেলেছিলেন মাত্র একজন স্পেশালিস্ট স্পিনার; তাইজুল ইসলাম। নিষেধাজ্ঞার কারণে ছিলেন না সাকিব আল হাসানও। বাংলাদেশের একাদশে ছিল তিন স্পেশালিস্ট পেসার! কোচের সূত্র অনুয়ায়ী, তখন কি তাহলে বাংলাদেশের শক্তির জায়গা ছিল পেস বোলিং? ১০ মাসের ব্যবধানে বদলে যাচ্ছে শক্তির জায়গা!
নিজেদের শক্তি অনুযায়ী একাদশ সাজানো একটা পন্থা হতে পারে অবশ্যই। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সেটার কার্যকারিতাও পরখ করে দেখা যেতে পারে। কিন্তু সবার আগে নিজেদের শক্তির জায়গাটা জানতে তো হবে! বাংলাদেশের শক্তির জায়গা কোনটি? কিংবা আদতেও কি টেস্টে বাংলাদেশের শক্তির কোনো জায়গা আছে?
ঐতিহ্যগতভাবে স্পিনটাকেই মনে করা হয় বাংলাদেশের শক্তির জায়গা। অথচ নির্বাচকদের শুভাগত তত্ত্ব বাদ দিলে বাংলাদেশ তিন স্পেশালিস্ট স্পিনার একসঙ্গে খেলিয়েছে মাত্র একবারই, সবশেষ টেস্টে ভারতের বিপক্ষে। ওই টেস্টে সাকিব ও জুবায়ের হোসেন ভালো বোলিং করেছিলেন।
কিন্তু ওই ম্যাচে ২০ ওভারে ৮৫ রান দিয়েছিলেন তাইজুল, পাননি কোনো মেডেন। শুভাগত ১৪ ওভারে রান দিয়েছিলেন ৫২, পাননি মেডেন। স্পিনারে ঠাসা দল গড়ে লাভ হয়নি, ভারত রান তুলেছিল ওভারপ্রতি সাড়ে চার করে।
আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরেই প্রথম টেস্টে বাংলাদেশের একাদশে ছিল দুই পেসার, শুভাগতকে নিয়ে দুই স্পিনার। পরের টেস্টেই হয়ে গেল তিন পেসার, এক স্পিনার। দেশের মাটিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজটায় একটু স্থিতিশীল ছিল দল। স্পিনে দুর্বল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে স্পিন দিয়েই বাজিমাত করেছিল বাংলাদেশ।
এ বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই টেস্টেই পেস, স্পিনের সমন্বয় ছিল। দুই পেসার, দুই স্পিনার। ভারতের বিপক্ষে টেস্টেই আবার পেসার নেমে এসেছে একটিতে।
এই বছরের তিন টেস্টে আসলে বাংলাদেশ দিয়েছে নতুন একটি বার্তা। তিন টেস্টেই বাংলাদেশ খেলিয়েছে ৮ ব্যাটসম্যান! নানা সময়ে নানা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের কোচ-অধিনায়ক বলেছেন, বাংলাদেশের শক্তির জায়গা ব্যাটিং। কিন্তু এই ব্যখ্যাও ভীষণরকম বিভ্রান্তিকর।
ব্যাটিংটাই শক্তির জায়গা হলে ৮ ব্যাটসম্যানের একাদশ কেন? ৬ ব্যাটসম্যানই যথেষ্ট হওয়ার কথা! শক্তির জায়গায় তো বাড়তি রসদ প্রয়োজন নেই, বরং দুর্বল জায়গায় বাড়ানোর কথা লোকবল।
বাংলাদেশের একেকটি ম্যাচের একাদশ তাই আসে বিভ্রান্তি নিয়ে। একাদশ সাজানোয় দল সংশ্লিষ্টদের ব্যাখ্যাগুলি আরও বিভ্রান্তিকর। নিজেদের শক্তির জায়গা নিয়ে খেলার ভাবনা থাকতেই পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে ভাবনার প্রতিফলন মাঠের পারফরম্যান্সেও থাকা জরুরি। নইলে শক্তির জায়গাটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়; বার্তাটাও ভুল দেওয়া হয়। শুধু শক্তির জায়গা নয়, উইকেট-কন্ডিশন-প্রতিপক্ষ-পরিস্থিতি, সব ভাবনার মিশেলও থাকা উচিত একাদশে।
তবে সবকিছুরই শেষ আছে। শেষেরই পরই আছে নতুন শুরু। দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজ বাংলাদেশের জন্য খুলে দিচ্ছে সেই সুযোগের দুয়ার। ব্যাটিং হোক বা স্পিন, শক্তি জায়গা যেটাই হোক, মাঠে সেটা প্রমাণ করার উপযুক্ত সুযোগ এবার। টেস্ট র্যাঙ্কিয়ের শীর্ষ দলের বিপক্ষে প্রমাণ করতে পারলে টেস্টে বাংলাদেশের ভবিষ্যতের পথচলায় সেটি হবে দারুণ পাথেয়।
“বাংলাদেশের শক্তির জায়গা কোনটি?” – সিরিজ শুরুর এই প্রশ্নের উত্তর যদি মেলে সিরিজ শেষে, সেটিই হবে হয়ত এই সিরিজ থেকে বাংলাদেশের বড় প্রাপ্তি!