২০শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
সোমবার | সকাল ১১:০২
ঈদে মুন্সীগঞ্জে কোথায় যাবেন, কি খাবেন!
খবরটি শেয়ার করুন:

শেখ রাসেলঃ

ঐতিহাসিক জনপদ বিক্রমপুর, স্বাধীন বাংলার রাজধানী বিক্রমপুর। ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর বিক্রমপুর। এক সময় ছিল ঢাকার দক্ষিণ থেকে বরিশালের উত্তর পর্যন্ত। পশ্চিমে পদ্মা থেকে মেঘনা, বহ্মপুত্র জলরাশি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। গুপ্তবংশ, চন্দ্রবংশ, বর্মবংশ, পালবংশ ও সেন বংশীয় পর্যায়ক্রমে রাজাদের রাজধানী ছিল বিক্রমপুর। প্রাচীন বাংলার ইতিহাসে বিক্রমপুর নানা কারণে বিখ্যাত। বর্তমানে এ অঞ্চলটি মুন্সীগঞ্জ জেলা হিসেবে পরিচিত। এ জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে আছে অনেক প্রাচীন নিদর্শন। বাংলার প্রাচীন রাজধানী বিক্রমপুরের সেই জৌলুস এখন তেমন আর নেই। কিন্তু ইতিহাস প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শন এখনও প্রাচীন বিক্রমপুরের কথা মনে করিয়ে দেয়। তাই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের লীলাভূমি বিক্রমপুরে ঈদের ছুটিতে কোথায় যাবেন এবং কি খাবেন তা নিয়ে ‘আমার বিক্রমপুর’ এর এই বিশেষ আয়োজন।

মুন্সীগঞ্জ জেলায় বর্তমানে ছয়টি উপজেলা রয়েছে। মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা, টঙ্গিবাড়ী উপজেলা, লৌহজং উপজেলা, শ্রীনগর উপজলা ও গজারিয়া উপজেলা।

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় আসলে ঘুরতে যেতে পারেন ইদ্রাকপুর দুর্গে। মুন্সীগঞ্জ শহরের অন্যতম ঐতিহাসিক নিদর্শন এই ইদ্রাকপুর দুর্গ। জলদস্যু ও পর্তুগিজদের আক্রমণ থেকে বাংলার রাজধানী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জসহ সমগ্র এলাকাকে রক্ষা করার জন্য এই দুর্গ নির্মিত হয়। বাংলার সুবেদার ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে বর্তমান মুন্সীগঞ্জ জেলার মেঘনা, ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যা নদীর সঙ্গমস্থলের পশ্চিম তীরে
ইদ্রাকপুর নামক স্থানে দুর্গটি নির্মাণ করেন। এটি মোগল স্থাপত্যের অনন্য সাক্ষী।

সুউচ্চ প্রাচীর বিশিষ্ট এই দুগেস্খর প্রতিটি কোনায় রয়েছে একটি বৃত্তাকার বেষ্টনী। দুগ্রের মাঝে মূল দুর্গ ড্রামের মতো দেখতে। দুর্গের প্রাচীর শাপলা ফুলের পাপড়ির মতো ছড়িয়ে আছে ও প্রতিটি পাপড়িতে ছিদ্র রয়েছে। ছিদ্র দিয়ে শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য বন্দুক ও কামান ব্যবহার হতো। মূল প্রাচীরের পূর্ব দেয়ালের মাঝামাঝি অংশে ৩৩ মিটার ব্যাসের একটি গোলাকার উঁচু মঞ্চ রয়েছে, দূর থেকে শত্রু চলাচল পর্যবেক্ষণের জন্য এটি তৈরি করা হয়েছে। দুগ্রের উত্তরদিকে প্রাচীর মূল বিশালাকার প্রবেশপথ রয়েছে। এই দুগ্রের প্রবেশপথের পাশেই একটি সুড়ঙ্গ পথ রয়েছে। কথিত আছে, এই সুড়ঙ্গ পথ দিয়ে ঢাকা লালবাগের দুর্গে যাওয়া যেত। এই দুর্গ দেখতে এসে খেতে পারেন মুন্সীগঞ্জ লঞ্চঘাটে অবস্থিত নদীঘেষা মুন্সীগঞ্জের স্বনামধন্য ‘মুন্সীগঞ্জ রেস্তোরায়’। যে কোন রিক্সাওয়ালাকে বললেই সেখানে নিয়ে যাবে। ভাড়া মাত্র ১০-১৫ টাকা। এছাড়াও দুর্গের পাশে কাচারী মোড়ে নিরিবিলি পরিবেশে ‘জিপসি ফাষ্টফুডে’ বসে সময় কাটাতে পারেন। জিপসির মনোরম পরিবেশ আপনাকে মুগ্ধ করে তুলবে। কাচারী মোড়েই খেতে পারেন বিখ্যাত ‘তাকওয়ার ফুচকা’। দামও বেশি নয় মাত ৩০টাকা প্লেট। তবে জিভে লেগে থাকবে বেশ কয়েকদিন।

মেঘনা ভিলেজঃ মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়া উপজেলার মেঘনা ব্রিজ থেকে এক কিলোমিটার দূরে অবস্থিত মেঘনা ভিলেজ রিসোর্ট।
বৈশিষ্ট্য
মেঘনা ভিলেজ রিসোর্টটি গ্রামের মতোই সবুজ শ্যামল। এখানে থাকা-খাওয়া এবং বিনোদনের সব ব্যবস্থাসহ রয়েছে এসি-ননএসি উভয় প্রকার কটেজ। আর এখানকার প্রতিটি ঘর একটু ভিন্নভাবে তৈরি করা হয়েছে, যা দেখতে অনেকটাই নেপালি কটেজের মতো। এখানে রয়েছে একটি বড় সবুজ মাঠ। যেখানে ইচ্ছে করলেই খেলাধুলায় মেতে ওঠা যায়। রয়েছে ফুটবল, ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টনসহ প্রচলিত বিভিন্ন খেলার সামগ্রী। রাতে আরাম কেদারায় বসে চাঁদ দেখতে চাইলে সেই ব্যবস্থাও রয়েছে।

রিসোর্ট ভাড়া ও অন্যান্যঃ
কর্পোরেট হাউজ রিজার্ভ পিকনিক (২টি ননএসি কটেজ ও পিকনিক জোনসহ) ৪৫,০০০ টাকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রিজার্ভ পিকনিক (২টি ননএসি কটেজ ও পিকনিক জোনসহ) ৩৫,০০০ টাকা, বার-বি-কিউ (৪০ জন পর্যন্ত) ৬০,০০০ টাকা, পুকুরে মাছ শিকার ১ কেজি রুই ৩০০ টাকা, তেলাপিয়া ৫০ টাকা প্রতিটি, পুকুরপাড়ে মাছের বার-বি-কিউ ২৫ টাকা, নন-হলিডে ডিসকাউন্ট ২৫%।

যাতায়াত ভাড়াঃ
ঢাকা থেকে কুমিল্লা অথবা দাউদকান্দিগামী বাসের ভাড়া ৫০-৭০ টাকা। যাত্রাবাড়ী থেকে ট্যাক্সি ক্যাব করে ১,০০০ টাকা। অটোরিকশায় ভাড়া ৩০০ টাকা। এছাড়া রিসোর্টের নিজস্ব পরিবহনে আসা-যাওয়ায় সর্বসাকুল্যে ভাড়া ১,৫০০ টাকা।

যেতে হবে যেভাবেঃ
ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে যেতে হবে কাঁচপুর ব্রিজ। সেখান থেকে সোজা সোনারগাঁ হয়ে মেঘনা ব্রিজ। মেঘনা ব্রিজ পার হয়ে বালুকান্দি বাসস্ট্যান্ড থেকে এক কিলোমিটার বামে গেলেই মেঘনা রিসোর্ট ভিলেজ।

অতীশ দীপঙ্কর স্মৃতিস্তম্ভঃ
জসৎবিখ্যাত জ্ঞান তাপশ শ্রী অতীশ দীপঙ্কর ৯৮০ খ্রিস্টাব্দে মুন্সীগঞ্জ জেলা তথা বিক্রমপুর পরগনার বজ্রযোগিনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার স্মৃতিকে চিরঞ্জীব করে রাখার জন্য বজ্রযোগিনী গ্রামে তার ভিটায় স্থাপিত হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। সে সময় প্রখ্যাত বৌদ্ধ পন্ডিত অবধূত জেতারির কাছ থেকে ব্যাকরণ ও অংক শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন অতীশ। চীন স¤্রাট দীপঙ্করের পান্ডিত্য ও বিজ্ঞতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে ‘অতীশ শ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করেন। স্তম্ভটি দেখতে যেতে হলে মুন্সীগঞ্জ থেকে অটো তে অথবা রিকশায় যাওয়া যায়। মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে বজ্রযোগিনী ৪ কিলোমিটার।

জগদীশ চন্দ্র বসু স্মৃতি জাদুঘরঃ
বাংলাদেশের কৃতী সন্তান এবং বিশ্বে স্বীকৃতি অর্জনকারী প্রথম সফল বিজ্ঞানী হলেন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। তিনি বেতার বার্তার পথদ্রষ্টা ও উদ্ভিদের যে প্রাণ আছে তিনি প্রথম প্রমাণ করেন। পৈতৃক আদি নিবাস বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানার রাঢ়িখাল গ্রামে যা কিনা মুন্সীগঞ্জ শহর থেকে যেতে সময় লাগে ৫০ মিনিট। বিশ্ববরেণ্য এ বিজ্ঞানীর মৃত্যুর পর পৈতৃক বাড়িটি স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। এই বাড়ির মধ্যে রয়েছে ৬টি পুকুর। এছাড়া তার মধ্যে ১৯২১ সালে স্কুল ও পরে ১৯৯১ সালে কলেজ স্থাপন করা হয়। ৬ কক্ষবিশিষ্ট বিল্ডিংয়ের মধ্যে একটি কক্ষকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। এ জাদুঘরের মধ্যেও তেল রং দিয়ে আঁকা ১৭টি দুর্লভ ছবি রয়েছে। জাদুঘরে জগদীশ চন্দ্র বসুর উপর উক্তি করা লেখা ও চিঠি রয়েছে। জাদুঘরের ভেতরে শোকেসগুলোর মধ্যে তার স্মৃতি বিজড়িত কিছু ব্যবহৃত বাসনপত্র রয়েছে। শ্রীনগরে খেতে পারেন বিখ্যাত সুস্বাদু স্পঞ্জ মিষ্টি।

পদ্মা রিসোর্টঃ
এই রিসোর্টটির চারদিকে পদ্মা নদী প্রবাহিত হওয়ায় চরাঞ্চলের গ্রামজীবন ও পুরো চরজুড়ে চোখে পড়বে পদ্মা নদীর ¯্রােতধারা। ছুটিতে মানসিক প্রশান্তির জন্য পদ্মা রিসোর্টের বিকল্প নেই। দুপুর ও রাতের খাবারের জন্য এখানে রয়েছে পদ্মার টাটকা ইলিশ মাছ, সবজি, ঘন ডাল ও মুরগির মাংস।

এছাড়াও বিক্রমপুরের ঐতিহ্যের মধ্যে রয়েছে সোনা রংয়ের জোড় মঠ, বাবা আদমের মসজিদ, পোড়া মাটির নকশা করা আদম মসজিদ যা সুলতানি আমলে তৈরি করা হয়েছে। উপমহাদেশের বিখ্যাত সাঁতারু ব্রজেন দাসের বাড়ি, বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী ঔপন্যাসিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি, রাজা বল্লাল সেনের দীঘি, ৮০০ বছরের ইটের পুল এবং সর্বোচ্চ মঠ শ্রীনগরের শ্যামসিদ্ধির মঠ ইত্যাদি বিক্রমপুরের ইতিহাসের পাতায় কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে যুগ যুগ ধরে।

error: দুঃখিত!