মুন্সিগঞ্জ, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
জেসি হত্যা মামলার প্রধান আসামি বিজয় অবশেষে হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। পরে আদালত শুনানি শেষে তাকে জেলহাজতে প্রেরণ করে। অন্যদিকে এক প্রতিক্রিয়ায় জেসির বাবা বিজয় ও আদিবার ফাঁসি দাবি করেছেন।
মঙ্গলবার বিকাল ৫টা’র দিকে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জশিতা ইসলামের আদালতের খাসকামরায় বিজয়ের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। মুন্সিগঞ্জ কোর্ট পুলিশের ইন্সপেক্টর জামাল হোসেন এ তথ্য নিশ্চিত করেন। এর আগে গেল রোববার বিজয়কে ৩ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ।
রিমান্ড শেষ হওয়ার একদিন আগেই বিজয় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ায় তাকে জেলহাজতে প্রেরণ করা হয়েছে। রিমান্ডে পুলিশ নানারকম কৌশল অবলম্বন করে বিজয়ের কাছ থেকে প্রথমে ১৬১ ধারায় জবানবন্দি নেয়। পরে বিজয় পুলিশকে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয়ার কথা ম্বীকার করলে তাকে আদালতে নেয়া হয়।
আদালতে ১৬৪ ধারায় জেসিকে বিজয় ও আদিবা কে কিভাবে মেরেছে, কার কি ভূমিকা ছিলো, ঘটনার আগে-পরে কেউ আছে কি না, কি কারণে হত্যা করা হয়েছে এসব বিষয় জানিয়েছে বিজয়।
গেল রোববার বিকাল পৌনে ৫টা’র দিকে জেসি হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মুন্সিগঞ্জ সদর ফাঁড়ির পুলিশ পরিদর্শক এস এম শফিকুল ইসলাম বিজয়কে আদালতে প্রেরণ করে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করলে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জশিতা ইসলামের আদালত ৩ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। একদিন রিমান্ড হাতে রেখেই বিজয়কে মঙ্গলবার আদালতে প্রেরণ করা হয়।
এদিকে মেয়ে হত্যা মামলার প্রধান আসামি মুন্সিগঞ্জ শহর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি, সাবেক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আরিফুর রহমানের ছেলে বিজয় রহমান (২২) ও পঞ্চসার ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ও ইউপি সদস্য জাহিদ হাসানের মেয়ে আদিবা আক্তার (১৯) এর ফাসি দাবি করেছেন জেসির বাবা প্রবাসী সেলিম মাহমুদ।
তিনি বলেন, আমার মেয়েকে হারিয়েছি। আসামিরা গ্রেপ্তার হয়েছে। তারা আদালতের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। এখন আমি আদালতের কাছে ন্যায়বিচার প্রার্থনা করছি। আমি দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই। আর কোন বাবার বুক যেন এরকমভাবে খালি না হয়। অনেক স্বপ্ন ছিলো মেয়েকে নিয়ে। আমার সব শেষ হয়ে গেছে। আমি ওদের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসি চাই। ওদের ফাঁসি কার্যকরের মাধ্যমে আদালত ন্যায়বিচারের দৃষ্টান্ত স্থাপন করুক। আর কেউ যাতে এরকম অপকর্ম করতে সাহস না পায়।
সেলিম মাহমুদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আসামি বিজয়কে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও শেল্টার দিয়ে যাচ্ছে একটি প্রভাবশালী মহল। প্রথম থেকেই এই মহলটি আসামি বিজয়কে পালানো থেকে শুরু করে আত্মগোপনে থাকা, এবং তাকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করাসহ সকল ধরনের সহযোগিতা করে সক্রিয় রয়েছে। এই হত্যাকারীদের শেল্টারদাতাদের যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চিহ্নিত করে জনসম্মুখে তুলে ধরে।
বিজয়কে শনিবার রাজধানীর ওয়ারী থেকে গ্রেপ্তার করে রোববার বিকাল সাড়ে ৩টা’র দিকে মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় হস্তান্তর করে র্যাব।
গ্রেপ্তারের আগে সে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে ছিলো। এর মধ্যে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে তার এক বন্ধুর বাড়িতে ৪ দিন, ফরিদপুরের একটি মাজারে ছদ্মবেশে ২২ দিন ও সর্বশেষ রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় আরেক বন্ধুর বাড়িতে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার হয় বিজয়। ঐদিন দুপুরে ঢাকার কারওয়ানবাজারে র্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন প্রেস ব্রিফিংয়ে এসব তথ্য জানান।
এসময় তিনি জানান, শনিবার রাতে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৩ এর একটি আভিযানিক দল রাজধানীর ওয়ারী এলাকা থেকে জেসি হত্যার আসামি বিজয় রহমান (২২) কে গ্রেপ্তার করে। বিজয় প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে হত্যাকান্ডে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য প্রদান করে।
র্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, বিজয় ২০১৯ সালে একই স্কুলে পড়ুয়া জেসি হত্যা মামলার অপর আসামি আদিবা আক্তার এর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। আদিবা আক্তার এর সাথে সম্পর্ক চলাকালীন সময় বিজয় ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে ভিকটিম জেসিকার সাথেও প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। বিজয় উভয়ের সাথে প্রেমের সম্পর্ক বজায় রেখে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আদিবাকে গোপনে বিয়ে করে। পরে বিজয় ও আদিবার বিয়ের কথা জেসি জানতে পারে এবং বিজয়ের সাথে তার বিভিন্ন ম্যাসেঞ্জার কথোপকথনের স্ক্রীনশর্ট আদিবার মেসেঞ্জারে পাঠায়। বিষয়টি নিয়ে বিজয় ও আদিবার মাঝে বিভিন্ন সময় কথা কাটাকাটি ও ঝগড়া-বিবাদ হলে তাদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি শুরু হয়।
২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে বিজয় আদিবার সাথে আলোচনা করে এবং ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি উভয়ে মিলে জেসিকে বিজয়ের বাসার ছাদে ডেকে উচিত শিক্ষা দেয়ার পরিকল্পনা করে। পূর্ব-পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘটনার দিন বিকেলে আদিবা জেসির সাথে দেখা করলে বিজয়ের সাথে তার বিভিন্ন সময়ের কথোপকথোনের স্ক্রীনশর্ট দেখায় এবং এই সমস্যা মীমাংসা করার জন্য আদিবা জেসিকে বিজয়ের বাসার ছাদে নিয়ে আসে। পরবর্তীতে আদিবা ফোন করে বিজয়কে ছাদে আসতে বলে। এরপর সেখানে তাদের মধ্যে বাগবিতন্ডা ও হাতাহাতির একপর্যায়ে বিজয় ও আদিবা জেসির গলাটিপে ধরলে শ্বাসরোধ জেসি অজ্ঞান হয়ে পড়ে।
নিজেদেরকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য জেসি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার নাটক সাজানোর উদ্দেশ্যে বিজয় ও আদিবা মিলে জেসিকে অজ্ঞান অবস্থায় ছাদ থেকে নামিয়ে এনে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে বাসার ভিতরে চলে আসে। পরবর্তীতে পাশের বাসায় থাকা বিজয়ের চাচা জেসিকে রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার শুরু করলে বিজয় এবং তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা বাসা থেকে নেমে আসে।
একপর্যায়ে বিজয় এবং তার বাবাসহ স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় জেসিকে মুন্সিগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।
এসময় বিজয় জেসির ভাই জিদানকে জেসির অসুস্থতার কথা বলে হাসপাতালে আসতে বলে। জেসির ভাই হাসপাতালে এসে পৌঁছালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে ঢাকা নিয়ে যেতে বলেন। ঢাকায় নেয়ার পথে জেসি পুরোপুরি অচেতন হয়ে পড়লে তাকে পুনরায় হাসপাতালে আনা হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
মৃত্যুর ঘটনা শুনে বিজয় ও আদিবা কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে যায়। জেসির লাশ ময়নাতদন্ত শেষে জেসির ভাই জানতে পারে জেসিকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। পরবর্তীতে জেসির ভাই মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় বিজয় ও আদিবাসহ আরও ১-২ জন অজ্ঞাতনামা আসামি করে একটি হত্যা মামলা দায়ের করে। মামলা রুজুর পর ৪ জানুয়ারি আদিবাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সে বর্তমানে জেল-হাজতে রয়েছে।
২২ দিন ছদ্মবেশে মাজারে কাটায় বিজয়
মুন্সিগঞ্জ শহর ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ও সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য আরিফুর রহমানের ছেলে বিজয় রহমান সরকারি হরগঙ্গা কলেজ থেকে ২০২২ সালে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। জেসিকে হত্যার পর সে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখানে তার এক বন্ধুর বাড়িতে ৪ দিন আত্মগোপনে থাকে। সেখানে সে নিজেকে নিরাপদ মনে না করে পরবর্তীতে ফরিদপুরের একটি মাজারে ছদ্মবেশে ২২ দিন আত্মগোপনে থাকে। একপর্যায়ে তার সন্দেহ জাগে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে গ্রেপ্তারের লক্ষে এখানে অভিযান চালাতে পারে। সেই আশঙ্কা থেকে সে ১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বাসায় এসে আত্মগোপনে থাকে। শনিবার রাতে রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় আত্মগোপনে থাকাকালীন র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৩ এর যৌথ অভিযানে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। নিহত জেসি মাহমুদ (১৭) মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার মধ্য কোর্টগাও এলাকার সৌদি আরব প্রবাসী সেলিম মাহমুদের মেয়ে। সে আলবার্ট ভিক্টোরিয়া যতীন্দ্র মোহন গভ. গার্লস হাই স্কুলের এসএসসি বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলো।