৩০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
বুধবার | সকাল ৮:১৮
বাঙালি সংস্কৃতিকে বিশ্বে তুলে ধরছে আব্দুল্লাপুরের ‘লাল কাচ’ উৎসব
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ১৬ এপ্রিল ২০২৫, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)

বাংলা নববর্ষ ঘিরে চৈত্র সংক্রান্তিতে প্রতিবছর মুন্সিগঞ্জের টংগিবাড়ী উপজেলার আব্দুল্লাপুর এলাকায় লোক উৎসব ‘লাল কাচ’ (Lal Kach Festival) হয়ে থাকে। যা দেখতে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ভিড় করেন। আন্তর্জাতিক প্রায় সকল মাধ্যমে এই উৎসবের উপস্থিতি পাওয়া যায়।

উৎসবটি এখন শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয়- বিশ্বে বাঙালি সংস্কৃতির একটি উপকরণ হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় ভগবান শিব ও পার্বতীর পূজার জন্য এই উৎসব করে থাকে। তাদের মূল ভাবনা হচ্ছে-  শিবের নেতৃত্বে একদল সৈন্য পৃথিবীতে আবির্ভূত হবে একটি লক্ষ্য নিয়ে: অশুভ শক্তিকে তাড়ানো।

স্থানীয়দের দাবি বা বিশ্লেষণ অনুযায়ী এর শুরু এমন এক যুগে হয়েছিল যখন এলাকাটিতে বিস্তৃত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বসতি ছিলো।

সেই যুগে মানুষকে বেচা-কেনা করতে হতো না; তখন কোন ধনী-দরিদ্র ছিল না; শ্রমের কোন প্রয়োজন ছিল না, কারণ মানুষের যা প্রয়োজন তার সবই ইচ্ছাশক্তির দ্বারা প্রাপ্ত হয়েছিল; মানুষের প্রধান গুণ ছিল সমস্ত জাগতিক কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করা। কৃতযুগ ছিল রোগমুক্ত; কোনো আয়ুক্ষয় ছিল না; ঘৃণা, জড়া, মন্দ চিন্তা কোনো কিছুই ছিল না। তখন মানুষের মনে দুঃখ বা ভয় নেই। সমস্ত মানবজাতি ঈশ্বরের নিকট হতে পরম আশীর্বাদ প্রাপ্ত হতো। হিন্দুশাস্ত্র অনুযায়ী সেই যুগকে  সত্যযুগ বা কৃতযুগ বলা হয়। এই যুগে জ্ঞান, ধ্যান এবং তপস্যার বিশেষ গুরুত্ব ছিলো।

দাবি অনুযায়ী, আব্দুল্লাপুর এলাকায় সত্য যুগের সন্ন্যাসী বংশের লোকজনের মাধ্যমে এই কাচ নৃত্যের প্রচলন শুরু হয়। আধুনিক যুগে এই বংশের নাম রুপান্তরিত হয়ে ‘গোস্বামি’ হয়েছে। এখনো তারাই স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে ধরে রেখেছেন সেই ঐতিহ্য।

শরীরে সিদুরের রঙে সেজে, হাতে রঙিন-ধারহীন তলোয়ার নিয়ে, মুখে জবা ফুল গুজে দিয়ে ঢাকের তালে তালে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গী করে উপস্থিত দর্শনার্থীদের বিনোদিত করার মধ্য দিয়েই রুপ পায় এই উৎসব। তবে দলগুলো একত্রিত হওয়ার জন্য বের হওয়ার আগে তাদের বাড়ির পাশের মন্দিরগুলো একবার করে প্রদক্ষিণ করেন।

দর্শনার্থীদের ঘিরে ঘুরছেন লাল কাচে অংশগ্রহণকারীরা। ছবি: আমার বিক্রমপুর।

এই উৎসবে যারা নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন তাদের চৈত্র সংক্রান্তির ৩দিন আগ থেকে বেশ কিছু শাস্ত্রীয় নিয়ম মানতে হয়। যার মধ্যে রয়েছে পাটের পানিতে ডুব দিয়ে পবিত্র হওয়া, তেল-পিয়াজ ছাড়া খাবার খাওয়া, এক ঘরে বাস করা ইত্যাদি।

চৈত্র সংক্রান্তির দিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের আগের দিন সকাল থেকে শুরু হয় আয়োজনটি। তবে লাল কাচের মূল পর্ব অনুষ্ঠিত হয় বিকাল ৩টার পর থেকে সূর্য ডোবার আগ পর্যন্ত আব্দুল্লাপুর শশ্মানের পাশে লোকনাথ মন্দিরে।

সন্ধ্যার আগে আব্দুল্লাপুর ও সদর উপজেলার ১৫-২০ টি পৃথক দল এসে জড়ো হয় এখানে। দলে দলে ভাগ হয়ে দর্শনার্থীদের মনোরঞ্জন করতে থাকে দলগুলো। এসময় কয়েক হাজার মানুষের সমাগম ঘটে। যার মধ্যে বেশিরভাগ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও স্থানীয় মুসলিম ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদেরও উৎসবটি উপভোগ করতে দেখা যায়। তাই আয়োজকরা একে ‘অসাম্প্রদায়িক উৎসব’ দাবি করেন।

লাল কাচ ঘিরে উৎসুক জনতার ভিড়। ছবি: আমার বিক্রমপুর।

কাচ নৃত্য, লাল কাচ অথবা ঢোল কাচ নামে উৎসবটি সকল মহলে পরিচিতি পেলেও স্থানীয় হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা একে নীল পূজা বা নীল কাচ নামে অভিহিত করেন।

বাংলাদেশে এই লোক উৎসব প্রাচীনকাল থেকে শুধুমাত্র মুন্সিগঞ্জেই হয়ে আসছে।

এই উৎসবের প্রচলন করা সন্নাসী বংশের বয়োজৈষ্ঠ আধ্যাত্মিক শিক্ষক শ্রী শ্রী অমৃত লাল গোস্বামী জানান, অন্তত ১ হাজার বছর ধরে আব্দুল্লাপুর এলাকায় ‘লাল কাচ উৎসব’ চলছে। যার প্রচলন শুরু হয়েছে সন্নাসী বংশের মাধ্যমে। বর্তমানে তারাই ধরে রেখেছেন এই ঐতিহ্য। প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে যে উৎসবটি হয় তার মূল আয়োজন থাকে তাদের বাড়িটিকে ঘিরে। এখান থেকেই বের হয় বড় দলটি।

বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী এই লাল কাচ উৎসবকে অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর তালিকায় অন্তর্ভুক্তির দাবি করেন তিনি।

error: দুঃখিত!