বিশ্বকাপে ব্রাজিল নেই, আর্জেন্টিনা নেই, জার্মানি নেই, ইটালি নেই – এমন সম্ভাবনা অনেক ফুটবল প্রেমীর কাছে কল্পনারও অতীত। কিন্তু ২০১৮ সালের বিশ্বকাপে সেই দুর্ঘটনা আংশিক হলেও ঘটেছে।
আর্জেন্টিনা ছিটকে যেতে যেতে শেষ মুহূর্তে মেসির যাদুতে কোনোরকমে কোয়ালিফাই করেছে। একুয়েডরের সাথে শেষ ম্যাচে মেসির হ্যাট্রিক আর্জেন্টিনাকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।
কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি চারবারের বিশ্বকাপ জয়ী ইটালির। ইউরোপ থেকে আরেকটি বড় দল বাদ পড়েছে – নেদারল্যান্ডস যারা তিনবার বিশ্বকাপ ফাইনালিস্ট।
সেইসাথে কোয়ালিফাই করতে পারেনি বর্তমান আফ্রিকান চ্যাম্পিয়ন ক্যামেরুন। এবং ২০১৫ এবং ২০১৬ সালের কোপা আমেরিকা জেতা দল চিলিও থাকছে না রাশিয়ার বিশ্বকাপে।
ইটালি
বিশ্বকাপে সুইডেনকে একটি গোল দিতে পারলেই ইটালি উৎরে যেতে পারতো, কিন্তু সেই গোল সোনার হরিণ রয়ে গিয়েছিল ব্যুফঁর দলের জন্য।
বিবিসির সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক মিহির বোস বলছেন, “বিশ্বকাপে ইটালির অনুপস্থিতি নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বড় ‘শক’, কিন্তু আমার মনে হয় এরকম একটি আঘাত যেন দিন দিন ইটালির জন্য অবধারিত হয়ে উঠছিল। আপনি যদি একটু পিছনে ফিরে তাকান, দেখবেন ২০১৬ ইউরোতে তারা কোয়ার্টার ফাইনালে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু খুব খারাপ ফুটবল খেলেছিল। ”
“আসলে দলটি খানিকটা বয়স্ক হয়ে পড়েছে। ব্যুফঁ খুব বড় মাপের গোলকিপার কিন্তু তার বয়স অনেক হয়ে গেছে। ইটালির ক্লাব ফুটবল থেকে আগের মত নতুন নতুন প্রতিভা তৈরি হচ্ছেনা। একজন রবার্তো বাজিও অনেকদিন বের হচ্ছেনা।”
একসময় ইটালির দুর্দিনেও তাদের রক্ষণভাগ শক্ত থাকতো। মাঝমাঠে অন্তত একজন তুখোড় কেউ থাকতো। মিহির বোস মনে করেন সেটা এখন আর নেই।
“আপনি এখন আর সেটা দেখবেন না। ইটালির ফুটবলের এবং বিশেষ করে ক্লাব ফুটবলের কাঠামো নতুন করে খুঁটিয়ে দেখতে হবে।”
তিনি বলেন, ইটালির উচিৎ স্পেন এবং জার্মানি থেকে শিক্ষা নেওয়া যে কিভাবে ক্লাব ফুটবল এবং জাতীয় দলকে সমান্তরালভাবে শক্ত রাখা সম্ভব।
“একসময় স্পেনে ভালো ক্লাব ফুটবল হলেও, জাতীয় দল ভালো কিছু করতে পারতো না। কিন্তু গত ১০ বছরে তারা পরিস্থিতি বদলে দিয়েছে। ক্লাব ফুটবল যেমন ভালো, জাতীয় দলও ভালো, এবার আবার তারা বিশ্বকাপ জিততে পারে।”
মিহির বোস মনে করেন, ইটালির ফুটবলের এবং বিশেষ করে ক্লাব ফুটবলের কাঠামো নতুন করে খুঁটিয়ে দেখে অনেক কিছু বদলাতে হবে।
ইটালির মত নেদারল্যান্ডসকেও সুইডেনের কারণেই বিশ্বকাপের চূড়ান্ত পর্ব থেকে বিদায় হতে হয়। গ্রুপ ম্যাচে সুইডেন লুক্সেমবার্গকে আট গোল দেওয়ার পর গোল ব্যবধানে প্লে-অফ খেলার সুযোগ হারায় নেদারল্যান্ডস।
এতটাই মুষড়ে পড়েছিলেন আরিয়ান রবেন যে আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়ে দেন।
নেদারল্যান্ডস এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিততে না পারলেও, তারা সবসময় কোয়ালিফাই করেছে এবং তিনবার (১৯৭৪, ১৯৭৮, ২০১০) তারা ফাইনাল খেলেছে।
কেন এই দুরবস্থা? মিহির বোস বলছেন বছর দশেক ধরে সামগ্রিকভাবে ডাচ ফুটবলে অধঃপতন চলছে।
“একসময় আয়াক্স ইউরোপের অন্যতম শক্তিধর ক্লাব ছিল। নিয়মিত ইউরোপের প্রতিযোগিতায় শিরোপা জিততো, অথচ এখন কোনো পাত্তাই নেই। ডাচ লীগের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বিশ বছরও রুথ খুলিতের মতও একজন তারকা তারা তৈরি করতে পারেনি।”
অথচ একসময় নেদারল্যান্ডসের ইমেজ ছিল – একমাত্র তারাই ইউরোপে সাউথ আমেরিকানদের মত দৃষ্টিনন্দন ফুটবল খেলে। ১৯৭০ এর দশকে তারাই প্রথম ইউরোপ ‘টোট্যাল ফুটবলের’ ধারনা প্রবর্তন করেছিল।
এই অধঃপতনের কারণ কি? মি বোসের মতে, নেতৃত্বের অভাব। “ডাচ ফুটবলের অবস্থা হয়েছে এমন যেন সাগরের মাঝে একটি ভাসমান জাহাজ যার কোনো ক্যাপ্টেন নেই।”
চিলি ২০১৫ এবং ২০১৬ সালে পরপর দুবার কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়ন। ২০১৭ সালের কনফেডারেশন কাপে জার্মানির সাথে ফাইনাল খেলেছিল তারা। আলেক্সি সানচেজ এবং আরতুরো ভিদালের মত তুখোড় তারকা রয়েছে চিলিতে। অথচ কোয়ালিফাই করতে পারেনি।
মিহির বোসের মতে, ফুটবলে একসময় যে স্বর্ণযুগ তাদের ছিল, চিলি তা অনেকটাই হারিয়েছে।
“কোয়ালিফাইং রাউন্ডে চিলি গোল পাচিছল না, সেটাই ছিল তাদের বড় সমস্যা। সানচেজ বা ভিদালের মত প্রতিভা থাকলেও দল হিসাবে অনেক নড়বড়ে লেগেছে তাদের।”
মি বোসের মতে- এবার দক্ষিণ আমেরিকাতে কোয়ালিফাইং রাউন্ড অপেক্ষাকৃত বেশ প্রতিযোগিতামূলক ছিল, ফলে চিলির ব্যর্থতা বড় কোনো অঘটন ছিলনা।
ক্যামেরুন, ঘানা, আইভরি কোস্ট
১৯৯০ সালের বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের খেলা দেখে পেলে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন ২০০০ সাল নাগাদ আফ্রিকান কোনো একটি দল বিশ্বকাপ জিতবে।
ক্যামেরুন বর্তমান আফ্রিকান চ্যাম্পিয়ন। অথচ তারা রাশিয়ার বিশ্বকাপে কোয়ালিফাই করতে পারেনি।
একই পরিণতি হয়েছে আফ্রিকার আরেক ফুটবল জায়ান্ট আইভরি কোস্টের যারা ২০০৬ সাল থেকে সবগুলো বিশ্বকাপে খেলেছে।
মিহির বোস বলছেন, “আইভরি কোস্টের সমস্যা হচ্ছে নতুন প্রতিভা দলে যোগ হচ্ছেনা।” সেই সাথে রয়েছে ফুটবল ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা যেটা আফ্রিকার অধিকাংশ দেশের ফুটবলকে ক্ষতি করছে।
আর আফ্রিকার যে দেশটি ২০১৪ সালে ব্রাজিলের বিশ্বকাপে খুবই ভালো ফুটবল খেলেছে- সেই ঘানাও এবার অনুপস্থিত রাশিয়ায়।
এশিয়া থেকে সৌদি আরব এবং ইরান কোয়ালিফাই করতে পারলেও যে দেশটি হালে ফুটবলে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করছে সেই চীন ব্যর্থ হয়েছে।
অবশ্য চীন যে রাশিয়ার বিশ্বকাপে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেতে পারেনি, তাতে একেবারেই বিস্মিত নন মিহির বোস।
“চীন বিশ্বকাপ জেতার স্বপ্ন দেখে, চীন দাবি করে তারাই ফুটবল আবিষ্কার করেছে, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি ফুটবলে তাদের মৌলিক অবকাঠামো এখনও অনেক অনেক পিছিয়ে।”
মিহির বোস মনে করেন, ইরান এবং সৌদি আরবের চেয়েও চীনের ফুটবলের অবকাঠামো পেছনে।