কাজী মনির হোসেন নামে এক উদ্যমী তরুণের হাত ধরে এই গল্পের শুরু। ঢাকায় বেসরকারি একটি কোম্পানিতে চাকরিরত এই তরুণ রানা প্লাজা ধংসের খবর পেয়ে সেই দিনই ছুটে যান সাভারে। সক্রিয়ভাবে অংশ নেন উদ্ধার কাজে। উদ্ধার কাজ শেষ হওয়ার পর দেখেন অনেকেই ঠিকমতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না। মনির ভাবতে থাকেন বেঁচে থাকা মানুষদের জন্য চিকিৎসা সহায়তা প্রয়োজন। কয়েকজন বন্ধু মিলে ৫ মে থেকে সাভার থানা বাসস্ট্যান্ডের সামনে চিকিৎসাকেন্দ্র খোলেন মনির। সেখানে অনেককেই চিকিৎসা দেওয়া হয়। একটু বেশি আহত রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় রাজধানীর দুটি হাসপাতালে। এভাবে তারা রানা প্লাজায় আহত ৪৭৫ রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।
রানা প্লাজায় আহত চাকরিহারা মানুষ পেতে একটি ডাটাবেস তৈরি করলেন তারা। সেটা ধরেই অনেকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। উদ্ধার আর চিকিৎসা পেয়েই রানা প্লাজায় ভুক্তভোগী মানুষদের জীবন চলার পথ সচল হয়ে যায়নি। যারা বেঁচে গেছেন তাদের দরকার নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর। কিন্তু নিঃস্ব শ্রমিকদের জন্য কাজটি অনেক কঠিন। এই বিষয়গুলো দেখছিলেন মনির হোসেন কাছ থেকে। শ্রমিকরা সুস্থ হওয়ার পরও বিপদগ্রস্ত এই মানুষদের ফেলে চলে আসতে পারেননি তিনি। শুরু করলেন বিপদে পড়া মানুষদের পুনর্বাসনের কাজ। আহত শ্রমিকদের কাউকে চাল-ডাল, কাউকে গবাদিপশু, কাউকে দোকান করে পুনর্বাসিত করা শুরু করলেন। এভাবে মনির এবং তার সঙ্গীরা পুনর্বাসিত করেছিলেন ৫৬ জনকে। অবাক ব্যাপার হলো, এই সহায়তা পেয়েও ভিকটিমরা বাড়িতে থাকেননি। সহায়তা সামগ্রী বিক্রি করে আবার সহায়তা চলে আসছেন সাভারে। এই সমস্যা সমাধানের পথ খুঁজতে থাকেন মনির।
শুরু করেন শ্রমিকদের টেকসই উন্নয়নের কাজ। মনির হোসেনকে সহায়তা দিতে এগিয়ে আসেন দেশের দুই বিশিষ্টজন খুশী কবির ও আক্কু চৌধুরী। গঠন করেন একটি ট্রাস্ট ‘সংকলন বাংলাদেশ’। এই ট্রাস্টের ট্রাস্টি ১৫ জন। কাজী মনির হোসেন, খুশী কবির ও আক্কু চৌধুরী ছাড়া বাকি ১২ জন রানা প্লাজায় আহত শ্রমিক। মনির হোসেন বড় চাকরি ছেড়ে পুরোপুরি লেগে যান এই কাজে। এই ট্রাস্টের মাধ্যমেই পরিচালিত হয় ‘অপরাজেয়’ নামে একটি পোশাক কারখানা। রানা প্লাজা ধংসের ঠিক দুই মাসের মাথায় ২৪ জুন সাভারে এই পোশাক কারখানাটি প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি ভাড়া বাড়িতে। এখন এই প্রতিষ্ঠানে ২৭ জন শ্রমিক কাজ করেন। এরা সবাই রানা প্লাজায় আহত শ্রমিক। অপরাজেয় পোশাক কারখানার শ্রমিকরা সবাই প্রতি মাসে বেতন পান। আর প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশ সবার মাঝে বণ্টন করা হয় সমানভাবে। দীর্ঘদিন চমৎকার চলছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। অপরাজেয়র পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি শুরু হয়েছিল বিদেশেও। এর মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসে প্রতিষ্ঠানটির। চলতি বছরের ১৪ মার্চ আগুন লেগে পুড়ে যায় কারখানার বহু মাল। ফায়ার সার্ভিস এই আগুনকে শর্টসার্কিট বললেও প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এটা নাশকতা হওয়ার বেশি। এই আগুনে তাদের পুড়ে গেছে ২৩ থেকে ২৪ লাখ টাকার সম্পদ। কারখানা আগুনে পুড়ে গেছে, তারপরও থেমে নেই তাদের কাজ। সীমিত আকারে আবারও ঘুরে দাঁড়ান তারা। রাত-দিন শ্রম দিয়ে এ প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকরা নতুন করে শুরু করেন সব। গত মাসের শেষের দিকে এ কারখানাটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় আবারও। একই সঙ্গে আবারও শুরু হয় রফতানির কাজ।
এই পোশাক কারখানার মাধ্যমে রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকরা ঘুরে দাঁড়ানোর পাশাপাশি এর আয় দিয়ে একটি বিদ্যালয়ও যাত্রা শুরু করেছে। সংকলন বিদ্যালয়ে বিনা খরচে পড়াশোনা করে ২৪৫ ছাত্রছাত্রী। এরা সবাই রানা প্লাজায় আহত শ্রমিক ও গার্মেন্ট শ্রমিকের ছেলেমেয়ে।
বন্ধু-বান্ধব আর পরিচিতজনদের কাছ থেকে ২ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়েছিল রানা প্লাজায় আহত শ্রমিকদের হাত ধরে। এখন এটি কোটি টাকার সম্পদ। এখানেই থেমে থাকতে চান না এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িতরা। তারা স্বপ্ন দেখছেন একদিন হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হবে এ কারখানায়।