২০শে এপ্রিল, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
রবিবার | রাত ১২:৫২
মুন্সীগঞ্জ জেলা আ.লীগ; দু্ই পরিবারে বন্দী দল, কার্যালয়ও নেই
খবরটি শেয়ার করুন:

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক মো. মহিউদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ লুৎফর রহমানের পরিবারের নিয়ন্ত্রণে মুন্সিগঞ্জে আওয়ামী লীগের রাজনীতি। ৭১ সদস্যের জেলা কমিটিতে এ দুই পরিবারের সদস্য আছেন আটজন।

দলের নেতা-কর্মীরা জানান, মো. মহিউদ্দিন ১৯৯১ সাল থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে এবং শেখ লুৎফর রহমান ১৯৯৬ সাল থেকে একটানা সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ২০০৫ সালের পরে জেলা আওয়ামী লীগের সর্বশেষ সম্মেলন হয় ২০১৪ সালের ২১ জুন। এই সম্মেলনে মহিউদ্দিন ও লুৎফর রহমান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। পরে মহিউদ্দিন ও লুৎফর রহমান তাঁদের অনুগত ও পছন্দের লোক দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করে অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে পাঠান। সভাপতি হওয়ার আগে ১৯৮৪ সাল থেকে মহিউদ্দিন জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮৬ সালে মহিউদ্দিন প্রথমবারের মতো সাংসদ নির্বাচিত হন।

দলের একাধিক সূত্র জানায়, জেলা কমিটিতে সাবেক সাধারণ সম্পাদক প্রবীণ নেতা ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেন, মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম (এসপি মাহবুব), গজারিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রেফায়েত উল্লাহ খান, শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহতাব উদ্দিন, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-প্রচার সম্পাদক আইনজীবী শাহীন মোহাম্মদ আমানউল্লাহ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও যুবলীগের নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন এবং জি এম মনসুর উদ্দিনসহ অনেক পরীক্ষিত নেতা স্থান পাননি।

বর্তমান জেলা কমিটির সদস্য আছেন মহিউদ্দিনের বড় ছেলে ফয়সাল বিপ্লব। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান ও মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র পদে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে তিনি দলের প্রার্থী (বর্তমানে সাংসদ) মৃণাল কান্তি দাসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দেন। কিন্তু ত্রুটির কারণে তাঁর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়। মৃণাল কান্তি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। দলের একাধিক নেতা জানান, মৃণাল কান্তির সঙ্গে মহিউদ্দিনের পরিবারের বৈরিতা গত কয়েকটি নির্বাচনে প্রকাশ্য হয়ে পড়েছে।

মহিউদ্দিনের পরিবারের আরেক সদস্য জেলা আওয়ামী লীগের সংস্কৃতিবিষয়ক সম্পাদক পদে আছেন। তিনি মহিউদ্দিনের ছোট বোনের জামাই মতিউল ইসলাম। মতিউল এর আগে দলের অঙ্গসংগঠনেরও কোনো পদে ছিলেন না। এবারই প্রথম সরাসরি জেলা কমিটিতে পদ পেলেন। মতিউল ইসলাম জেলা রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিরও সহসভাপতি হয়েছেন।

জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মহিউদ্দিনের ছোট বোন ফরিদা আক্তার। তিনি জেলা মহিলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। আরেক ছোট ভাই আনিছুজ্জামান আনিস জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। জেলা যুবলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান রাজিব আনিছুজ্জামানের বড় ছেলে (মহিউদ্দিনের ভাতিজা)। ২০০৩ সালে ঢাকা থেকে জেলা যুবলীগের কমিটি গঠন করা হয়। এখন পর্যন্ত যুবলীগের আর কোনো সম্মেলন হয়নি।

আর জেলা কমিটিতে দলের সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমানের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন তাঁর মেয়ে শিক্ষক লতিফা রেহ্নুমা। লতিফা ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক। তাঁর ছোট ভাই ইসলামপুরের কাপড় ব্যবসায়ী মো. জাহাঙ্গীর আলম জেলা কমিটির যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক। দলের একাধিক নেতা জানান, কমিটিতে পদ পাওয়ার আগে লুৎফর রহমানের এই মেয়ে ও ভাইকে ইতিপূর্বে কোনো রাজনৈতিক কার্যক্রম বা কর্মসূচিতে দেখা যায়নি।

পদবঞ্চিত একাধিক নেতা জানান, মুন্সিগঞ্জের রাজনীতিতে এ দুই পরিবারের আধিপত্যের কারণে অন্য কেউ দাঁড়াতে পারছেন না। ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে মুন্সিগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এম ইদ্রিস আলী। সাংসদ হয়েও পাঁচ বছর ইদ্রিস আলী কোণঠাসা ছিলেন। ২০১২ সালের ১৮ ডিসেম্বর জেলা শিল্পকলা একাডেমির সভাকক্ষে সদর থানা ও শহর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সাংসদ এম ইদ্রিস আলী ভোটের মাধ্যমে কমিটি গঠনের দাবি তুললে তাঁকে সম্মেলন থেকে বের করে দেওয়া হয়। সেদিন ইদ্রিস আলী সাংবাদিকদের কাছে অভিযোগ করেছিলেন, মহিউদ্দিন তাঁর লোকদের দিয়ে কমিটি গঠন করতে চাইছেন। তিনি দলে পরিবারতন্ত্র কায়েম রেখেছেন।

ইদ্রিস আলীর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানায়, দলের উচ্চপর্যায়ে এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়েও পাননি ইদ্রিস আলী। দুঃখ নিয়েই তিনি রাজনীতি থেকে দূরে সরে যান। এখন পরিবার নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস করছেন।

দলের একাটি দায়িত্বশীল নেতা অভিযোগ করেন, মহিউদ্দিনের কাছে কেবল ইদ্রিস আলী নন, বর্তমান সাংসদ মৃণাল কান্তি দাস এবং তাঁর অনুসারীরা কোণঠাসা হয়ে আছেন।

মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে দলীয় নেতা-কর্মীদের আরেকটি বড় অভিযোগ, মহিউদ্দিন দীর্ঘ সময় দলের নেতৃত্ব দিলেও জেলা আওয়ামী লীগের একটি নিজস্ব কার্যালয় নেই। দলের কর্মকাণ্ড মহিউদ্দিনের বাড়ি থেকেই পরিচালিত হয়।

জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ঢালী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, দলের মধ্যে মহিউদ্দিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে যাঁরা প্রতিবাদ করেন, তাঁদেরকেই কমিটি থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়। মহিউদ্দিন রাজনীতিটাকে তাঁর পারিবারিক সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছেন। দলের রাজনীতিকে তিনি তাঁর বাড়িতে বন্দী করে রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘রাজনীতিকে আমরা পবিত্র আমানত মনে করি। কিন্তু কিছু লোক একে ব্যবসা বানিয়ে ফেলেছেন। টাকার বিনিময়ে দলের পদ বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।’

বর্তমান জেলা কমিটির সহসভাপতি তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘এবারের সম্মেলনে আমি সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী ছিলাম। কাউন্সিলরদের মধ্যে আমার যথেষ্ট সমর্থনও ছিল। তারপরেও আমাকে বিশেষ কারণে সড়ে দাঁড়াতে হয়েছে।’ তিনি বলেন, দীর্ঘদিন দল করেন এমন ত্যাগী নেতাদেরই যখন দলে করুণ অবস্থা, তা দেখে দেখে ভয়ে নতুনেরা আর আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন না। এতে নতুন নেতৃত্ব তৈরিও আটকে গেছে।

কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক ও সাংসদ মৃণাল কান্তি দাস বলেন, ‘নেতা-কর্মীরা যদি আমাকে কোনো গ্রুপের মধ্যে ফেলে, তাহলে তা সঠিক হবে না। কারণ আমার নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। আমি তাঁর নেতৃত্বে জেলায় রাজনীতি করি।’ দলের মধ্যে কোনো গ্রুপিং নেই বলেও মৃণাল কান্তি দাবি করেন। জেলা আওয়ামী লীগে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ প্রসঙ্গে নেতা-কর্মীদের অভিযোগের বিষয়ে মৃণাল কান্তি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যাঁরা আমাদের বিরুদ্ধে পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ তুলেছেন, তাঁরা কোনো কিছু না জেনেই তা করেছেন। কারও যদি যোগ্যতা থাকে তবে তিনি কার ছেলে বা মেয়ে তা বিবেচনার বিষয় না। কে কম ভাবল, এত কিছু দেখলে তো আর চলবে না।’

সাধারণ সম্পাদক দাবি করেন, জেলা কমিটির সভাপতি মহিউদ্দিনের ভাই, বোন ও ছেলেকে দলের প্রয়োজনেই কমিটিতে রাখা হয়েছে। ডাকলে আসে না এমন লোক দিয়ে তো দলের কাজ হয় না। যার ডাকে লোক আসে, পদ তো তাকেই দিতে হবে। তাঁর ভাই এবং মেয়েকেও দলের স্বার্থেই কমিটিতে রাখা হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

দলীয় কার্যালয় না থাকা প্রসঙ্গে লুৎফর রহমান বলেন, ‘কোনো সরকারি জমি দখল করে তো আর দলীয় কার্যালয় নির্মাণ করতে পারি না। আমরা একটা ভাড়াবাড়ি খুঁজছি, যেখানে কার্যালয় করা যায়। কিন্তু তেমন বাড়ি পাচ্ছি না।’
মুন্সিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. মহিউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিনিয়র নেতাদের উপস্থিতিতে কমিটি হয়েছে। এরপর পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেত্রী অনুমোদন করেছেন। পরীক্ষিতদের বাদ দিলে তিনি কি কমিটি অনুমোদন করতেন? তাঁর তো সমস্যা হয়নি। আপনার হচ্ছে কেন?’

বিশেষ দ্রষ্টব্য: পুরো লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো’র। মূল লেখার লিংক> মুন্সিগঞ্জ জেলার রাজনীতি: জেলা আ.লীগ । দু্ই পরিবারে বন্দী দল, কার্যালয়ও নেই

error: দুঃখিত!