২৪শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
সোমবার | রাত ১২:০৩
চাইলেই সব পারেন মুন্সিগঞ্জের ট্রাফিক সার্জেন্ট ‘গোপালগঞ্জের জুলমত’!
খবরটি শেয়ার করুন:

শিহাব অাহমেদ: পাঠক ‘গোপালগঞ্জ’ নিয়ে অাজ অবদি কম কথা শুনেননি হয়তো। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মভূমি হওয়ায় শ্রদ্ধার চোখেই দেখা হয় মুন্সিগঞ্জের পাশের জেলা গোপালগঞ্জ কে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুখে না স্বীকার করলেও গোপালগঞ্জ এর মানুষদের ভিন্ন চোখেই দেখেন প্রতিটি ক্ষেত্রে।

অাবার এই ‘গোপালগঞ্জ’ নিয়ে কটূক্তিও কম নয়। বিশেষ করে অাওয়ামী লীগ বিরোধীরা ‘গোপালগঞ্জ’ জেলা’র নাম উচ্চারন করেন টিটকারির সুরে, অপ্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে।

মুন্সিগঞ্জ সদরে কর্মরত ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তা জুলমত অালী। ২০১৫সালের দিকে একের পর এক উশৃঙ্খল ঘটনা ঘটিয়ে প্রথম শহরবাসীর নজরে অাসেন জুলমত।

ব্যাটারীচালিত অটোরিক্সা, পণ্যবাহী ট্রাক, মোটরসাইকেল সহ যেদিন যেখানে যতক্ষন দায়িত্ব পেয়েছেন সেখানেই দাড়িয়ে চাঁদাবাজি করেছেন। চাহিদামত অর্থ না পাওয়া পর্যন্ত যানবাহন অারোহীদের শুনতে হয়েছে জুলমতের বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলায়। চাইলেই জুলমত সবকিছু করতে পারেন। তার ক্ষমতা অনেক উচু পর্যন্ত!

একজন ট্রাফিক পুলিশের উপরে বর্তিত দায়িত্বানুযায়ী অবৈধ যানের বিরুদ্ধে জুলমত এখন পর্যন্ত স্বপ্রণোদিত হয়ে যে কয়টি ব্যাবস্থা নিয়েছেন তার অধিকাংশই বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে নিজের ক্ষমতা প্রদর্শন করতে ব্যাক্তিগত ক্রোধ থেকে। অাবার দেখা গেছে এর অধিকাংশকেই থানায় নেয়ার পরে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে অাবার সেই যানগুলো ছেড়েও দিয়েছেন তিনি।

এর অাগে জুলমতের পরিবহন চাঁদাবাজি ও মোটরসাইকেল চালকদের সাথে অপেশাদারী অাচরণ নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু ক্ষমতাধর একজন সামান্য ট্রাফিক সাব ইন্সপেক্টর জুলমতের বিরুদ্ধে দুর্নীতি’র অভিযোগের কোন তদন্ত হয়নি অাজও ।

এরপরে জুলমত বিভিন্ন জায়গায় দাবি করেন পুলিশ সুপার এর বিশেষ পছন্দের লোক হওয়ায় চাইলেও তাকে কেউ কিছু করতে পারবে না। এবং যা হচ্ছে তা সব ‘ষড়যন্ত্র’

এরকম একটি কথোপকথনের রেকর্ড এই প্রতিবেদকের কাছে অাছে।

ঐ অডিও রেকর্ডে অারও শোনা যায়, তিনি মুন্সিগঞ্জের স্থানীয় এক সাংবাদিকের সাথে খোশগল্পের এক পর্যায়ে তার পক্ষে তার ছবি দিয়ে নিউজ ছাপাতে অনুরোধ করছেন।

এসময় তিনি ঐ সাংবাদিক কে পরামর্শ দিচ্ছেন ‘নিউজটি এমন ভাবে করবেন যাতে ‘এসপি স্যার’ দেখে অারও খুশি হয় এবং অামার বিরুদ্ধে করা পূর্বের নিউজটি মিথ্যে মনে হয়। এবং নিউজের শিরোনাম দিবেন এরকম ‘সাদা মনের মানুষ জুলমত’।

প্রসঙ্গত, এর কিছুদিন অাগে স্থানীয় একটি অনলাইন পত্রিকায় ‘জুলমতের জুলুমে অতিষ্ঠ শহরবাসী!’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদ প্রকাশের জেরে ঐ পত্রিকা ও প্রতিবেদকের নামে থানায় মামলা করার চেষ্টা করে ব্যার্থ হন জুলমত। এরপর স্থানীয় প্রিন্ট সংস্করনের অারেকটি পত্রিকা রহস্যজনকভাবে জুলমতের পক্ষ নিয়ে ঐ পত্রিকার বিরুদ্ধে ধারাবাহিক বিষোদগার ছাপে।

ঐসময় ট্রাফিক পুলিশের নিয়ন্ত্রক জেলা পুলিশ সুপার এর কাছে নিজের অপকর্ম ধাপাচাপা দিতে জুলমত প্রতিদিন সন্ধ্যায় শহরের লিচুতলায় মাঠে পুলিশ সুপার খেলতে ঢুকলে বাইরে দাড় করানো তার গাড়ির পাশে বসে দৃষ্টিগোচর হওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন।

জুলমতের ধারাবাহিক অনৈতিক কর্মকান্ডের বেশ কিছু তথ্য প্রমান এই প্রতিবেদকের কাছে অাছে।

মুন্সিগঞ্জ শহর পৌরসভার দ্বিতীয় তলা থেকে রেকর্ড করা একটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, জুলমত লাইসেন্সবিহীন একটি মোটরবাইক ও এর চালককে রাস্তা থেকে ধরে এনে পৌর ভবনের ভেতরে এক কোনায় অর্থ অাদায় করে ছেড়ে দিচ্ছেন। ঐসময়ও তিনি বলছেন ‘এই তুই জানিস অামার বাড়ি কোথায়? গোপালগঞ্জ! গোপালগঞ্জ!! অামি চাইলেই মামলা দিতে পারতাম, অাজকের জন্য মাফ দিলাম’

গোপনে তোলা অারেকটি ছবি তে দেখা যাচ্ছে জুলমত মুক্তারপুর ব্রীজ এলাকায় একটি পন্যবাহী ট্রাক থেকে জোর করে অর্থ অাদায় করছেন। অন্যদিন একটি মোটরসাইকেল অাটকে লাইসেন্স না থাকার অযুহাতে চালকের কাছ থেকে টাকা অাদায় করছেন। উভয়টিতেই জুলমতের শরীরে পুলিশের পোষাক, ব্যাজ ও সাথে ওয়াকিটকি ছিলো।’

এসকল তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে ট্রাফিক সাব-ইন্সপেক্টর জুলমতের অবস্থান জানতে কথা বলতে গেলে শহরের কাচারী মোড়ে ক্ষুদ্ধ জুলমত এই প্রতিবেদককে ও একই সুরে বলেন ‘অামার বাড়ি গোপালগঞ্জ, পারলে বাল ফালাইয়ো। অামাকে মেয়র-এমপি সবাই সম্মান দিয়ে চলে। এসব এসপি স্যার বিশ্বাস করবে না’

একজন পুলিশ কর্মকর্তা’র এরকম ঔদ্ধত্যপূর্ণ অাচরণের বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ জেলা’র পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি), অাইন বিশেষজ্ঞ এ্যড. অাব্দুল মতিন বলেন, ‘অাইনের চোখে এবং একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বলতে গেলে জুলমতের এধরনের কর্মকান্ড অনুচিৎ। ট্রাফিক পুলিশের বৈশিষ্ট্য এটা নয়। যদি পুলিশ সুপারের তার পক্ষে অবস্থান নেয়ার তথ্য সত্য হয়ে থাকে তাও অনৈতিক। এধরনের অসাধু পুলিশের সদস্য অন্যদের একই পথে চলতে প্ররোচিত করে। মানুষের জন্যেই পুলিশ, পুলিশের জন্যে মানুষ না’।

ট্রান্সপারেসি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিঅাইবি) ও সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) এর মুন্সিগঞ্জ জেলা শাখার অাঞ্চলিক ব্যাবস্থাপক রাশিদুজ্জামান লিটন বলেন, ‘টিঅাইবি মুন্সিগঞ্জে ২০০৬সাল থেকে। এখন পর্যন্ত এরকম কোন বিষয়ে প্রতিক্রিয়া চাওয়া এই প্রথম। এর মানে এই নয় যে-এরকম কিছু ঘটেনি। অাসলে কিন্তু এরকম বিশৃঙ্খল কাজকর্ম পুলিশ বাহিনীতে অহরহ হচ্ছে। দেশে গত কয়েকদিনে বেশ কিছু বড় ধরনের ঘটনাও ঘটেছে। তাই মুন্সিগঞ্জ পুলিশ কে ও এ ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে। বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া সুখকর নয়। অার এভাবে এড়িয়ে গেলেন মানে হচ্ছে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন। যা সরাসরি সুশাসন প্রতিষ্ঠায় অন্তরায়।’

তিনি অারও বলেন ‘শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন সদস্যের মধ্যে যদি দায়বদ্ধতা’র বিপরীত লক্ষ্য করা যায় অবশ্যই সে বিষয়ে তদন্ত মোতাবেক ব্যাবস্থা নিতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের অন্যতম প্রধান কাজ হলো ‘ট্রাফিক আইনকানুন’ মেনে চলতে যানবাহনগুলোর চালকদের সাহায্য করা।’

error: দুঃখিত!