মুন্সিগঞ্জ, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
ছেলে নেই, স্বামীও ছেড়ে গেছেন বহু আগে। ২০২২ সালে মুন্সিগঞ্জ সদরের পঞ্চসার ইউনিয়নের রামেরগাও এলাকায় ২ শতাংশ জমিসহ নিজের নামে ঘর হয় উপার্জন অক্ষম ময়না বেগমের (৫৫)। ভেবেছিলেন বাকিজীবনের আশ্রয়টুকু হলো বুঝি তার। কিন্তু গেল ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সৃষ্ট পরিবেশের সুযোগ কাজে লাগিয়ে পরদিন (৬ আগস্ট) ওই ঘরের দরজা-জানালাসহ ঘরে থাকা মালামাল লুট করে উচ্ছেদ করা হয় ময়নাকে।
অন্ধ স্বামী খলিল রহমানকে নিয়ে ফাতেমা আক্তারও থাকতেন এখানে। পথেঘাটে ভিক্ষাবৃত্তি করে চলে ফাতেমার ৩ শিশু ছেলের দিশাহীন সংসার। সেও এখন নিরুপায় হয়ে দেড় মাসের বেশি সময় ধরে উঠেছেন নতুনগাও এলাকার ভাড়া বাসায়। মাস শেষ হলেও এখনো পরিশোধ করতে পারেননি বাসা ভাড়ার অর্থ। নিজের নামে দলিলকৃত ঘর থেকে এরকম বিধ্বংসী কায়দায় উচ্ছেদ হয়ে এরই মধ্যে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি।
লড়াকু আরেক মুখ তানিয়া আক্তার। স্বামী ছেড়ে যাওয়া এই নারী স্থানীয় একটি সুতার ফ্যাক্টরিতে কাজ করে মাকে নিয়ে থাকতেন ভূমিহীন-গৃহহীনদের জন্য সরকারের উপহার আশ্রয়ণ প্রকল্পে। তারও এখন দৈন্যদশা।
ময়না, ফাতেমা, তানিয়া, নুর বানু, সাহারার মত ১৬টি পরিবারের একই দশা।
ভিডিও প্রতিবেদন:
জানা যায়, সরকার পতনের পরদিন ৬ আগস্ট সকালে নির্মিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৪৫ শতাংশ জমি নিজের দাবি করে স্থানীয় রফি মোল্লা ৫০-৬০ জন ব্যক্তি সহকারে এসে হাতুড়ি, রড, হকিস্টিক দিয়ে ভাঙচুর চালান ঘরগুলোতে। এসময় লুট করা হয় প্রতিটি ঘরের লোহার দরজা, জানালা, টয়লেটের সরঞ্জামাদি। ঘুলে নেয়া হয় পানি উত্তোলনের মোটর ও পাইপ। আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে বেধড়ক মারধরের শিকার হন তারা। এসময় ঘরগুলোতে থাকা বাসিন্দারা আকুতি-মিনতি করলেও তাদের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা ও অবিবাহিতদের ধর্ষণের হুমকি দেন ওই ব্যক্তি। পরে নিরুপায় হয়ে ঘরে থাকা মুল্যবান মালামাল রেখেই দ্বিকবিদিক হয়ে যে যার মত নিরাপদে চলে যায় পরিবারগুলো।
রামেরগাও আশ্রয়ণ প্রকল্পে জমি ও ঘরের মালিক তানিয়া আক্তার অভিযোগ করে বলেন, ‘সরকার পতনের দিন বিকালে রফি মোল্লা ও তার ভাইয়েরা এসে বলেন আমরা মনেপ্রাণে বিএনপি করি। এই জায়গা আমাগো, আগের সরকার জোর কইরা নিছিলো গা। এহন এক ঘন্টার মধ্যে ঘরবাড়ি ছাইড়া দেও, নাইলে আগুন দিয়া দিমু। পরে আমরা হাত-পা ধরে তাদের থেকে একদিনের সময় নেই। পরদিন সকাল ৮টা বাজতেই লোকজন নিয়ে এসে তারা ঘরের দরজা-জানালা ভাঙা শুরু করে। কোনমতে প্রাণ নিয়ে সেখান থেকে পালাইছি।’
আরেক ভুক্তভোগী নুর বানু বলেন, ‘স্বামীও নাই, পোলাও নাই। একটা মাইয়া বিয়া দিয়া দিছি মাইনষের বাইত কাম কইরা। ওইদিন এক কাপড়ে বাইর হইছি বাবা। একটা পোলা মানুষও আছিলো না যে আমার ঘরের মালছামানাগিলি বাইর করবো। ৪৫ দিন ধইরা আছি আমার মাইয়ার বান্ধবীর বাসায়। রাইতটা কোনরকমে পার করি, দিন হইলে রাস্তায় রাস্তায় হাত পাতি। আমি কি আর আশ্রয় ফিরা পামু না?’
এদিকে লুটপাট ও ভাঙচুরের অভিযোগে গত ১৯ সেপ্টেম্বর স্থানীয় থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন ভুক্তভোগীরা। ওইদিনই তারা জেলা প্রশাসকের সাথে দেখা করে লিখিতভাবে বিষয়টি জানান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক ফাতেমা তুল জান্নাত বলেন, ‘ভুক্তভোগীদের কথা শুনেছি। এ বিষয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
অভিযুক্ত রফি মোল্লা বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণ করা ওই ৪৫ শতাংশ জমি আমার পিতা কানু মোল্লার। ওয়ারিশ সূত্রে আমরা ৭ ভাই ওই জমির মালিক। তবে আমাদের কাগজে কিছু ত্রুটি আছে, আমরা আদালতে একটি মামলাও করেছি ২০২১ সালে। আদালত যে রায় দিবে সেটা আমরা মেনে নিবো।’ ভাঙচুর-লুটের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহবায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অভিযুক্ত অফি মোল্লা, রফি মোল্লারা বিএনপির কেউ না। তারা বিএনপির নাম জড়িয়ে অপকর্ম করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে ভুক্তভোগীরা।’
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আফিফা খান বলেন, ‘আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণের সময় আমি ছিলাম না। ওই জমিটি সরকারি মালিকানাধীন। কিন্তু স্থানীয় কয়েক ব্যক্তি জমিটি দীর্ঘদিন অবৈধ দখলে ছিলেন। পরে তাদের থেকে দখলমুক্ত করে সেখানে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ১৬টি ঘর নির্মাণ করে দেয় সরকার। ৫ আগস্টের পর পরিস্থিতির সুযোগ কাজে লাগিয়ে অবৈধ দখলদার চক্রটি লুটপাট-ভাঙচুর করেছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি উচ্ছেদকৃত ওই পরিবারগুলোকে দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।’