২১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
বুধবার | সকাল ৬:৩৮
মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা প্রশাসনে নারী নেতৃত্বের জয়জয়কার
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ৮ মার্চ, ২০২০, আরিফ হোসেন (আমার বিক্রমপুর)

ন-তে নারী, ন-তে নেতৃত্ব। শুধু প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল নয় প্রশাসনের মতো দাপুটে কর্মক্ষেত্রে এখন চলছে এই নেতৃত্বের জয়জয়কার।

মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা প্রশাসনের নির্বাহী অফিসার ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর মতো প্রধান দুটি পদ সহ অন্তত ডজন খানেক দপ্তরে এখন নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীরা।

৮ মার্চ নারী দিবস উপলক্ষে তাদের সাথে একান্ত আলাপ চারিতায় উঠে এসেছে তাদের নেতৃত্বের সফলতার কথা।

দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য অনেকেই মনে করেন এখনো মূল ধারার সাথে নারীর অগ্রগতির মাপকাঠি আশানুরুপ নয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সোনার বাংলা গড়ার জন্য নারীর ক্ষমতায়ন এখন সময়ের দাবী।

শ্রীনগর উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন পদে কর্মরত নারীরা মনে করেন নারী অফিসার হিসেবে পুরষের তুলনায় তারা কোন ভাবেই পিছিয়ে নেই। বরং দায়িত্ব পালনে তাদের রয়েছে নিষ্ঠার নজির।

মোসাম্মৎ রহিমা আক্তার, নির্বাহী অফিসার, শ্রীনগর উপজেলা ঃ ২৯ তম বিসিএসে নিয়োগ প্রাপ্ত এই কর্মকর্তা শ্রীনগর উপজেলা নির্বাহী হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন করেছেন ২০১৯ সালের ২২ সেপ্টেম্বর। বাবা-মায়ের স্বপ্ন লালন করে শ্রীনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোসাম্মৎ রহিমা আক্তার ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সামাজকল্যান ও গবেষণা ইনষ্টিটিউট থেকে ¯স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এর পর আর তাকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি ২৮ তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছিলেন। প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়ে কাজ করেছেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ও মানিকগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে।

শ্রীনগর উপজেলার সকল বিভাগের কাজকর্মের সমন্বয় ও দায়িত্ব তদারকি এবং জেলার সঙ্গে সমন্বয় করে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে চলেছেন এই নারী কর্মকর্তা।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই সাধারণ জনগনের মন জয় করেছেন। মাদক-জঙ্গীমুক্ত উপজেলা গড়া এবং যৌতুক-বাল্যবিয়ে রোধেও তার ভূমিকা সর্বস্তরে প্রসংশিত হচ্ছে। তার অফিসে কালিমা লেপন প্রতিরোধে তিনি কোন দুর্নীতির সাথে আপোষ না করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।

ঢাকা জেলা পরিষদের কাজ করার সময় রাণা প্লাজার ট্র্যাজেডি খুব কাছ থেকে দেখেছেন। রানা প্লাজা থেকে উদ্ধার করা লাশ ডিএনএ পরীক্ষার পর স্বজনদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তার সামনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা এখনো তাকে নাড়া দেয়। ওই সময় ছোট ছোট দুটি শিশু ছোট কাপড়ের টুকরা নিয়ে তার নিখোঁজ মায়ের লাশ খুঁজতে এসে একটি লাশের কফিন ধরে বসে থাকে। পরে দেখা যায় ওই লাশটি তাদের মায়েরই। বিষয়টি তার হৃদয়ে এখনো দাগ কেটে আছে। তিনি জানান, মানুষের জন্য কিছু করতে পারলে তার ভাল লাগে। তা ছোট বা বড় যে কাজই হোকনা কেন।

নিগার সুলতানা, সহকারী কমিশনার (ভূমি),শ্রীনগর উপজেলাঃ ৩৪ তম বিসিএসে নিয়োগ প্রাপ্ত এই কর্মকর্তা শ্রীনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন করেছেন ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর। তিনি জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্সে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। ২০১৬ সালে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়ে যোগ দেন ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে। নিগার সুলতানা শ্রীনগর উপজেলার এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন নিষ্ঠার সাথে। দখল উচ্ছেদ ও সরকারী স্বার্থ রক্ষায় তার সুনাম রয়েছে। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করছেন অহরহ।

নিগার সুলতানা জানান, নারী হয়ে এই পর্যন্ত আসার পেছনে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা থাকলেও বাবা পাশে ছিলেন সব সময়। তিনি আরো বলেন, সরকার নারীর ক্ষমতায়নের জন্য অনেক কিছু করছে। নারীকে মূল ধারার সাথে সম্পৃক্ত করে দেশকে এগিয়ে নিতে হলে তৃণমূল পর্যায়ে আরো কাজ করতে হবে।

নিগার সুলতানা কোন মানুষের উপকার করতে পারলে তৃপ্তি পান। উল্লেখ করেন, একদিন খুব সকালে এক ভদ্রলোক মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে তার বাসায় হাজির হন। তিনি জানান,ভূমি সংক্রান্ত একটি কাজ দ্রুত করে দেওয়ায় অনেক উপকৃত হয়েছিলেন তিনি। কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছেন বিধায় সাতসকালে মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। কন্যার নাম রেখেছেন নিগার সুলতানা। বিষয়টি এখনো তার মানসপটে গেথে রয়েছে।

গুল রাওশান ফিরদৌস, মহিলা বিষয়ক কর্মকতাঃ গুল রাওশান ফিরদৌস মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার পদে ২০০১ সালে নরসিংদী জেলার বেলাবো উপজেলায় যোগদানের মধ্য দিয়ে সরকারী চাকুরী শুরু করেন। রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হয়ে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। তিনি জানান, নারী হয়ে এই পর্যন্ত পৌছতে অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল। কিন্তু বাবার উৎসাহ ছিল অনেক। চাকুরী জীবনে আইন ও অফিস ব্যবস্থাপনা বিষয়ে এডমিন একাডেমিতে প্রশিক্ষনে দ্বিতীয় হয়ে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া ভ্রমন করার সুযোগ পেয়েছিলেন।

মাহফুজা পারভীন চৌধুরী, সমাজ সেবা অফিসারঃ মাহফুজা পারভীন চৌধুরী শ্রীনগর উপজেলা সমাজসেবা অফিসার পদে আছেন প্রায় ৩ বছর হলো। তিনি ১৯৯৬ সালে লালমনিরহাট জেলা হাসপাতালে সমাজসেবা অফিসার পদে যোগ দানের মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয় থেকে সমাজ কর্ম বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। ২০০৬ সালে ভিডিও গেম ডাকাতি ও আলোচিত বাধন হত্যা চেষ্টার ঘটনায় তিনি সমাজকল্যান মন্ত্রনালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তা হিসেবে আদালতের নির্দেশে তদন্ত করতে গিয়ে তুলে ধরেণ নগর জীবনে শিশুর প্রতি বাবা মায়ের অবহেলার ভয়াবহ তথ্য। তার তুলে ধরা প্রতিবেদনের বিষয়ে প্রখ্যাত আইনজীবি শাহদীন মালিকের মন্তব্য ছিল, এটা আরো ৩০ বছর পূর্বেই তুলে ধরা দরকার ছিল। তিনি আলোকিত নারী পুরস্কার সহ বিভিন্ন সন্মাননা পেয়েছেন।

মোসাম্মৎ জান্নাতুল ফেরদৌস, প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারঃ ১৯৯৬ সালে মোসাম্মৎ জান্নাতুল ফেরদৌস সহকারী শিক্ষা অফিসার হিসেবে গাজীপুরে যোগদানের মাধ্যমে চাকুরী জীবন শুরু করেন। এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনি জানান, স্নাতকোত্তর প্রথম বর্ষে থাকাবস্থায় তার বিয়ে হয়। বিয়ের পরে এই পর্যন্ত আসতে স্বামীর সহযোগীতা পেয়েছেন অপরিসীম। মানসিক শক্তি বেশী তাই নারী হিসেবে কাজের ক্ষেত্রে কোন অসুবিধা হয়নি।

সুরাইয়া আশরাফী, মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারঃ ২০১৯ সালের ২১ মে সুরাইয়া আশরাফী শ্রীনগর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার পদে যোগ দেন। তিনি ১৯৯৫ সালে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে চাকুরী জীবন শুরু করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পলিটিক্যাল সাইন্সে স্নাতকোত্তর শেষ করেন। তিনি জানান, তার মা সহ পরিবারের বেশীর ভাগ নারী সদস্য চাকুরী করায় নারী হয়ে এই পর্যন্ত আসতে কোন বাঁধা পেতে হয়নি। তিন বোনের সবাই সরকারী চাকুরী করেন।

রাবেয়া বসরী, পল্লী উন্নয়ন অফিসারঃ জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় থেকে বোটানীতে স্নাতকোত্তর করা এই নারী শ্রীনগর উপজেলা পল্লী উন্নয়ন অফিসার পদে যোগ দেন ২০১৩ সালে। পরিবারে তারা ২ বোন থাকার কারণে এই পর্যন্ত কোন বাধা আসেনি। বাবা-মায়ের সহযোগীতা পেয়েছেন অফুরন্ত। তার মতে, নারীর এখনো পুরুষের উপর থেকে নির্ভরশীলতা কমাতে পারেনি। স্বনীর্ভর না হলে নারী অগ্রগতি কঠিন।

সুলতানা রাজিয়া,-জাতীয় মহিলা সংস্থা কর্মকর্তাঃ ১৯৯৫ সালে সুলতানা রাজিয়া কর্মক্ষেত্রে যোগ দেন। কাজ করেছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। নারী হিসেবে প্রতিষ্ঠার পেছনে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। নিজের অর্থে তিনি শ্রীনগরের ২৫ জন দরিদ্র ও অসহায় নারীর ঋণ পরিশোধ করে খেলাপী ঋণের তালিকা থেকে মুক্ত করেছেন।

বর্ত্তিকা চাকমা– পল্লী জীবিকায়ন কর্মকর্তাঃ আদিবাসী এই নারী শ্রীনগর উপজেলায় যোগদান করেন ২০১৬ সালে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে তিনি ২০০১ সালে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় সহকারী প্রকল্প কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। আদিবাসী হলেও কর্মক্ষেত্রে কোন বাধা ছিলনা। তিনি মানুষের জন্য কাজ করে শান্তি পান। বিশেষ করে ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে পারলে মনে প্রশান্তি জেগে উঠে।

এদের ছাড়াও শ্রীনগর উপজেলায় আরো কর্মরত নারী অফিসার রয়েছেন। এদের মধ্যে উপজেলা প্রাণী সম্পদ অফিসার হাসিনা নার্গিস, কৃষি অফিসার শান্তনা রাণী,পরিবার পরিকল্পনা অফিসার কাজী মমতাজ বেগম, সমবায় অফিসার হাবিবা আক্তার, সহকারী প্রোগ্রাম অফিসার শায়লা শারমিন তন্বী।

error: দুঃখিত!