মুন্সিগঞ্জ, ২০ মার্চ, ২০২২, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
মায়ের কোল থেকে ১০ মিটার দূরত্বে অন্য একটি ট্রলারে আদনান। আদনানের মায়ের চোখ-মুখে ততক্ষণে উচ্ছাস। যা কিছুক্ষণ আগেও ছিলো শঙ্কা আর চাপা কান্নায় মাখা।
পরম আদরের ধনকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন মা। হাত বুলিয়ে দিলেন মাথায়-কপালে। ভেবেছিলেন ছেলেকে হয়তো জীবিত পাবেন না। কিন্তু ছেলেকে পেলেন পুরোপুরি অক্ষত অবস্থায়। যেন মায়ের চোখে দ্বিতীয় জীবন ফিরে পাওয়ার আনন্দ দেখতে পেলেন ছেলে।
এই দৃশ্য আজ দুপুরের।
রোববার (২০ মার্চ) দুপুরে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় ডুবে যাওয়া মুন্সিগঞ্জগামী লঞ্চে ছিলেন মুন্সিগঞ্জের পঞ্চসার ইউনিয়নের নয়াগাঁও এলাকার আদনান দেওয়ান আদর (১৮)। সে প্রফেসর ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদ রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী। নারায়ণগঞ্জ থেকে মুন্সিগঞ্জে ফিরছিলো সে।
লঞ্চটি দূর্ঘটনার পরপর নদীতে ঝাপ দেন আদনান। নদীতে ভেসে থাকা পানির বোতল আঁকড়ে ধরে প্রাণপণ চেষ্টায় নিঃশ্বাস স্বাভাবিক রাখেন আদনান। এরপর স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে ট্রলারে তোলেন।
লঞ্চডুবির ঘটনা শুনে মুন্সিগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনাল থেকে ছেলের খোঁজে ট্রলার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর কয়লাঘাট অংশে পৌঁছান মা। সেখানেই দেখা হয় মা ও ছেলের। পরে তারা বাড়িতে ফিরে যান।
বেঁচে ফেরা আদনান বলেন, এটা অন্যরকম অনুভুতি। লঞ্চটি যখন ডুবে যাচ্ছিলো তখন সবাই আর্তনাদ করছিলো। আমি দ্বিকবিদিক না চেয়ে নদীতে লাফ দেই। লাফ দেয়ার সময় বারবার মায়ের চেহারা চোখে ভাসছিলো। নদীতে ভেসে থাকা পানির বোতল আঁকড়ে ধরে কোনরকমে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে থাকি। এরপর স্থানীয়রা আমাকে নদী থেকে উদ্ধার করে ট্রলারে তোলেন। যখন পানি থেকে আমাকে উদ্ধার করা হয় আমি তখনও বারবার মায়ের কথাই ভাবছিলাম। এর কিছুক্ষণ পরই দেখি মা ট্রলার নিয়ে আমাকে খুঁজতেছে। মা’কে দুর থেকে যখন দেখলাম তখন নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো। মনে হচ্ছিলো- মায়ের দোয়া আমার সাথে ছিলো। সেকারণেই আমি বোধহয় বেঁচে গেছি।
রোববার (২০ মার্চ) দুপুর ২টা ২০ মিনিটের দিকে নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর কয়লাঘাট অংশে সিটি গ্রুপের মালিকানাধীন রুপসী-৯ কার্গো জাহাজের ধাক্কায় মুন্সিগঞ্জগামী লঞ্চ এম এল আশরাফউদ্দিন ডুবে যায়। এসময় লঞ্চটিতে প্রায় অর্ধশত যাত্রী ছিলো বলে লঞ্চে থাকা বেঁচে ফেরা কয়েকজন দাবি করেছেন।
ঘটনার পর থেকেই যৌথভাবে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করছে বিআইডব্লিউটিএ, নৌ বাহিনীর ডুবুরি দল, কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশ।
নারায়ণগঞ্জ সদর নৌ পুলিশের ওসি মো. মনিরুজ্জামান রাত সাড়ে ১০টা’র দিকে জানান, সর্বমোট ৬ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ৪ জনের লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এরা সবাই মুন্সিগঞ্জের। ২ জনের পরিচয় এখনো পাওয়া যায়নি।
ডুবে যাওয়া লঞ্চটির মালিক মুন্সিগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনালের ইজারাদার দীল মোহাম্মদ কোম্পানি। লঞ্চে তার ছেলে তাপস (৩৬) থাকলেও সে প্রাণে বেঁচে গেছেন।
দূর্ঘটনার সময় লঞ্চটি চালাচ্ছিলেন লঞ্চ মাষ্টার মো. বিল্লাল হোসেন (৪৫)। তার বাড়ি মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার হাটলক্ষীগঞ্জ এলাকায়। লঞ্চ দূর্ঘটনার পর থেকে সে এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন।
ডুবে যাওয়া মুন্সিগঞ্জগামী লঞ্চটি উদ্ধারে ঘটনাস্থলে উদ্ধার অভিযান শুরু করেছে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয়। লঞ্চ উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত উদ্ধার অভিযান চালাবে তারা।
এ ঘটনায় ৩ টি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে অন্তত ১০ জন।
গজারিয়া নৌ পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ আব্দুস সালাম জানান, ৬-৭ জন সহ ঘাতক কার্গো রুপসী-৯ আটক করা হয়েছে। তবে তাদের নাম-পরিচয় এখন প্রকাশ করা যাচ্ছে না।
এখন পর্যন্ত ৬ জন নিহতের মরদেহ পাওয়া গেলেও নাম-পরিচয় জানা গেছে ৪ জনের। এরা হলেন, মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার উত্তর ইসলামপুর এলাকার জয়নাল ভূইয়া (৫০), রমজানবেগ এলাকার আরিফা (৩৫), তার শিশু সন্তান সাফায়েত (দেড় বছর), গজারিয়া উপজেলার ইসমানিরচর এলাকার শিল্পা রানী। বাকিরা অজ্ঞাত।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ জানান, লঞ্চডুবির ঘটনায় প্রতিটি মরদেহের সাথে প্রাথমিকভাবে ২৫ হাজার টাকা করে দেয়া হচ্ছে। উদ্ধার কাজ এখনো চলছে। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। উদ্ধার কাজ শেষ হলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়া হবে।