২২শে জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
বুধবার | রাত ১:৩৭
‘প্রেমিকা হত্যাকারী’ ছেলেকে পালাতে দিয়ে থানায় নিখোঁজের অভিযোগ দেন মা
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)

ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে নিজ হাতে গুলি করে প্রেমিকাকে হত্যা করা ছেলেকে রক্ষায় অভিনব কৌশল নেন মা। একদিকে মনপুরা দ্বীপে পালাতে নিজেই এগিয়ে দিয়ে আসেন, অন্যদিকে থানায় গিয়ে ছেলে হারিয়ে গেছে মর্মে অভিযোগ দেন তিনি। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে চৌকস গোয়েন্দাদের কৌশলে। অর্ধেক পথে গিয়ে ধরা পড়ে যায় ছেলে।

তৌহিদের মা ময়না বেগম গত ১ ডিসেম্বর (রোববার) কেরাণীগঞ্জ মডেল থানায় ছেলে হারানোর অভিযোগ দায়ের করেন। অথচ ওইদিনই সন্ধ্যায় তিনি, তার মেয়ে ও মেয়ে জামাই খুন করে পালানো ছেলেকে সদরঘাট গিয়ে লঞ্চে তুলে দিয়ে আসেন। তাদের ৩ জনকে একসাথে সদরঘাটে সনাক্ত করে ডিবি। ওই সূত্রেই পরদিন (সোমবার, ২ ডিসেম্বর) ভোরে গ্রেপ্তার হয় তৌহিদ।

আমার বিক্রমপুরের হাতে আসা তৌহিদের মা ময়না বেগমের দায়েরকৃত অভিযোগে বলা হয়, ‘২৯ নভেম্বর বিকাল ৩টায় বাসা থেকে বের হয় তৌহিদ। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও সে বাড়ি ফিরেনি।’ এছাড়া ‘সকল জায়গায় খোঁজাখুজি করেও তার সন্ধান পাওয়া যায়নি’ বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।

মূলত ২৯ নভেম্বর রাতে নিহত সাহিদা ইসলাম রাফাকে নিয়ে লোকাল বাসে করে মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় আসেন তৌহিদ। ৩০ নভেম্বর ভোর সাড়ে ৬টার দিকে মহাসড়কের দোগাছি ফুটওভার ব্রিজের অদূরে সেভেন পয়েন্ট থ্রি ফাইভ পিস্তল দিয়ে পরপর ৫ রাউন্ড গুলি ছুড়ে হত্যা করেন প্রেমিকাকে। পরে রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

সাহিদা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় দায়েরকৃত হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জেলা ডিবি পুলিশের উপ পরিদর্শক মো. ইয়াসিন জানান, নিহত সাহিদা ইসলাম রাফার (২৪) একাধিক সম্পর্ক নিয়ে তৌহিদ শেখ তন্ময়ের (২৩) সাথে দ্বন্দ ছিলো। ঘটনার আগের দিন রাতে (২৯ নভেম্বর, শুক্রবার) সাহিদাকে ফোন করে ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বেড়োতে বলে তৌহিদ। পরে লোকাল বাসে করে দুজনেই চলে আসে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটে। রাতভর সেখানে ঘোরাঘুরির পর শনিবার (৩০ নভেম্বর) ভোর সাড়ে ৬টার দিকে খানবাড়ি সিএনজি স্ট্যান্ড এলাকায় আসেন তারা। সেখানে প্রেমিকা সাহিদা নিজেকে আড়াই মাসের অন্তঃসত্ত্বা দাবি করে প্রেমিক তৌহিদকে বিয়ের জন্য চাপ দেয়। আশপাশের লোকজন তাদের মধ্যে চিল্লাচিল্লি শুনে এগিয়ে আসতে থাকলে তৌহিদ ওই নারীকে নিয়ে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের সার্ভিস লেন ধরে পদ্মা সেতু উত্তর টোল প্লাজা থেকে ২০০ মিটার অদূরে দোগাছি ফুটওভার ব্রিজ পার করে। পথে কয়েক দফায় সাহিদাকে চড়থাপ্পড় মারে তৌহিদ।

একপর্যায়ে আর রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সাথে থাকা থানা থেকে লুটকৃত পিস্তল দিয়ে প্রথমে এক রাউন্ড গুলি ছুড়লে সেটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। পরপরই আরও ৫ রাউন্ড গুলি ছুড়লে সেগুলো সাহিদার শরীরের বিভিন্ন অংশে বিদ্ধ হয়। মুহুর্তেই সড়কে উপুর হয়ে পড়ে মৃত্যু হয় সাহিদার।

রক্তাক্ত প্রেমিকার লাশ ফেলে দৌড়ে পিছন ফিরে যায় তৌহিদ। পুনরায় খানবাড়ি এলাকায় গিয়ে লোকাল বাসে চড়ে রওনা দেয় ঢাকার উদ্দেশ্য। মাঝপথে পিস্তলটি ফেলে যায় কেরাণীগঞ্জ বটতলী এলাকার বেইলি ব্রিজের নিচে।

ঢাকায় দ্বিকবিদিক না পেয়ে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে যাওয়ার চেষ্টা করে তৌহিদ। একপর্যায়ে আটিবাজার এলাকায় নিজের বোনের বাড়িতে গিয়ে ওঠে সে। ওই বাড়িতে বোন জামাই, বোন ও তৌহিদের মা লঞ্চে করে মনপুরা দ্বীপে আত্মগোপনে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয় তৌহিদকে।

পরদিন রোববার সন্ধ্যায় ওই ৩ জন সদরঘাট গিয়ে পৌঁছে দেয় তাকে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা-ভোলা-মনপুরা রুটের লঞ্চে উঠে পড়ে তৌহিদ। এদিকে সাহিদা হত্যার বিষয়টি সারাদেশে আলোড়ন তৈরি করলে আটঘাট বেঁধে মাঠে নামে ডিবি। তৌহিদকে প্রধান সন্দেহভাজন চিহ্নিত করে তার মোবাইল নাম্বারের সর্বশেষ লোকেশন নিশ্চিত হয় ডিবি।

তখন দেখা যায়, তৌহিদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি শুক্রবার রাতে সবশেষ ঢাকার ওয়ারি এলাকায় চালু ছিলো। এরপর থেকে সেটি বন্ধ আছে। তখন স্বভাবতই প্রশ্ন আসে তাহলে ডিবির সন্দেহ কি ভুল! এরইমাঝে আরেকটি সূত্র খুঁজে পায় ডিবি। তৌহিদের মোবাইল কলের সূত্র ধরে উদঘাটন হয় পরিবারের সকল সদস্যের নাম্বার।

রোববার ডিবির দলটি যখন ঢাকার আটিবাজারে তৌহিদের বোনের বাড়িতে অভিযানে যায় তখন তারা একসাথে তৌহিদের মা, বোন ও বোন জামাইয়ের মোবাইলের লোকেশন সদরঘাটে দেখতে পায়। এরপরে অভিযান কার্যক্রম আরও জোরদার করে ডিবি। চৌকস টিমটি ছুটে যায় সদরঘাটে। সিসিটিভি ক্যামেরায় তৌহিদের লঞ্চে উঠার দৃশ্য সনাক্ত করে তারা।

গ্রেপ্তারের পর ডিবির কাছে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই যুবক জানায়, গ্রেপ্তার এড়াতে কৌশলের অংশ হিসাবে মাওয়া আসার আগে ঢাকার ওয়ারিতে থাকতেই মোবাইলটি বন্ধ করে দেয় সে। যাতে হত্যার পর লুকালেও পুলিশ কোন ক্লু বের করতে না পারে।

এদিকে, সোমবার ভোরে মুন্সিগঞ্জ ডিবি পুলিশের ৫ সদস্যের ওই টিমটি অবস্থান নেয় ভোলার ইলিশা লঞ্চঘাটে। টার্গেট করা লঞ্চে অনুসন্ধানে ডিবির হাতে ধরা পড়ে তৌহিদ।

গত রোববার সকালে নিহত সাহিদা ইসলাম রাফার মা জরিনা খাতুন শ্রীনগর থানায় প্রেমিক তৌহিদ শেখ তন্ময়কে প্রধান অভিযুক্ত করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ওইদিন দুপুরে মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর রাতে ময়মনসিংহ সদরের বেগুনবাড়ি এলাকায় জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয় সাহিদার।

মঙ্গলবার এ ঘটনায় মুন্সিগঞ্জ পুলিশ সুপার কার্যালয়ে জেলা পুলিশ ‍সুপার মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। বিকালে ওই যুবককে হত্যা মামলায় মুন্সিগঞ্জ আদালতে প্রেরণ করলে আমলী আদালত-৩ এর বিচারক ইফতি হাসান ইমরানের উপস্থিতিতে ১৬৪ ধারায় দীর্ঘ জবানবন্দি দেয় সে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. ইয়াসিন জানান, হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি কেরাণীগঞ্জ ডোবা থেকে উদ্ধারের ঘটনায় কেরাণীগঞ্জ মডেল থানায় একটি মামলা হয়েছে। এছাড়া ওয়ারি থানা থেকে অস্ত্র লুটের ঘটনায় ওই থানায় দায়েরকৃত মামলায় তাকে আসামি হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সব মিলিয়ে ৩ টি মামলার আসামি সে।

তিনি জানান, থানা থেকে যে অস্ত্রটি তৌহিদ লুট করে সেটি লাইসেন্সকৃত ব্যক্তি মালিকানাধীন অস্ত্র। কোন একজন ব্যক্তি অস্ত্রটি থানায় জমা রেখেছিলো। ওই ব্যক্তি চাইলে তার অস্ত্র লুটের দায়ে তৌহিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারে। এতে তার বিরুদ্ধে মামলার সংখ্যা দাড়াবে ৪ টি।

নিহত সাহিদা রাজধানী ঢাকার ওয়ারিতে পরিবারের সাথে থাকতেন ও নারিন্দা এলাকার বলধা গার্ডেন সংলগ্ন জনৈক কামাল মিয়ার বাড়িতে দেখাশোনার (ডে-কেয়ার) কাজ করতেন। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার বেগুনবাড়ি গ্রামের মৃত মো. মোতালেবের মেয়ে তিনি। তারা ২ ভাই ও ৩ বোন। তাছাড়া ৭-৮ বছর আগে সাহিদার একটি বিয়েও হয়েছিলো। পরে সেই সম্পর্ক টিকেনি।

গ্রেপ্তারকৃত তৌহিদ শেখ তন্ময় রাজধানী ঢাকার ওয়ারী থানার বর্ণগ্রাম এলাকার মৃত শফিক শাহের পুত্র।

error: দুঃখিত!