২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ডেস্ক রিপোর্ট (আমার বিক্রমপুর)
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে ‘নতুন বাংলাদেশের’ অভ্যুদয় ঘটেছে, তার সঙ্গে ‘নতুনভাবে’ সম্পৃক্ত হতে বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
বাংলাদেশের সতের কোটি মানুষের নেতা হিসেবে জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছেন, “গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে আমি বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা ব্যাপকতর ও গভীরতর করার আহ্বান জানাই।”
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত জুলাইয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন একপর্যায়ে ব্যাপক সরকারবিরোধী অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। ৫ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা, যার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটে।
স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী এ আন্দোলনে আটশর বেশি মানুষের মৃত্যুর বিনিময়ে লেখা হয় নতুন ইতিহাস। নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়, যারা আন্দোলনকারী ছাত্রদের প্রত্যাশা অনুযায়ী বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিচ্ছে।
শুক্রবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রথমবারের মত বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে অধ্যাপক ইউনূস বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে বলেন, “আমাদের মুক্তি ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিতে আমি তাই বিশ্ব সম্প্রদায়কে আমাদের নতুন বাংলাদেশের সাথে নতুনভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার উদাত্ত আহ্বান জানাই।”
অতীতের রেওয়াজ অক্ষুণ্ন রেখে প্রধান উপদেষ্টা এই বিশ্বসভায় তার প্রথম ভাষণ দেন বাংলায়। তার পরনে ছিল ট্রেডমার্ক গ্রামীণ চেকের ফতুয়া আর কোটি। ভাষণের শুরুর দিকেই তিনি বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশে সংঘটিত যুগান্তকারী পরিবর্তনের কথা তুলে ধরেন।
ইউনূস আশা প্রকাশ করেন, “বাংলাদেশের এই অভ্যুত্থান আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা যুগিয়ে যাবে।”
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে কীভাবে ‘ধ্বংসস্তূপে’ পরিণত করা হয়েছে, সে কথা তুলে ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কার উদ্যোগের কথা ইউনূস জাতিসংঘে বলেছেন।
তিনি বলেছেন, এই সংস্কার যেন টেকসই করে ‘অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে তার সরকার কাজ করে যাচ্ছে। অতীতের ‘ভুলগুলো’ সংশোধন করে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও শক্তিশালী অর্থনীতি এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই তার সরকারের মূল লক্ষ্য।
নতুন সরকারের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরে ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশ ‘পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মর্যাদা ও স্বার্থ সংরক্ষণের ভিত্তিতে’ বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী।শান্তি, সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে বাংলাদেশ তার ভূমিকা ক্রমাগতভাবে জোরদার করে যাবে।
‘মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ নতুন করে চেনাল জেনারেশন জি’
প্রধান উপদেষ্টা তার বক্তব্যের শুরুতে একটি গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে বাংলাদেশ সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে জাতিসংঘে হাজির হাজির হওয়ার প্রেক্ষাপট বিশ্বনেতাদের সামনে তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, “এই জুলাই-অগাস্টে বাংলাদেশে যে যুগান্তকারী পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, তার প্রেক্ষিতেই আমি বিশ্বসম্প্রদায়ের এ মহান সংসদে উপস্থিত হতে পেরেছি। ছাত্র ও যুব সমাজের আন্দোলন প্রথমদিকে মূলত ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। পর্যায়ক্রমে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয়। সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ একনায়কতন্ত্র, নিপীড়ন, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে রাজপথ এবং সামাজিক-যোগাযোগ মাধ্যমে দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল।
“ছাত্রজনতা তাদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে। তাদের এই সম্মিলিত সংকল্পের মধ্যেই আমাদের দেশের ভবিষ্যত নিহিত।”
আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভূক্তিমূলক অংশীদারিত্ব চেয়েছিল মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের জনগণ একটি ন্যায্য, অন্তর্ভূক্তিমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, যার জন্য নতুন প্রজন্ম জীবন উৎসর্গ করেছিল। বন্দুকের গুলি উপেক্ষা করেও, বুক পেতে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল এই তরুণরা।
“অবৈধ রাষ্ট্রক্ষমতার বিরুদ্ধ প্রবলভাবে সোচ্চার হয়েছিল আমাদের তরুণীরা। স্কুলপড়ুয়া কিশোর-কিশোরীরা নিঃশঙ্কচিত্তে উৎসর্গ করেছিল তাদের জীবন। শত শত মানুষ চিরতরে হারিয়েছে তাদের দৃষ্টিশক্তি। আমাদের মায়েরা, দিনমজুরেরা ও শহরের অগণিত মানুষ তাদের সন্তানদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নেমেছিল রাজপথে।
৫৩ বছর আগে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এবারের আন্দোলনের পেক্ষাপটের সংযুক্তি টেনে ইউনূস বলেন, “উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার উপর মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পরে আমাদের ‘জেনারেশন জি’ নতুনভাবে আমাদের দেখতে শিখিয়েছে।”
চলছে সংস্কার, লক্ষ্য নির্বাচন
বিগত সরকারের সময় দেশের শাসন কাঠামোর অনেক স্তম্ভ ‘অকার্যকর’ হওয়ার কথা তুলে ধরে ইউনূস তার ভাষণে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেই সমস্যাগুলোর সংস্কারের মাধ্যমে নির্বাচনের পথে হাঁটবে।
তিনি বলেন, “একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে; কীভাবে রাষ্ট্রের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্মমভাবে দলীয়করণের আবর্তে বন্দি করে রাখা হয়েছিল; কীভাবে জনগণের অর্থ সম্পদকে নিদারুণভাবে লুটপাট করা হয়েছিল; কীভাবে একটি দেশের স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্যকে অন্যায়ভাবে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে দেশের সম্পদ অবাধে বিদেশে পাচার করে দিয়েছে; এককথায়, কীভাবে প্রত্যেকটি পর্যায়ে ন্যায়, নীতি ও নৈতিকতা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল।
“এরকমই এক অবস্থায় দেশকে পুনর্গঠন এবং জনগণের কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের উপর দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে। অতীতের ভুলগুলোকে সংশোধন করে একটি প্রতিযোগিতামূলক ও শক্তিশালী অর্থনীতি এবং ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলাই এই মুহূর্তে আমাদের মূল লক্ষ্য।”
বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সকল রাজনৈতিক দল এখন ‘স্বাধীনভাবে’ তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে বলে মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, যেসব ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় কাজ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত, তাদের প্রত্যেকের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করাই অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার।
“আমরা মানুষের মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়-ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে– এটাই জাতির আকাঙ্ক্ষা, এটাই আমাদের লক্ষ্য। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংরক্ষণ এবং সাইবার ডোমেনসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সুসংহতকরণেও আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”
ইউনূস বলেন, “আমাদের একজন কৃষক বা শ্রমিকের সন্তানও যেন সমাজের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছতে পারে, সেই লক্ষ্যে বিশালাকার অবকাঠামো নির্মাণের বদলে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধির ওপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করছি।”
বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, মর্যাদা ও স্বার্থ সংরক্ষণের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখব।”
অন্তর্বর্তী সরকার যে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে চায়, সেই ইংগিত আবার দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “মানুষের আস্থা ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে কিছু সুনির্দিষ্ট খাতে সংস্কারকে অগ্রাধিকার দিচ্ছি। বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা, সংবিধান, বিচার ব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা সংস্কারে স্বাধীন কমিশন গঠন করেছি। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের সংস্কারের জন্যও পৃথক কমিশনসহ আরো কয়েকটি বিষয়ে কমিশন গঠন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
“এসব সংস্কার যেন টেকসই হয়, তা দীর্ঘমেয়াদে নিশ্চিত করতে এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য উপযোগী পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সমতা ও সমৃদ্ধি অর্জনের মাধ্যমে একটি ন্যায়ভিন্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক সমাজ হিসেবে আত্মপ্রকাশের অভিপ্রায় বাস্তবায়নে আমি বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহযোগিতা ব্যাপকতর ও গভীরতর করার আহ্বান জানাই।”
‘জলবায়ু সঙ্কটে চাই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন’
জলবায়ু পরিবর্তনের ধারা যে বাংলাদেশের মত দেশের ভবিষ্যতের জন্য যে হুমকি তৈরি করছে, সে কথা তুলে ধরে এই ক্ষতির হাত থেকে মানুষকে রক্ষায় আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের তাগিদ দেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান।
তিনি বলেন, “এই গ্রীষ্মে সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গকারী তাপদাহ আমাদের জলবায়ুজনিত পরিবর্তনের কথা স্পষ্টভাবে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে৷ আমাদের জলবায়ু সম্পর্কিত ন্যায়বিচার প্রয়োজন, যাতে করে দায়িত্বজ্ঞানহীন সিদ্ধান্ত, উদাসীন আচরণ কিংবা এর মাধ্যমে সাধিত ক্ষতির বিষয়ে যারা সংশ্লিষ্ট তাদের দায়বদ্ধ করা যায়।”
এ বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ইউনূস বলেন, “মহাসচিব গুতেরেস আমাদের দেখিয়েছেন যে, বিদ্যমান পরিক্রমা অব্যাহত থাকলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হতে যাচ্ছে।
“বাংলাদেশের মত জলবায়ু ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোতে অভিযোজনের জন্য ব্যাপক বিনিয়োগের আহ্বান জানাচ্ছি। এছাড়াও, উদ্ভাবনী শক্তির প্রয়োগ ও অতিরিক্ত অর্থায়নের মাধ্যমে লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডকে কার্যকর করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
তিন শূন্য
জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে ইউনূস তার ‘থ্রি জিরো’ বা ‘তিন শূন্য’ ধারণা তুলে ধরেন। পাশাপাশি তিনি নিজের উদ্ভাবিত সামাজিক ব্যবসার ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে সমৃদ্ধ পৃথিবী গড়ার স্বপ্নের কথা বলেন।
ইউনূস বলেন, “সমগ্র বিশ্ব একসাথে “তিন-শূন্য’-এর ধারণা বিবেচনা করতে পারে, যার মাধ্যমে আমরা – শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ অর্জন করতে পারি। যেখানে পৃথিবীর প্রতিটি তরুণ-তরুণী চাকরি প্রার্থী না হয়ে বরং উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ পাবে।
“তারা যেন সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্বেও নিজ নিজ সৃজনশীলতার বিকাশ করতে পারে, যেখানে একটি ব্যবসায়িক উদ্যোগ সামাজিক সুফল, অর্থনৈতিক মুনাফা এবং প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীলতার মধ্যে একটি চমৎকার ভারসাম্য আনতে মনোযোগী হতে পারে, যেখানে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে যে কোনো ব্যক্তি ভোগবাদী জীবনধারা থেকে উত্তরণ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সৃজনশীল শক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন।”
তার মতে, সেই লক্ষ্য অর্জন করতে গেলে সকল উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশ এবং অংশীদারদের মধ্যে দরকার ‘নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন মূল্যবোধ এবং নতুন একতা’।
“সামগ্রিকভাবে, এই লক্ষ্য অর্জনে জাতিসংঘ ব্যবস্থা, জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে সরকারসমূহ, সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি অংশীজন (এনজিওসমূহ) এবং দাতব্য সংস্থাগুলোকে কাজ করতে হবে একসাথে। আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোতে সামাজিক ব্যবসাকে স্থান দিলেই নিচের অর্ধেকাংশ মানুষের জীবনে বিরাট পরিবর্তন আনতে পারে। এই পদক্ষেপ একই সঙ্গে জলবায়ুর ধ্বংসাত্মক গতিকে সফলভাবে রোধ করতে পারে প্রচলিত বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে।”
‘চাই যুদ্ধের অসান’
জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে চলমান ইউক্রেইন যুদ্ধ এবং ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধে বিশ্বনেতাদের কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ইউনূস।
তিনি বলেন, “বহুমুখী সংকটে জর্জরিত বর্তমান বিশ্বে, যুদ্ধ এবং সংঘাতের ফলে ব্যাপকভিত্তিতে মানুষের অধিকার খর্ব হচ্ছে। বিশ্ববাসীর উদ্বেগ এবং নিন্দা সত্বেও গাজায় গণহত্যা থামছে না। ফিলিস্তিনের বিদ্যমান বাস্তবতা কেবল আরব কিংবা মুসলমানদের জন্যই উদ্বেগজনক নয়, বরং তা সমগ্র মানবজাতির জন্যই উদ্বেগের।
“একজন মানুষ হিসেবে প্রত্যেক ফিলিস্তিনির জীবন অমূল্য। ফিলিস্তিনের জনগণের বিরুদ্ধে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ হচ্ছে, তার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে দায়বদ্ধ করতে হবে।”
যুদ্ধের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে সরকারপ্রধান বলেন, “ফিলিস্তিনের জনগণের ওপর চলমান নৃশংসতা, বিশেষত নারী এবং শিশুদের সাথে প্রতিনিয়ত যে নিষ্ঠুরতা বিশ্ব দেখছে, তা থেকে নিস্তারের জন্য বাংলাদেশ অনতিবিলম্বে সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানাচ্ছে। দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক সমাধানই মধ্যপ্রাচ্যে টেকসই শান্তি আনতে পারবে, তাই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সকলকে এর বাস্তবায়নের জন্য এখনই উদ্যোগ নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।”
ইউক্রেইন যুদ্ধ যে সবাইকেই ভোগাচ্ছে, সে কথা তুলে ধরে ইউনূস বলেন, “গত আড়াই বছর ধরে ইউক্রেইনে চলমান যুদ্ধে বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই যুদ্ধের প্রভাব সর্বব্যাপী। এমনকি বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও এর প্রভাব অনুভূত হচ্ছে।
“আমরা তাই উভয়পক্ষকেই সংলাপে বসে বিরোধ নিরসনের মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর আহ্বান জানাচ্ছি।”
‘রোহিঙ্গাদের ফেরার পথ সুগম হোক’
বাংলাদেশ আশ্রয়রত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর টেকসই ও শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসনের জন্য বিশ্ববাসীকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ গত সাত বছর ধরে মিয়ানমারের ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়ে আসছে।
“এর ফলে আমরা বিশাল সামাজিক-অর্থনৈতিক-পরিবেশগত ক্ষতির সম্মুীন হচ্ছি। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে সৃষ্ট এই সংকট বাংলাদেশ ও আমাদের অঞ্চলের জন্য প্রথাগত ও অপ্রথাগত উভয় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “আমরা রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালু রাখা এবং তাদের টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যাপ্ত সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানাচ্ছি।“
রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংঘটিত ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালত এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে চলমান বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও ‘সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ’ বলে মন্তব্য করেন ইউনূস।
তিনি বলেন, “রোহিঙ্গারা যাতে করে নিজ দেশে স্বাধীন এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবনধারণ করতে পারে, সে লক্ষ্যে অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবিদার। এ লক্ষ্যে রোহিঙ্গারা যাতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করে তাদের নিজ ভূমি রাখাইনে ফিরে যেতে পারে, তার পথ সুগম করা অত্যন্ত দরকার।”
অভিবাসন, শ্রম বাজার, এ আই
বাংলাদেশের দেড় কোটি মানুষ প্রবাসে জীবন যাপন করছেন জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, মানুষের জন্য মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে।
“সবার জন্য অভিবাসনের উপযোগিতা নিশ্চিত করতে বিশ্বসমাজকে নিরাপদ, সুশৃঙ্খল, নিয়মিত এবং মর্যাদাপূর্ণ অভিবাসনের পথ সুগম করতে হবে। অভিবাসনের ওপর ২০১৮ সালে যে গ্লোবাল কমপ্যাক্ট অন মাইগ্রেশন গৃহীত হয়েছে, তার পূর্ণ বাস্তবায়নে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ; এবং একই সাথে অনিরাপদ অভিবাসন রোধেও আমরা বদ্ধপরিকর।“
প্রতি বছর প্রায় পঁচিশ লক্ষ তরুণ-তরুণী বাংলাদেশের শ্রমবাজারে যুক্ত হচ্ছেন। বাংলাদেশের বিপুল জনশক্তির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই তরুণ। এই জনশক্তিকে বর্তমান ও আগামীর জন্য গড়ে তোলার বিষয়টিকে বাংলাদেশের জন্য একটি ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে বর্ণনা করেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “ক্রমপরিবর্তনশীল কর্মজগতে একজন তরুণকে প্রতিনিয়ত নতুন দক্ষতা অর্জন করতে হয়; এবং কর্মপরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়া শিখতে হয়। এজন্য বাংলাদেশ যখন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে উন্নীত হচ্ছে, তখন আমরা শিক্ষা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা লাভের উপর বিশেষ জোর দিচ্ছি।”
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভাবনীয় বিকাশ এবং এর বহুমাত্রিক প্রয়োগে বাংলাদেশের তরুণদের আগ্রহের কথা তুলে ধরে এআই এর ঝুঁকির দিকেও বিশ্বনেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ইউনূস।
তিনি বলেন, “আমাদের তরুণ সমাজ জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের সম্ভাবনা নিয়ে উচ্ছ্বসিত। একজন বিশ্ব নাগরিক হিসেবে তারাও চায় নতুন পৃথিবীতে নিয়োজিত হতে, কর্মক্ষম হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে। বাংলাদেশের মত বৃহৎ তরুণ জনগোষ্ঠীর দেশ যাতে কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার প্রয়োগজনিত অর্জিত সুফল থেকে পিছিয়ে না পড়ে, বিশ্ব সম্প্রদায়কে তা নিশ্চিত করতে হবে।
“একই সঙ্গে, নিশ্চিত করতে হবে যেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে কর্মক্ষেত্রে মানুষের চাহিদা সঙ্কুচিত হয়ে না যায়।”
স্ববিকশিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিষয়ে বিজ্ঞানীদের সতর্ক করে ইউনূস বলেন, “অটোনমাস ইনটেলিজেন্স, অর্থাৎ যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই নিজের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সম্প্রসারিত করতে পারে, মানুষের কোনো হস্তক্ষেপ ব্যতিরেকে, তার ব্যাপারে আমরা বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, তারা যেন এক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার আগে মানুষের ওপর এর প্রভাব সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে অগ্রসর হন। আমাদের ধারণা, অটোনমাস ইনটেলিজেন্স মানুষের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলতে পারে।”
নতুন বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি
বিশ্বের চলমান নানা সংকট মোকাবেলায় সকলের প্রচেষ্টা, সক্ষমতা ও সম্পদ একত্রীকরণের মাধ্যমে সকলের সামর্থ, উদ্ভাবনী শক্তি এবং সমৃদ্ধিকে কাজে লাগানোর ওপর জোর দেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং জলবায়ু সহনশীলতা নিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত যে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছি, সম্মিলিত উদ্যোগের মাধ্যমে তার মোকাবেলা করতে হবে।”
বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর অনন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ-দক্ষিণ এবং ত্রিভূজীয় সহযোগিতা এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে বলে মত দেন নোবেলজয়ী ইউনূস।
তিনি বলেন, বৈশ্বিক দক্ষিণের আওয়াজকে বিশ্বব্যাপী জোরালোভাবে তুলে ধরার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। সেজন্য, বৈশ্বিক এজেন্ডা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে বৈশ্বিক দক্ষিণের দেশগুলোর মতামতকে যথাযথ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।
“এ বছর আমরা জাতিসংঘের সাথে বাংলাদেশের অংশীদারত্বের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি। গত পঞ্চাশ বছর ছিল আমাদের জন্য একটি পারস্পরিক শিক্ষণীয়, সম্মিলিত যাত্রা। সীমিত উপায়ে বাংলাদেশ বৈশ্বিক শন্তি ও নিরাপত্তা, ন্যায়, সমতা, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ধারাবাহিকভাবে অবদান রেখে আসছে। আমাদের সমন্বিত প্রয়াস সত্যিকার অর্থে একটি নিয়ম-ভিত্তিক বৈশ্বিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
“আজ, এই মহান বিশ্বসভায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে, প্রতিধ্বনিত হচ্ছে শান্তি, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সকলের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করার আহ্বান। সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে আমাদের প্রত্যেককে আজ গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে কীভাবে আমরা নারী, পুরুষ, সকলের জন্য আজ ও আগামীর দিনগুলোতে উদ্যোক্তা হবার সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং তাদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে পারি।”
ইউনূস বলেন, “সকল বৈশ্বিক সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদের সবার হাতে যথেষ্ট সক্ষমতা, সম্পদ এবং উপায় রয়েছে। আসুন, আমরা জাতীয় বা আন্তর্জাতিকভাবে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছি, তা বাস্তবায়ন করি; এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামাজিক ব্যবসার ধারণা প্রতিষ্ঠিত করে সকল প্রকার বৈষম্য ও অসমতার অবসানে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি।”
বাংলাদেশের বিপ্লবের প্রসঙ্গ টেনে ইউনূস বলেন, তরুণরা প্রমাণ করেছে যে, মানুষের স্বাধীনতা, মর্যাদা ও অধিকার সমুন্নত রাখার অভিপ্রায় কোনো উচ্চাভিলাষ নয়; বরং এটা সকলের নিশ্চিত প্রাপ্য।
“আজ এই মহান সমাবেশে আপনাদের উপস্থিতিতে শান্তি, সমৃদ্ধি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ তার ভূমিকাকে ক্রমাগতভাবে জোরদার করার নিশ্চয়তা দিচ্ছে।”