১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ
বৃহস্পতিবার | দুপুর ১২:৩২
Search
Close this search box.
Search
Close this search box.
ধর্ম আমাদের কী দিয়েছে?
খবরটি শেয়ার করুন:

পাল্টা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয় ধর্ম আমাদেরকে কী দেয়নি? ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে একটা দারুণ ধর্মভীতি এবং ধর্মের ও ধার্মিকশ্রেণীর মানুষের প্রতি একটা আতঙ্কভাব ন্যূনপক্ষে অনীহা ও অশ্রদ্ধা লক্ষ্যে এ প্রসঙ্গটি আলোচনা জরুরি মনে হয়। যারা কথায় কথায় ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করেন তারাও ঐ অজ্ঞশ্রেণীরই অন্তর্ভুক্ত।
ধর্ম শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে- যা ধারণ করে মানুষ জীবনযাপন করে। আরবী শব্দটি হচ্ছে দ্বীন। রাগিব ইস্ফাহানীর বিখ্যাত কুরআন- অভিধান ‘আলমুফরাদাত ফী গারীবিল কুরআনে’ বলা হয়েছে- ‘দ্বীন শব্দটির অর্থ হচ্ছে আনুগত্য, প্রতিদান। শরীআতের তাবেদারী ও আনুগত্যকে দ্বীন নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। -আল মুফরাদাত, পৃ. ১৭৫, দারুল মা‘রিফা, বৈরুত, লেবানন
খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী বিখ্যাত আরবী অভিধানবিদ ইলিয়াস আনত‚ন ইলিয়াস তাঁর কামূসু ইলিয়াস আল‘আসরী (Elias modern Dictionary)-তে এর অর্থ লিখেছেন জবষরমরড়হ; Faith; belife । এর সাথে সাথেই তিনি তাকওয়া শব্দটিও জুড়ে দিয়েছেন এবং এর অর্থ লিখেছেন- Faith; belife কেননা, মূলত: তাকওয়া বা আল্লাহভীতিই হচ্ছে ধর্মের প্রাণস্বরূপ। জীবনভর আল্লাহর দ্বীনের আনুগত্যের পুরস্কার স্বরূপ শেষ বিচারের দিন যেহেতু স্বয়ং স্রষ্টা তাঁর বান্দাদেরকে উত্তম প্রতিদান দেবেন অথবা ধর্মহীন, আনুগত্যহীন অনাচারীদেরকে শাস্তি দেবেন তাই কিয়ামতের দিনকে আলকুরআনে ‘ইয়াওমুদ দ্বীন’ বা প্রতিদান ও হিসাব-নিকাশ দিবসরূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানব সৃষ্টির সাথে সাথে যে আসমানী নির্দেশ ও নির্দেশনা দান করেছেন, যার দ্বারা পৃথিবীতে মানবের সুন্দর সুস্থ জীবনযাপন এবং আখিরাতের মুক্তি অর্জিত হয়- তা-ই ধর্ম। তিনিই যেহেতু স্রষ্টা, তিনিই তাদের জীবিকাদাতা, তাই তাঁর বান্দারা কীভাবে পৃথিবীতে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারবে সে পন্থাটা তিনি দয়াপরবশ হয়ে নিজেই নির্দেশ করে দিয়েছেন।
আদি মানব হযরত আদম আ. ও মা হাওয়াকে বেহেশত থেকে পৃথিবীতে প্রেরণের সময় তাই তিনি বলে দিয়েছেন
فَاِمَّا یَاْتِیَنَّكُمْ مِّنِّیْ هُدًی فَمَنْ تَبِعَ هُدَایَ فَلَا خَوْفٌ عَلَیْهِمْ وَ لَا هُمْ یَحْزَنُوْنَ
অর্থাৎ, তারপর পৃথিবীতে তোমাদের কাছে আমার যে হেদায়েত বা দিকনির্দেশনা আসবে; যারা তার অনুসরণ করবে, তাদের জন্যে কোনো ভয় নেই, তাদের দুশ্চিন্তারও কারণ নেই। -সূরা বাকারা ২ : ৩৮
তাই ধার্মিক বা ধর্মপ্রাণ মানুষকে জীবনব্যবস্থার খোঁজে কোনোদিন অন্ধকারে হাতড়িয়ে ফিরতে হয়নি। যুগে যুগে নবী-রাসূলগণ প্রেরিত হয়েছেন। তাঁদের মাধ্যমে দুনিয়ার মানুষ তাদের যুগোপযোগী বিধান বা দিকনির্দেশনা লাভ করেছে। তাই কোনো যুগেই ধর্মপ্রাণ মানুষকে অন্ধকারে থাকতে হয়নি। শেষ নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রায় অসংখ্য নবী রাসূল পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে প্রেরিত হয়েছেন। তাঁদের মাধ্যমে পৃথিবী পেয়েছে তাওরাত-যবূর-ইঞ্জিল ও আলকুরআনের মত সুস্পষ্ট ধর্মগ্রন্থসমূহ, যেগুলোতে আল্লাহর আসমানী বিধান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিবৃত হয়েছে।
সুতরাং ধর্মের সবচাইতে বড় অবদান হচ্ছে, ধর্ম মানুষকে যুগে যুগে সুশৃঙ্খল, সুনিয়ন্ত্রিত, ভারসাম্যপূর্ণ জীবনবিধান দিয়ে অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে মুক্ত করেছে। স্রষ্টা যেহেতু বিশ্ববিধাতা তাই তাঁর সকল সৃষ্টির প্রতি তাঁর সমান স্নেহ মমতা। তিনি সর্বপ্রকার পক্ষপাতমুক্ত। তাই সাদা-কালো, ধনী-নির্ধন সকলের জন্যই তাঁর বিধান এক-সমান। সামর্থ্যবানের প্রতি তিনি সামর্থ্যহীনদের, সবলদের প্রতি দুর্বলদের দেখাশোনা ও যত্নআত্যির অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করেছেন। সামর্থ্যহীন বা ওযরগ্রস্তদেরকে ধর্মের কোনো কঠোর বিধান দেননি। সামর্থ্যমত আল্লাহর ইবাদত করার দায়িত্বই কেবল তাদের উপর অর্পিত হয়েছে।
নবী-রাসুলগণের অনেকেই বিশাল রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বও সফলভাবে পালন করেছেন। প্রথম দিকে যেহেতু পৃথিবী ছিল যোগাযোগ বিহীন শতধাবিচ্ছিন্ন তাই সে যুগের ধর্মীয় বিধানসমূহ ছিল নেহাৎই সাদামাটা। রাজনীতি-অর্থনীতির জটিল মারপ্যাঁচ সে যুগে ছিল না। যেমন ছিল না জীবনযাত্রার জটিলতা তেমনি ধর্মীয় বিধানেও সেগুলোর তেমন বিস্তৃত উল্লেখ ছিল না। পরবর্তীতে মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের দেশে দেশে। তাই নবী রাসূলও প্রেরিত হয়েছেন প্রতিটি জনপদে। আলকুরআনের ভাষায়, لكل قوم هاد- প্রত্যেক জাতির জন্যই রয়েছে পথপ্রদর্শক (নবী) -সূরা রা‘দ ১১:৭
ধর্ম আমাদেরকে যেমন স্রষ্টার ইবাদতের জন্যে উদ্বুদ্ধ করে তেমনি সৃষ্টির প্রতি দয়ারও শিক্ষা দেয়। প্রিয় নবীর হাদীসে আছে
ارحموا من في الأرض يرحمكم من في السماء
যমীনে যারা আছে তাদের প্রতি দয়া কর, তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯২৪
এমনকি অকারণে কোনো ছোট ইতর প্রাণীকে হত্যা করা বা কষ্ট দেওয়াও ধর্মের দৃষ্টিতে পাপ। মানুষের খাাবাররূপে পশু যবেহ বৈধ হলেও তাকে ধারালো ছুরি দিয়ে জবাই করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একটি প্রাণীর সম্মুখে আরেকটি প্রাণী জবাই করাও শরীআতে নিষিদ্ধ। এমনকি বিধর্মীদের দেবদেবীকে গালি দেওয়া বা তাদের ধর্মগুরুদের হত্যা করা যুদ্ধের সময়ও নিষিদ্ধ। তাবলীগ বা ধর্ম প্রচার হবে হিকমত ও যুক্তির সাহায্যে। গাল দিয়ে বা জবরদস্তি করে নয়।
ধর্ম আমাদেরকে দিয়েছে পরিচ্ছন্ন জীবনবোধ ও সামাজিক শৃঙ্খলা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণের একেকটি বাক্য পড়ে দেখুন। কী চমৎকার জীবনবোধের কথা ওগুলোতে উচ্চারিত হয়েছে। আদব-কায়দা তমীয-লেহায, সামাজিক শিষ্টাচার, এসবই তো ধর্মেরই দান!
তাওরাতের বিপ্লবী বাণীর মাধ্যমে মূসা আ. মিশরের হাজার হাজার বছরের ফেরাউনী তখতে তাউস ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছিলেন। যুলুম-নির্যাতন থেকে বনী ইসরাঈলকে উদ্ধার করে তদানীন্তন বিশ্বের সেরা জাতিতে পরিণত করেছিলেন। আলকুরআনের বিপ্লবী শিক্ষার মাধ্যমে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীর অবহেলিত ঊষর মরুর দেশ আরবের বেদুইনদেরকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিতে পরিণত করেছিলেন। আজকের উন্নত বিশ্বের সর্বোন্নত জাতিগুলোর শিক্ষকে পরিণত করেছিলেন। মাত্র তেইশটি বছরের নবুওতী মিশনের যে কী আশাতীত ফল ফলেছিল বিশ্ব ইতিহাস তার সাক্ষী। তদানীন্তন বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম দুটি শক্তি রোমক সাম্রাজ্য ও পারসিক সাম্রাজ্য তাঁর ওফাতের মাত্র এক যুগের মধ্যেই মুসলিম উম্মাহর দখলে চলে আসে এবং প্রায় দীর্ঘ আটশ বছর পর্যন্ত মুসলমানরা অর্ধেক বিশ্বকে প্রচণ্ড দাপটে শাসন করেন। শোষণমুক্ত করেন কোটি কোটি আদমসন্তানকে।
সুতরাং ধর্ম কী দেয়নি আমাদেরকে? এই সুজলা-সুফলা বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম অস্তিত্বটা কার দান? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথিত ‘শক হুন দল পাঠান মোগল এক দেহে হল লীন’ বক্তব্যকে একটা অবাস্তব তত্ত¡ বলে প্রমাণ করে বিংশ শতাব্দীর মধ্যপদে বিশাল হিন্দু ভারতের বুক চিড়ে উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে গড়ে উঠল হেলালী ঝাণ্ডার দেশ পাকিস্তান ও বাংলাদেশ। ইসলাম ধর্মের অবস্থান যে কত দৃঢ় বিশ্ববাসী নতুন করে তা প্রত্যক্ষ করল। ভাইয়ে ভাইয়েও বিবাদ হয়, ভাগাভাগি হয়, আমাদের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে। আমরা একাধিক রাষ্ট্রে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ দু’টি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের অধিকারী হয়েছি। অন্ততঃ আমাদের মুখে তো ধর্মের বিশেষতঃ ইসলামের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের প্রশ্নই উঠে না। প্রবল ধর্মবোধ ও উগ্র সাম্প্রদায়িকমনা হিন্দুরাও আমাদেরকে পৃথক করে দেয়া জরুরি বিবেচনা করেছে। সুতরাং ধর্মের প্রবল অবস্থান ও ভূমিকা কেবল মূর্খরাই অস্বীকার করতে পারে।
কাশ্মীর ভূস্বর্গ অভিধায় বিশ্বব্যাপী বহুপূর্ব থেকেই চিহ্নিত হলেও পরাধীনতার গ্লানিতে এক কোটি কাশ্মীরী মুসলিম আজ ধুকে ধুকে মরছে। আমাদের পরিণামটাও সেরূপ হলে কি খুব ভালো হত? সুতরাং ইতিহাসের সর্বনিম্ন অবস্থান থেকে বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল ও প্রতিশ্রুতিশীল দেশে পরিণত হওয়া বাংলাদেশ যদি কারো কাছে ঋণী হয়ে থাকে তবে তা এই ইসলামই। বাকী রইল ধর্মের নামে প্রতারণা ও শোষণের অপ্রিয় ইতিহাস। এজন্যে কিছু সংখ্যক প্রতারক ও ধূর্ত লোক দায়ী হলেও ইসলামকে সে জন্যে দায়ী করা চলবে না। সে ইতিহাসে আমাদেরও কমবেশী ভ‚মিকা অনস্বীকার্য। কেননা প্রশাসন, জাতীয় সংসদে আমাদের লোকেরাও ছিল। সে শাস্তি তারাও পাচ্ছে, আমরাও পাচ্ছি। ইসলামের অনুশাসনে ফিরে গিয়ে আমাদের এখন মুক্তির পথ খুঁজতে হবে। এছাড়া উপায় নেই।

ধর্ম আমাদের কী দিয়েছে তার সামান্য কিছু নমুনা স্বরূপ এখানে পেশ করা হল। আমাদের প্রতি ধর্মের দান ও অবদানের পরিমাণ অসংখ্য। একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনায় তার সবকিছু তুলে ধরা অসম্ভব। তাই এ বিষয়ে শিরোনাম পর্যায়ের একটি ঝলকই তুলে ধরা হল। কুরআন-হাদীস ও ধর্মীয় কিতাবাদী যত বেশি অধ্যয়ন করা হবে, পরহেজগার নির্ভরযোগ্য আলেমদের ছোহবতে যতবেশি যাওয়া হবে ততই এ প্রশ্নের উত্তর আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে, ইনশাআল্লাহ ।

error: দুঃখিত!