বিপিএল দলগুলোর মালিকানা কেনার জন্য ‘এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট’ জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল গত সোমবার। মঙ্গলবার সকালে বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের চেয়ারম্যান আফজালুর রহমান সিনহার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান একমিতে সভায় বসেছিল গভর্নিং কাউন্সিল।
সভা শেষে সংবাদ মাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে বিপিএল চেয়ারম্যান বলেন, “১১টি কোম্পানি আবেদন করেছে। আমরা এখন পরের ধাপে যাব। যাচাই-বাছাই করব, আগ্রহীদের সঙ্গে কথা বলব।”
গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্য সচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিক জানান মালিকানা কিনতে আগ্রহ দেখিয়েছে বেক্সিমকো গ্রুপ, মিডিয়াকম লিমিটেড (স্কয়ার গ্রুপের প্রতিষ্ঠান), ডিবিএল গ্রুপ, সোহানা গ্রুপ অব ইন্ডাট্রিজ, বিবিএস কেবলস, ব্লুজ কমিউনিকেশনস, এক্সিওম টেকনোলজিস, বেঙ্গল কমিউনিকেশনস, নেটওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ লিমিটেড, ইনডেক্স গ্রুপ ও ফাইবার অ্যাট হোম লিমিটেড।
বিপিএল সদস্য সচিব জানালেন, প্রত্যাশার চেয়ে ভালো সাড়া পেয়েছেন তারা।
“আমাদের ইচ্ছে ছিল ৫টি ফ্র্যাঞ্চাইজি দিয়ে শুরু করব। কিন্তু সাড়া অনেক ভালো বলে হয়ত আগের মতো ৭টা দিয়েই শুরু করতে পারি। নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি চূড়ান্ত করার সব প্রক্রিয়া আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে শেষ করে ফেলব আশা করি।”
বিবেচনায় ক্রিকেট প্রেম ও ভবিষ্যত লক্ষ্য
আগ্রহী ১১ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৭টি ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকানা কিভাবে বাছাই করা হবে, সেটাও বিস্তারিত জানালেন ইসমাইল হায়দার মল্লিক।
“আবেদন করা সবার সঙ্গে আমরা ওয়ান টু ওয়ান বসব, তাদের প্ল্যান অব অ্যাকশন শুনব। কিছু আর্থিক বাধ্যবাধকতা আছে আমাদের, কারা কারা সেগুলো মেটাতে পারে, সেটাও দেখব আমরা। তারপর সিদ্ধান্ত নেব।”
এভাবে দল যাচাই-বাছাই করলে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির সুযোগ এবং যোগ্য কোনো প্রতিষ্ঠানের বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা থেকে যায়। বিপিএল সদস্য সচিব অবশ্য সেসব শঙ্কা উড়িয়ে দিলেন।
“আমরা বলেছি, কেউ বঞ্চিত হবে না। আবেদনকারীদের বোর্ডের সঙ্গে বসে বোঝাতে হবে যে তাদের দীর্ঘ মেয়াদী লক্ষ্য কি, ক্রিকেটের জন্য কি করতে চায়, তাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কি। এসব আলোচনায় মিলে গেলেই দল পাবে।”
বিসিবির এই পরিচালকের দাবি, আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রায় সবকটিই খেলাধুলার সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে জড়িত।
“এখানে যারা আগ্রহ জানিয়েছে, প্রত্যেকেই প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগতভাবে কোনো না কোনো সময় ক্রিকেট ও অন্যান্য খেলার সঙ্গে জড়িত ছিল। সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সবাই জড়িত। আমরা এটা নিয়ে এর মধ্যেই কথা বলেছি।”
চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত ৭ প্রতিষ্ঠানের কে কোন বিভাগের মালিকানা পাবে, সেটাও ঠিক হবে আলোচনার মাধ্যমে।
আর্থিক বাধ্যবাধকতা
বিপিএল চেয়ারম্যান আর সদস্য সচিবের বক্তব্যে বারবারই উঠে এসেছে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আর্থিক বাধ্যবাধকতার কথা। সেটার ব্যাখ্যা দিলেন সদস্য সচিব।
“দল নেওয়ার সময় সবাই ভালো ভালো কথাই বলবে স্বাভাবিক। এজন্যই আমরা আর্থিক বাধ্যবাধকতা বেধে দিচ্ছি, কোনো কোম্পানি সেটা পূরণ করতে পারলেই পরের ধাপে যাব। আর্থিক দিকটির বিস্তারিত আমরা এখনই বলছি না। তবে উঁচু একটি মানদণ্ডই আমরা বেধে দেব।”
আর্থিক বাধ্যবাধকতার একটি ইঙ্গিত অবশ্য দিলেন বিপিএল চেয়ারম্যান আফজালুর রহমান সিনহা, ১ কোটি টাকার ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দিতে হবে আগ্রহীদের।
আর ক্রিকেটারদের পারিশ্রামিক ঠিক করে দেবে বিসিবি, জানালেন সদস্য সচিব।
গেম অন স্পোর্টসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন
বিপিএলের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার স্বত্ব পেয়েছিল গেম অন স্পোর্টস। ২০১১ সালে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকায় ছয় বছরের জন্য এই স্বত্ব কিনেছিল ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিটি। কিন্তু নানা অব্যবস্থাপনায় তুমুল সমালোচিত হয় গেম অন। দেনা-পাওনা নিয়েও বিসিবির সঙ্গে বাধে ঝামেলা। অবশেষে সমালোচিত সেই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি বাতিল হয়েছে, জানালেন ইসমাইল হায়দার মল্লিক।
“ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ গেম অনের সঙ্গে আমাদের সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এবার বিপিএল কোনো আলাদা ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি করবে না। পুরো স্বত্ব গভর্নিং কাউন্সিলের। আমরা প্রত্যেকটি জিনিস আলাদা কাউকে দায়িত্ব দেব। যেমন টিকেটিং এক পক্ষকে, ব্যবস্থাপনা আলাদা, প্রমোশন আলাদা, ওপেনিং কনসার্ট আলাদা, ব্যাঙ্কিং আলাদা, গ্রাউন্ড রাইটস আলাদা পক্ষকে। এককভাবে কেউ পাবে না।”
গেম অনের সঙ্গে সব দেনা-পাওনাও মিটে গেছে বলে জানালেন বিপিএল সদস্য সচিব।
সম্প্রচার চ্যানেল নাইনেই!
গেম অনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও একই মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ভার্গো মিডিয়া লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করছে না বিসিবি। ভার্গো মিডিয়ার টিভি চ্যানেল নাইনেই সম্প্রচারিত হবে আগামী চার মৌসুমের বিপিএল, জানালেন ইসমাইল হায়দার মল্লিক।
“গেম অনের সঙ্গে আমাদের একটা ত্রিপক্ষীয় চুক্তি ছিল। ওরা চ্যানেল নাইনকে সম্প্রচার সত্ত্ব দিয়েছে। চ্যানেল নাইনের কোনো পাওনা বাকি রাখেনি। এজন্য আমরা চ্যানেল নাইনকেই রাখছি আগামী চারটি আসর।”
বিতর্কিত গেম অনের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বলে শঙ্কার জায়গা থেকে যায় কিনা, সেই প্রশ্ন উঠল। বিপিএল সদস্য সচিব শঙ্কার কিছু দেখছেন না।
“গেম অন আমাদের পুরো টুর্নামেন্ট ম্যানেজ করত। আর চ্যানেল নাইন ব্রডকাস্টিং পার্টনার। চ্যানেল নাইনকে ছয় বছরের জন্য দেওয়া হয়েছিল। এখন চ্যানেল নাইনের দেনা বাকি নেই, চাইলেই তাই চুক্তি বাতিল করা যায় না। আর মালিক একই হতে পারে, তবে প্রতিষ্ঠান আলাদা হলে তো আলাদা করেই বিবেচনা করতে হবে।”
ক্রিকেটারদের পাওনা শোধ এই মাসেই?
বিপিএলের তৃতীয় আসরের দামামা বাজছে। কিন্তু আড়াই বছর আগে হয়ে যাওয়া দ্বিতীয় আসরে খেলা ক্রিকেটারদের অনেকের পারিশ্রামিক দেওয়া হয়নি এখনও। অভিযোগ আছে, পুরো টাকা পাননি কেউই। অনেকেরই বাকি চুক্তির বড় অংশ পাওনা, কেউ কেউ একেবারেই পাননি কিছু। ইসমাইল হায়দার মল্লিক এর কিছুটা দায় দিলেন ক্রিকেটারদেরই।
“বিদেশী ক্রিকেটারদের পাওনা বাকি নেই। দেশী ক্রিকেটারদের কারও কারও বাকি। সেই সময় আমরা ক্রিকেটারদের বলেছিলাম যে টাকা নিলে বোর্ডের মাধ্যমে নিতে, যাতে সঠিক হিসাবটা থাকে। কিন্তু ক্রিকেটাররা সেটা রাখেনি। ফ্র্যাঞ্চাইজিরা সরাসরি টাকা দিয়েছে, ক্রিকেটাররাও সেটা নিয়েছে। এখন দুই পক্ষের দেওয়া হিসাব মিলছে না, তফাত দেখা যাচ্ছে।”
বিপিএল সদস্য সচিব জানালেন, এই দেনা-পাওনা মেটানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান নাঈমুর রহমানকে।
“দুর্জয় ভাইকে এটা মেটানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। উনি কাজ অনেকটা গুছিয়েও এনেছেন। এই মাসের মধ্যেই দেনা বুঝিয়ে দেওয়া হবে বলে আশা রাখি আমরা।”
পুরোনো ফ্র্যাঞ্চাইজিদের সুযোগ সামান্য
চুক্তি বাতিল করে দেওয়া আগের ৭টি ফ্র্যাঞ্চাইজির কেউ কেউ আবার বিসিবির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে বলে জানালেন ইসমাইল হায়দার মল্লিক। তবে আগের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেনি বিসিবি।
“পুরোনো অনেকে যোগাযোগ করছে, কিন্তু সেটা আলাদা ব্যাপার। পুরোনো ৭টি ফ্র্যাঞ্চাইজির সঙ্গেই আমাদের আর্থিক দেনা-পাওনার ব্যাপার আছে। সেটি এখন আরবিট্রেশনে চলে গেছে, আমাদের আইনি বিভাগ সেটি দেখছে। আমরা যখন চূড়ান্তভাবে নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো ঘোষণা করব, তার আগে পুরোনোরা যদি দেনা ক্লিয়ার করে তারপর আবেদন করে, বোর্ড তখন বিবেচনা করবে। তবে এখনও কেউ সেটা করেনি।”
এত বিতর্ক আর দেনা-পাওনার পরও পুরোনোদের সামনে ওইটুকু সুযোগ কেন দেওয়া হলো, সেটির ব্যাখ্যাও দিলেন বিপিএল সদস্য সচিব।
“অবশ্যই আমরা নমনীয় নই। তাদের চুক্তি বাতিল করা হয়েছে, পাওনা নিয়ে আরবিট্রেশন চলছে। কিন্ত তারা দেনা শোধ করলে একটা বিবেচনা পেতেই পারে। কারণ এটা মাথায় রাখতে হবে যে পুরোনো ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর কেউ কেউ এর মধ্যেই ২০ কোটি টাকাও খরচ করেছে। যারা একেবারে কম খরচও করেছে, তাদেরও ৭-৮ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। তার পরও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে বোর্ড।”
পুরোনো বিতর্কিত মালিকদের কেউ যেন নতুন পরিচয়ে আসতে না পারে, সে ব্যাপারেও সতর্ক গভর্নিং কাউন্সিল, জানালেন সদস্য সচিব।
“আগ্রহী অনেকে হয়ত নামে একটা কোম্পানি, কিন্তু ভেতরে মালিকানা থাকতে পারে ৭-৮ জনের। সেখানে পুরোনো কেউ থাকতেও পারে। একদম পুরো যাচাই-বাছাই আমরা শেষ করতে পারিনি এখনও। তবে পুরোনোদের কেউ এবার কোনো গ্রুপে থাকলে আমরা অনুরোধ করব তাদের বাদ দিতে।”
শুরুর সম্ভাব্য তারিখ
ইসমাইল হায়দার মল্লিক জানালেন, নভেম্বরের ২২ অথবা ২৫ তারিখ শুরু হবে বিপিএল। পেছনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন।
সেক্ষেত্রে ফ্র্যাঞ্চাইজি ঘোষণার পর দলগুলি গুছিয়ে নেওয়ার সময় পাবে বড়জোর মাত্র দুই-আড়াই মাস। বিপিএল সদস্য সচিবের দাবি, সময় যথেষ্টই আছে।
“ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে কিন্তু ৭ দিন আগে আমরা দলবদলের তারিখ জানাই। যারা চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো দল গড়ে, আবাহনী-মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংক বা লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জ, তারা ওই সময়ের মধ্যেই গুছিয়ে নেয়। এখানে সেই একই রকমের টাকা লাগবে। আবেদন করা দলগুলির সঙ্গে আমাদের কথা হচ্ছে। তারা পারবে।”