৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
শনিবার | রাত ৮:০১
কাকে বলে ‘ভালো’ মেয়ে
খবরটি শেয়ার করুন:

রেহানা শবনম পাবলিক বাসেই কর্মস্থলে যাতায়াত করেন। গত মাসের ঘটনা। বাসে দাঁড়িয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন রেহানা। হঠাৎ পেছন থেকে এক পুরুষ যাত্রী তাঁর গায়ে হাত দিয়ে সামনে এগোতে বলেন। এর প্রতিবাদ করেন তিনি। পুরুষ যাত্রী তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে বলেন, ‘দিয়েছি তো কী হয়েছে। আমি তো কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে দিইনি।’ তখন রেহানা বলেন, ‘আপনার উদ্দেশ্য কী ছিল সেটা বিষয় নয়। আপনি কোনোভাবেই একজন নারীর শরীরে হাত দিতে পারেন না।’ এ কথার পরে সেই পুরুষ যাত্রীর সঙ্গে আরও কয়েকজন পুরুষ মিলে রেহানাকে নানান কথা বলে অপমান করতে শুরু করেন। একপর্যায়ে তাঁরা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন তিনি খারাপ মেয়ে বলেই ‘ছোট’ একটি বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ করছেন।
নারী-পুরুষ ভেদে সমাজে একটি প্রচলিত ধারণা রয়েছে, ভালো মেয়েরা চুপচাপ থাকে আর খারাপ মেয়েরাই কেবল প্রতিবাদ করে থাকে। সমাজে আদর্শ নারী হতে হলে তাকে অবশ্যই চুপ থাকতে হবে, সর্বংসহা হতে হবে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম বলেন, কোনো নারী আন্দোলন করবে, প্রতিবাদ করবে, কথা বলবে—এ সমাজ তা মেনে নিতে চায় না। তখন তাকে মুখরা রমণী খেতাব দেওয়া হয়। খারাপ মেয়ে বলা হয়। তবে যুক্তি, বিজ্ঞানমনস্কতা ও আধুনিক চিন্তা নিয়ে নারীকে নিজের জন্যই প্রতিবাদ করতে হবে।
‘স্বভাব-চরিত্র ভালো, চুপচাপ থাকে, মাথা নিচু করে কথা বলে, স্বামী-সন্তানের যত্ন করে, তর্ক-বিতর্কে জড়ায় না—এমন মেয়েরা ভালো মেয়ে।’ হারুন আকন্দের কাছে ভালো মেয়ের সংজ্ঞা এমনই। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা।
গৃহিণী নাজমার ভাষায়, ‘মুখরা নয়, মানুষকে মান্য করে, তারাই ভালো মেয়ে।’ ৫৭ বছর বয়সী চা বিক্রেতা ফজলু মোল্লা বলেন, ‘আলাপে ভালা, কতা (কথা) কম কয়, কেউ কিছু কইলেও চুপ থাহে, হেরাই ভালা মাইয়া।’
ঢাকার একজন পুলিশ কর্মকর্তা মনে করেন, ‘ভালো মেয়েরা শালীনতা ও পারিবারিক বন্ধন বজায় রাখে। বড়দের সম্মান করে, ঝামেলা এড়িয়ে চলে।’
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র সাঈদ মাহ্মুদ একটু ভিন্নভাবে ভালো মেয়ের বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেন। তাঁর ভাষায়, ‘সৌম্য, সব পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারে, স্মার্ট কিন্তু রুচিশীল আচরণের মেয়েরাই ভালো মেয়ে। আর মেয়েরা প্রতিবাদ অবশ্যই করবে, তবে তা হতে হবে যৌক্তিক।’
ভালো মেয়ের সংজ্ঞা কী অথবা একজন ভালো মেয়ের মধ্যে কী কী বৈশিষ্ট্য থাকবে, এ নিয়ে কথা হয় ঢাকার বিভিন্ন পেশার নানা বয়সী নারী-পুরুষের সঙ্গে। তাঁদের মতামত থেকে জানা যায়, সহনশীল, শান্তশিষ্ট, চুপচাপ, শালীনতা বজায় রেখে পুরুষের অধীনস্থ থেকে জীবন ধারণ করা মেয়েরাই ভালো। তারা পরিবারের সবার দিকে খেয়াল রাখবে, শ্বশুর-শাশুড়ির কথা মতো চলবে, স্বামীর অবাধ্য হবে না এবং ঘরের বাইরে যাবে না। যেকোনো পরিস্থিতিতেই নিজেকে মানিয়ে নেবে, যুক্তি-তর্ক বা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইসমত জাহান। অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করেন। এ নিয়ে তাঁকে কম ঝামেলা পোহাতে হয় না। শুধু ছেলে সহপাঠী নয়, মেয়েদের কাছেও তাঁর নেতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে। তাঁর এক বন্ধু বলেন, ‘মেয়েদের মধ্যে যদি মেয়েলি স্বভাব না থাকে, ছেলেদের মতো হয়, তবে তা ভালো নয়।’ একই রকম কথা বলে তেজগাঁও কলেজের একাদশ শ্রেণির কয়েকজন ছাত্র। মেয়েদের ইভ টিজিং করে এ কথা স্বীকার করে নিয়েই নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, ‘আমরা ভালো মেয়েদের উত্ত্যক্ত করি না। যারা খারাপ, শুধু তাদের উত্ত্যক্ত করি।’
তখন তাঁদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, ভালো মেয়ে কারা। উত্তরে বলেন, ‘যারা পার্কে যায় না, যাদের বয়ফ্রেন্ড নেই, ক্লাসে চুপচাপ থাকে, তর্ক করে না, তারাই ভালো মেয়ে।’ এদের মধ্যে একজন বলেন, ক্লাসের এক মেয়ে প্রেমের প্রস্তাবে রাজি হচ্ছিল না বলে তাকে তিনবার উত্ত্যক্ত করেছি। ‘যারা গলাবাজি করে না, তারাই ভালো মেয়ে’ বলেন সংবাদপত্র বিক্রেতা কাউসার।
এ ধরনের মনোভাবের জন্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে দায়ী করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক নেহাল করিম। তিনি মনে করেন, পুরুষেরা সমাজে কর্তৃত্ব করেন। তাই তাঁরা প্রতিবাদ পছন্দ করেন না, গ্রহণ করতে পারেন না। এটা বেশির ভাগ পুরুষের সহজাত প্রবৃত্তি। নারীদের প্রতিবাদী হয়ে বহু বছরের এই সামাজিক সংস্কার ভেঙে ফেলতে হবে। এ জন্য নারীকে অবশ্যই শিক্ষিত এবং উপার্জনক্ষম হতে হবে।
সমাজে নারীকে সঠিকভাবে মূল্যায়নের জন্য বিদ্যালয়ে জেন্ডারবিষয়ক শিক্ষার ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেন্ডার অ্যান্ড উইমেন স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারপারসন সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ। আর পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন ও নারীর ক্ষমতায়নের দিকটিতেও জোর দিতে হবে।
নারীর ক্ষমতায়নে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে জানিয়ে সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ আরও বলেন, নারীর ÿক্ষমতায়নের ফলাফল গ্রহণ করার জন্য পুরুষ এখনো মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে পারেনি। এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ক্ষেত্রে জেন্ডার-বিষয়ক শিক্ষা আবশ্যক।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, ‘নারীকে উত্ত্যক্ত করা, যৌন হয়রানি করা, এমনকি ধর্ষণের ক্ষেত্রেও নারীকেই দায়ী করা হয়। নারীকে যেন সবকিছু নীরবে সয়ে যেতে হবে। প্রতিবাদ বা অভিযোগ করলেই সে খারাপ মেয়ে হয়ে যাবে। এ মানসিকতা পরিবর্তন আবশ্যক। সরকারসহ সবাইকে, বিশেষ করে তরুণদের এগিয়ে আসতে হবে।

error: দুঃখিত!