১৯শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
বুধবার | সকাল ৯:৩৪
আড়িয়ল বিল : নামকরণ, ভৌগলিক সীমানা ও বর্তমান অবস্থা
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ৩০ জানুয়ারি, ২০২০, আব্দুর রশিদ খান (আমার বিক্রমপুর)

মুন্সিগঞ্জ এবং ঢাকা জেলার শ্রীনগর, নবাবগঞ্জ ও দোহার উপজেলার ১ লাখ ৬৭ হাজার একর জায়গা নিয়ে পদ্মা, ধলেশ্বরী ও ইছামতির মাঝখানে আড়িয়ল বিলের অবস্থান।

লম্বায় ২৬ কিলোমিটার ও পাশে ১২ কিলোমিটারের এ বিলের প্রাচীন নাম ছিল ‘চুড়াইন বিল’।

প্রাচীন বিক্রমপুর গ্রন্থ হতে জানা যায়, আড়িয়াল খাঁ নামে ব্রহ্মপুত্রের ১ টি শাখা নদী বিক্রমপুরের উপর দিয়ে প্রবাহিত ছিল, প্রাচীন বিক্রমপুরের অংশ মাদারীপুরে এখনো আড়িয়াল খাঁ নদীর অস্তিত্ব আছে। গঙ্গা ও ব্রম্মপুত্রের গতিপথ পরিবর্তিত হলে নদীর এ অংশটুকু মৃত নদীতে রুপান্তরিত হয়ে বিলের রুপ ধারন করে। পূর্ব নাম চুড়াইন বিল বদলে আড়িয়াল খাঁ নদীর নামানুসারে বিলের নাম ‘আড়িয়ল বিল’ হয়ে যায়।

বিলের সীমানা- দক্ষিণে দয়হাটা, শ্যামসিদ্ধি, প্রাণীমণ্ডল,সেলামতি, মত্তগ্রাম, গাদিঘাট, রাড়িখাল ও মাইজপাড়া। উত্তরে শ্রীধরপুর, বাড়ৈখালী, আলমপুর শেখরনগর, মদনখালি, সুতারপাড়া ও তেঘরিয়া। পূর্বে হাঁসাড়া, ষোলঘর, কেয়টখালী, লস্করপুর, মোহনগঞ্জ । পশ্চিমে কামারগাঁও, বালাসুর, জয়পাড়া, জগন্নাথ পট্টি, কাঁঠালবাড়ী, মরিচপট্টি, মহুতপাড়া গ্রামগুলো অবস্থিত।

বিলে ছোট বড় মিলে প্রায় হাজার খানেক জলাধার, ডোবাও ডাঙা (পুকুর) থাকলেও বড় বড় ডাঙাগুলো পূর্বে স্থানীয় জমিদার বা রাজারা খনন করেছিলেন। বিলের দক্ষিণ প্রান্তের উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ডাঙার (দিঘি) নাম হল- নৈমুদ্দিন, সানাইবান্ধা, বাগমারা, সাগরদিঘী, বৈরাগীর ডাঙা, খালেকসাব ডাঙা, মনসা, কালাচান দিঘি, বসুমালা, কলাগাছিয়া, নারকেলগাছিয়া, তালগাছিয়া, ঝরঝরিয়া, পরশুরাম, আঠারোপাখি, সাচরাতি, গাউচ্ছাভিটা, বাগবাড়ি, মইতপাড়া ও সেলামতি। ডাঙার মাছ স্টীমারে করে কলকাতা পর্যন্ত যেত, এ জন্য পালেরা বিল সংলগ্ন বালাসুরে খালের পড়ে বড় আরেকটি বরফকল নির্মাণ করেছিলেন। এ বিলে প্রথম দিকে শুধু মাত্র মাছ ধরা যেত, ক্রমান্বয়ে বিল পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেলে শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধানের আবাদ হত। সে সংগে শীতকালে অপেক্ষাকৃত উপরাংশে রবিশস্য ও মাটি কেটে ভিটিতে করল্লা, খিরাই, টমেটো, কুমড়া, লাউ ইত্যাদি শাকসবজির আবাদ হতে থাকে।

বিলে অসংখ্য দেশিও বিদেশি পাখির আনাগোনা ছিল, বুনো হাঁসগুলো সকালে পদ্মার চরে আশ্রয় নিত সন্ধ্যা হলেই দল বেঁধে আবার বিলে ফিরে আসত। বিলের চারপাশে মাছ ও সবজীর দৈনিক/ সাপ্তাহিক হাট বসতো, আমাদের নিকটবর্তী মাইজপাড়া সংলগ্ন ‘অদেরপাড়ের হাট’ থেকে গ্রামের লোকজন বর্ষাকালীন ছয় মাসের কুমড়া কিনে এনে ঘরের চৌকির নিচে রেখে দিত।

বিক্রমপুরের আড়িয়ল বিল ঘেঁষা একটি গ্রাম গাদিঘাট ও আমাদের শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক নুর মোহাম্মদ স্যার এক সময়ের অবহেলিত পানি কাঁদার শ্রীনগর উপজেলার জনপদ গাদিঘাটে যাতায়াতের রাস্তাঘাটসহ উন্নয়নের দৃশ্য লক্ষ্য করলাম। স্কুল জিবনে অনেক বারই গাদিঘাটে গিয়েছি, অনেকগুলো স্কুল সহপাঠি ছিল, দু’জন শিক্ষক মরহুম নুরমোহাম্মদ স্যার ও রফিক স্যার এ এলাকার বাসিন্দা ছিলেন, তখন গাদিঘাটে যেতে হলে ভাল কোন রাস্তাঘাট ছিল না,খাল বাঁশের সাঁকো পানি কাঁদা মাড়িয়ে ওখানটায় যেতে হত। স্যার এবং বন্ধুদের দেখেছি, ঢোলা পায়জামা পড়ে ক্লাসে আসত, এর কারণটা তাঁদের নিকট জেনেছি রাস্তায় পানি কাঁদা থাকায় পায়জামা ঢোলা হলে হাঁটুর উপড়ে টেনে উঠাতে সহজ হয়। দোস্ত জলিল একবার দাওয়াত দিলে বিলের ডাঙার (দিঘী) গরমা মাছ (রুই) দিয়ে ভাত খাওয়ালো, তখনকার মাছ স্বাদে অতুলনীয় ছিল।

গাদিঘাট গেলে উত্তরে কালো রঙের সারি সারি গজারী গাছের খুঁটিগুলো চোখে পড়ত। ‘৭৯ সালে আমাদের বাড়ির পাশে শ্রীনগর- ভাগ্যকূল রোডে পল্লী বিদ্যুতের খুঁটি লাগানো হল। একদিন দেখলাম, তিনদোকান বাজারে ট্রান্সফরমার বসানো হল- ভাবছিলাম আমাদের এলাকার সংযোগ দেবে কিন্তু না লাইন চলে গেল মাইজপাড়া পেরিয়ে গাদিঘাটে। ‘৮১ সালে গাদিঘাট আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। দক্ষিন রাড়িখাল বালাসুর প্রান্তে গেলে রাতের বেলা গাদিঘাটে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি দেখতাম। গাদিঘাট গ্রামটি বর্ষাকালে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠত, কারণ ভরা বর্ষায় ওখানে ২০-২৫ হাত পানি হত, ঢেউয়ের তোরে এমনিতেই তখন আমন ধান হত না, বাড়িঘর রক্ষার জন্য চারদিক কচুরি চাপিয়ে বাঁশের বেড়া দিয়ে রাখা হত, তারপরও মাঝে মাঝে অতিরিক্ত প্লাবণ ও ঝড়ে গ্রামটি ক্ষতিগ্রস্থ হত। ১৯৬৫ সালের ঝড়ে গ্রামের কোন ঘরের চালা অবশিস্ট ছিল না , আমরা শুনে বাইচের কোষা নিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম, তখন সরকারি ভাবে ওখানে ত্রাণ বিতরণ করতে দেখেছি। রফিক স্যার ‘৭১ সালে রাড়িখাল স্যার জে সি বোস ইন্সটিটিউশন ছেড়ে চলে আসেন, তিনি অনেকদিন আগেই মৃত্যুবরণ করেছেন, নুরমোহাম্মদ স্যার ৫৯- ৬৬ পর্যন্ত আমাদের স্কুলে শিক্ষকতা করে ষোলঘর হাইস্কুলে চলে আসেন, সেখান থেকে সহকারি প্রধান শিক্ষক পদে ২০০০ সালে অবসর নেন। তিনি এলাকার জনপ্রতিনিধিও ছিলেন, ১৯৭৬-৮২ সাল পর্যন্ত ২ টার্ম শ্যামসিদ্ধি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন, প্রায় ৯৩ বছর বয়স্ক নুরমোহাম্মদ স্যার এতদিন শাররিক ভাবে সুস্থ্যই ছিলেন, গত ২২ এপ্রিল ২০১৯ তিনি পরলোকগমন করেন।
গাদিঘাট অতিতে কুমড়ার জন্য বিখ্যাত ছিল, এখনও কুমড়ার আবাদ হয় পাশাপাশি লাউ, করল্লাসহ অন্যান্য সবজি উৎপন্ন হচ্ছে। বাজারে খুব ভোরে এবং বিকেলে মাছ ও সবজি উঠে, চাহিদা থাকায় দ্রুত বিক্রি হয়ে যায় কারণ বিলের মাছ এখনো সুস্বাদু। নানা কারণে আড়িয়ল বিল এখন পরিচিতি পেয়ে গেছে, বহু লোক আড়িয়ল বিল দেখতে চান কিন্তু পাকা ব্রীজ পর্যন্তই যাওয়া যায়, তারপরও ভালোভাবে বিল অবলোকন করা যায় না।

ব্রীজের কাছে পিকনিক স্পটসহ একটি পর্যবেক্ষণ টাওয়ার বানালে ভালো একটি বিনোদন কেন্দ্র হতে পারে।

আড়িয়ল বিলের খিরাই ও টমেটো

আগের দিনে শীতের এ সময়টায় আড়িয়ল বিলে ঢুকলে ভিটায় বসে যতোখুশী ফ্রি কচি খিরাই ও লাল টুকটুকে টমেটো খাওয়া যেতো, কিন্তু বহন করে নিয়ে আসায় নিষেধাজ্ঞা থাকতো। আড়িয়ল বিলে কৃষকরা যার যার খেতের মাটি কেটে ২/৩ হাত উঁচু ভিটা বানাতো, সে ভিটায় নিজেরাই খিরাই, টমেটো, লাউ চাষ করতেন। বিলে আগত কৃষি শ্রমিক, পথিক, মাছ শিকারি, পাখি শিকারিগণ ক্ষুধা নিবারণে কাঁচা এ সবজী চিবিয়ে খেতেন, আমরাও বিলে গেলে এগুলো শখে খেতাম, ভালোই লাগতো, সব কিছুই স্বাস্থ্যসন্মত। এখন বিলে অল্প পরিমানে এগুলোর চাষ হয় তবে লগ্নিকারক পাইকাররা ছাউনি করে পাহাড়া বসিয়েছে, এখন আর কেউ মাগনা খেতে পারে না। শীতের এ সবজী উঠার পরে নতুন করে কুমড়া আবাদ হয়, প্রচুর কুমড়া পাইকারদের হাত ঘুরে ঢাকা বা অন্যান্য জেলায় বিক্রির জন্য চলে যায়।

কালেম পাখি ও চখা চখি হাঁস- এ পাখি আমাদের আড়িয়ল বিলেও ছিল

বেগুনী এ কালেম পাখির স্থানভেদে বিভিন্ন নাম আছে যেমনঃ কালিম, কায়িম, কায়েম ও হাওড়ের নাম কামপাখি। আড়িয়ল বিলের বড় বড় ডাঙায় (দীঘি) ঘন কচুরিতে এদের বসবাস ছিল। শীতকালে সকালে রোদ পোহানোর জন্য সূর্যের দিকে বেড়িয়ে আসত , মানুষের সাড়া পেলে কচুরির ভেতর ঢুকে পড়ত। এরা জন মানবহীন এলাকায় কীটপতঙ্গ খাওয়ার জন্য দল বেঁধে হেটে বেড়াতো। এরা দেশীয় পাখি, যেখানে থাকে সেখানেই ডিম পেড়ে বাচ্চা ফুটায়। আড়িয়ল বিলে এদের আবাসস্থল অনিরাপদ হওয়ায় কালেম পাখি আর সেভাবে দেখা যায় না। সর্বশেষ ১৯৮০ সালে এ পাখি বিলের ডাঙায় আমিও দেখেছি।
চখা চখি হাঁস- গায়ের রঙ হলুদ পাখনার কিছু অংশ কালচে, সাদা ও সবুজাভ, এ হাঁস আমাদের আড়িয়ল বিল, আশেপাশের বিল,সল্পপানির ধান খেতে খাদ্যের সন্ধানে আসতো। মাঝে মাঝে জোড়া বেঁধে ঘুরে বেড়াত। দিনের বেশীর ভাগ সময়টা কাটাতো পদ্মার নির্জন চরে। এরা পরিযায়ী পাখি, শীত মৌসুমে এ দেশে আসে এবং গ্রীষ্মকালে প্রজনন পর্ব শেষে আবার ফিরে আসে। এখন আর ‘চখা’ নামের এ হাঁস আমাদের এলাকায় চোখে পড়ে না।

বিভিন্ন পাখির অভয়ারণ্য ছিল আড়িয়ল বিল

রাজহাঁস, বালিহাঁস, নারকলি হাঁস, হাড়গিলা, ঢেউস্যা, বড় পানকৌড়ে, কাঁচিখোচা, সরালিসহ অজস্র বকের সমারোহ দেখেছি। বিলের ডাঙার পাড়ের গাছগুলোতে প্রচুর ওয়াক (নিশিবক) দেখা যেত। সন্ধ্যা হলে পদ্মার চর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে হাঁস বিলের দিকে উড়ে আসত, আবার ভোর বেলা চরে ফিরে যেত। ৬০/৭০ দশকে সন্ধ্যা ও ভোরে বাড়ির উপর দিয়ে ঘরের চালায় বুনো হাঁসের উড়ে যাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ পেতাম, এমন কি বড় ঝাঁক হলে ঘরের টিনের চালা পর্যন্ত কেঁপে উঠত। এলাকার অনেক বাড়ির গাছে বকও পানকৌড়ির আস্তানা দেখতাম। ঝাঁপটানো আমবাগান ও বড় তেঁতুল গাছে নিশিবকেরা দিনের বেলা চুপচাপ বসে বিশ্রাম নিত, সন্ধ্যা হলেই খাদ্যের সন্ধানে বেড়িয়ে পরত, ভোরে আবার গাছে ফিরে আসত, সে সময় এদের “ওয়াক ওয়াক” ডাকের শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙত। এখন বিলে কেবল স্থানীয় জাতের জোঁড়া সরালি, পাতি পানকৌড়ে, কানিবক ও সাদা বক দেখা যায়।

তিনদোকানে বাজার ও মাইজপাড়া বাজারে আড়িয়ল বিলের মাছ, সবজী ও হোটেল

ঢাকা- দোহার রোডের ‘তিনদোকান বাজারে’ আড়িয়ল বিলের ডাঙা (দিঘী) হতে মাঝে মাঝে দেশী মাছ বিক্রির জন্য উঠে, তবে অর্ডার দিলে জেলেরা বিলের মাছ সরবরাহ করে থাকেন। বাজারে প্রতিনিয়ত বিলের সবজী ও বিক্রি হয়। এ ছাড়া মাইজপাড়া মাঠের উত্তর পাশে খুব ভোরে বিলের তাজা মাছ পাওয়া যায়। তিনদোকান বাজারে সকালের নাস্তা ও দুপুরের/রাতের খাবারের জন্য মোটামুটি মান সম্পন্ন ২/১ টি হোটেল দাঁড়িয়ে গেছে। এ ছাড়া হোটেলে সিংগারা শামুচাসহ অন্যান্য হালকা খাবার ও পাওয়া যায়। 

error: দুঃখিত!