র্যাপিড টেস্ট কিট নিয়ে বিতর্কের মধ্যেই দেশীয় প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্ভাবিত কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখার অনুমতি দিয়েছে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রকে এখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) অথবা আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআর,বি) ওই র্যাপিড কিট পরীক্ষা করাতে হবে।
এ সংক্রান্ত একটি চিঠি ইতোমধ্যে গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিএসএমএমইউর উপাচার্য এবং আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালকের কাছে পাঠানো হয়েছে।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান বৃহস্পতিবার বলেন, “আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে ওই কিটের কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে হবে। বিএসএমএমইউ অথবা আইসিডিডিআর,বিতে সেই পরীক্ষা করাতে গণস্বাস্থ্য রাজি হয়েছে।”
তিনি বলেন, কার্যকারিতা পরীক্ষাটি দুই জায়গাতেই হতে পারে, তবে যে কোনো একটি সংস্থার তত্ত্বাবধানে তা হতে হবে।
“সেখানে কার্যকারিতা পরীক্ষা হবে। সেই ট্রায়ালের রিপোর্ট বিএসএমএমইউ বা আইসিডিডিআর,বি আমাদের কাছে জমা দেবে। ট্রায়ালে উত্তীর্ণ হলে পরে আমরা রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়ায় যাব।”
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের চিঠি পাওয়ার কথা জানিয়ে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “এখন আমরা বিএসএমএমইউ‘র সাথে বসে একটা পরিকল্পনা করে উনাদেরকে আমাদের কিটটা দেব। উনারা কিট পরীক্ষা করে ঔষধ প্রশাসনের কাছে প্রতিবেদন জমা দেবেন।”
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. রুহুল আমিন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, “গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের উদ্ভাবিত জিআর কোভিড-১৯ র্যাপিড ডট ব্লট কিটের পারফর্মেন্স স্টাডি (কার্যকারিতা পরীক্ষা) গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড কর্তৃক প্রস্তাবিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় অথবা আইসিডিডিআর,বি থেকে সম্পন্ন করা যেতে পারে।”
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের কিট গবেষণা দলের সমন্বয়কারী ড. মহিব উল্লাহ খোন্দকার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত ২২ এপ্রিল থেকে আমাদের সাথে ঔষধ প্রশাসনের একটু টানাপোড়ন হয়েছে। আমরা যে কিটটা উদ্ভাবন করেছি, সেটার ইন্টারনাল ভেলিডেশন আমরা আমাদের ল্যাবে করেছি। নিয়ম অনুযায়ী তৃতীয় একটি গবেষণাগারে এর কার্যকারিতা পরীক্ষা বা এক্সটারনাল ভেলিডেশন করাতে হয়।
“এটি নিয়ম, যার জন্য আমরা এতদিন ধরে ঔষুধ প্রশাসনকে বলে আসছিলাম। উনারা দেরিতে হলেও আমাদের সেই অনুমতি দিয়েছেন।”
তিনি বলেন, কার্যকারিতা পরীক্ষার অনুমতি পাওয়ার মধ্য দিয়ে গণস্বাস্থ্যের কিটের অনুমতি পাওয়ার বিষয়টি এখন ‘দ্বিতীয় ধাপে’ গেল। আগামী সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসেই তারা বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বসবেন।
“এটা ফাইনাল স্টেইজ। সেখানে উত্তীর্ণ হলেই মূল্যায়ন। তারা মূল্যায়ন করে একটা প্রতিবেদন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে দেবে। তার ভিত্তিতেই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর আমাদের অনুমোদন দেবে।”
র্যাপিড টেস্ট কী
নতুন ধরনের একটি করোনাভাইরাস পৃথিবীজুড়ে মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ায় সব দেশেই এখন এ ভাইরাস পরীক্ষার ব্যবস্থা জরুরি হয়ে উঠেছে। শক্তিশালী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা থাকার পরও শুধু পরীক্ষার কিটের অভাবে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বেগ পেতে হচ্ছে অনেক উন্নত দেশকে।
করোনাভাইরাস পরীক্ষার জন্য বিশ্বে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য পদ্ধতির নাম রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেইন রিঅ্যাকশন (আরটিপিসিআর)। বাংলাদেশে এখন কেবল এ পদ্ধতিতেই করোনাভাইরাস পরীক্ষার অনুমতি রয়েছে।
করোনাভাইরাস যেহেতু মানুষের শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ ঘটায়, তাই নমুনা হিসেবে রোগীর লালা, শ্লেষ্মা বা কফ পরীক্ষা করা হয়। নমুনায় করোনাভাইরাস আছে কি না তা বুঝতে ব্যবহার করতে হয় বিশেষ রি-এজেন্ট। পিসিআর পরীক্ষার কিটকে বলা হয় পিসিআর প্রাইমারি প্রোব রি-এজেন্ট।
রোগীর নমুনায় নতুন করোনাভাইরাসের জিনোম বৈশিষ্ট্যের কোনো জেনেটিক বিন্যাস পাওয়া গেলে ফলাফল আসবে ‘পজেটিভ’।
পরীক্ষাটি করতে সময় লাগে দুই ঘণ্টার বেশি। তাছাড়া ব্যয়বহুল আরটি-পিসিআর ব্যবহারে দক্ষ জনবল প্রয়োজন হয়।
সে কারণে স্বল্প সময়ে স্বল্প খরচে ফল দিতে পারে-এমন কিট তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। একে বলা হয় র্যাপিড টেস্টিং কিট। বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রও এ ধরনের একটি র্যাপিড টেস্ট কিট উদ্ভাবনের কথা বলছে।
এই কিটে পরীক্ষার জন্য নমুনা হিসেবে রোগীর রক্ত ব্যবহার করা হয়। ভাইরাস নয়, এই কিট দিয়ে আসলে শনাক্ত করা হয় অ্যান্টিবডি। গণস্বাস্থ্যের দাবি, তাদের কিট অ্যান্টিজেনও শনাক্ত করে।
শরীরে ভাইরাসের সংক্রমণ হলে এর বিরুদ্ধে লড়তে শরীরই এক পর্যায়ে প্রতিরোধী ব্যবস্থা তৈরি করে তৈরি করে নেয়, যাকে বলে অ্যান্টিবডি। আর যে জীবাণুর প্রতিক্রিয়ায় অ্যান্টিবডি তৈরি হয়, তাকে বলে অ্যান্টিজেন। সেই অ্যান্টিবডির কাছে ভাইরাস পরাজিত হলে রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।
চিকিৎসকরা বলছেন, কেউ নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে তার রক্তে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পাঁচ থেকে ১০ দিন সময় লাগতে পারে। ফলে, অ্যান্টিবডি তৈরি হওয়ার আগে র্যাপিড কিটে নমুনা পরীক্ষা করা হলে ফলাফল নেগেটিভ হবে। অর্থাৎ, শরীরে ভাইরাস থাকলেও এই পরীক্ষায় তা ধরা পড়বে না।
আবার কেউ আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠলেও তার রক্তে অ্যান্টিবডি থেকে যাবে। ফলে তার শরীরে ভাইরাস না থাকলেও র্যাপিড কিটের টেস্ট ফলাফল পজিটিভ আসবে।
বিশ্বের অনেক দেশেই বিশেষজ্ঞরা র্যাপিড কিট ব্যবহারের এই বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে আসছেন। বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থাও অ্যান্টিবডি পরীক্ষার ওপর নির্ভর না করার পরামর্শ দিয়ে আসছে। প্রচুর পরিমাণে ভুল রিপোর্ট আসায় ভারত ইতোমধ্যে চীন থেকে প্রায় দশ লাখ র্যাপিড কিট আমদানির অর্ডার বাতিল করেছে।
বিতর্ক
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সঙ্কটের শুরুর দিকে যখন কিট সঙ্কট প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছিল, তখনই দেশীয় প্রতিষ্ঠান গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রধান বিজ্ঞানী ও গণবিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিজন কুমার শীল কোভিড-১৯ রোগ শনাক্তে কিট উদ্ভাবনের খবর দেন।
এরপর চীন থেকে কাঁচামাল (রি-এজেন্ট) এনে কিটের স্যাম্পল তৈরির কাজ শুরু করেন তারা। গণস্বাস্থ্যের পক্ষ থেকে জানানো হয়, তাদের এই ‘জিআর কোভিড-১৯ ডট ব্লট কিট দিয়ে ৫ মিনিটে করোনাভাইরাস পরীক্ষার ফল পাওয়া যাবে, খরচ হবে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় শুরু থেকেই বলে আসছে, এ ধরনের কিটে পরীক্ষার ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত ফলস পজেটিভ কিংবা ফলস নেগেটিভ রেজাল্ট আসে। মহামারীর এই সময়ে এরকম ভুল ফলাফল মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে, কারণ ফলস নেগেটিভ রেজাল্ট পেয়ে কেউ নিজেকে ভাইরাসমুক্ত মনে করলেও বাস্তবে তিনি হয়ত বহু মানুষকে আক্রান্ত করবেন।
এর মধ্যেই গত ২৫ এপ্রিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র তাদের উদ্ভাবিত টেস্টিং কিটের নমুনা হস্তান্তর অনুষ্ঠানের আয়োজন করে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিজেস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) প্রতিনিধির কাছে কিটের নমুনা তুলে দেওয়া হয়। তবে সরকারের কোনো প্রতিনিধি সেখানে ছিলেন না।
গণস্বাস্থ্যের ট্রাস্টি জাফরুল্লাহ পরদিন সংবাদ সম্মেলন করে কিট অনুমোদনে গড়িমসির অভিযোগ আনেন।
এর জবাবে ২৭ এপ্রিল ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান ‘অপপ্রচার’ না করতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, “এতদিন জানতাম যে উনারা অ্যান্টিবডি কিট তৈরি করবেন। কিন্তু গত দুই-তিনদিন ধরে দেখছি যে উনারা অ্যান্টিজেন দেখবেন। আমার জানা নাই, পৃথিবীর কোথাও রক্ত থেকে অ্যান্টিজেন দেখা হচ্ছে বলে।”
র্যাপিড টেস্ট কিটের বিষয়ে অনুমতির জন্য ঔষধ প্রশাসনে ১৮টি আবেদন রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “যেহেতু ডাব্লিউএইচও রিকমেন্ড করে না, তাই র্যাপিড কিট আমাদের দেশে চালু হয়নি। বরং নির্ভরশীল টেস্ট কিট হল আরটি-পিসিআর।
“তারপরও উনারা একটি টেস্ট ডেভেলপ করছেন, আমাদের দিক থেকে ঔষধ প্রশাসনের দিক থেকে উনাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম এবং এখনও আছি।”