২১শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
বুধবার | রাত ৯:১৪
মুন্সিগঞ্জ বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুসছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা
খবরটি শেয়ার করুন:

মুন্সিগঞ্জ, ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২২, বিশেষ প্রতিনিধি (আমার বিক্রমপুর)

দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর পদবঞ্চিত নেতাকর্মীদের হতাশার কারণে মুন্সিগঞ্জে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুসছেন তৃণমূল নেতাকর্মীরা। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে একাধিক কমিটি গঠনের অভিযোগ উঠেছে।

তৃণমুলের একাধিক নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে পাওয়া গেছে এমন চিত্র। তাদের অভিযোগ, জেলার পৃথক দু’টি উপজেলা ও একটি পৌরসভা পর্যায়ে আহবায়ক কমিটি গঠনে স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়ম করা হয়েছে।

এর মধ্যে জেলার সিরাজদিখান উপজেলার আহবায়ক কমিটি বাতিল চেয়ে কেন্দ্রীয় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বরাবর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাসুদুর রহমান কুট্টি ও জসিম উদ্দিস খান খোকন এবং সাবেক সভাপতি দেলোয়ার হোসেন ভূইয়া একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।

এছাড়া জেলার লৌহজং উপজেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি ও জেলা সদরের মিরকাদিম পৌর বিএনপির আহবায়ক কমিটিও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় করা হয়নি বলে অভিযোগ তৃণমুল নেতাকর্মীদের।

তাদের দাবি, স্ব-স্ব উপজেলার ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের নিয়ে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হোক। তাহলেই ত্যাগী নেতারা স্থান পাবে এবং মুল্যায়নও পাবে। শুধু তাই নয়, অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কমিটি হলে আন্দোলন সংগ্রামে নেতাকর্মীদের সক্রিয় ভূমিকা পালনে অনীহা দেখা দিতে পারে বলেও মনে করেন পদবঞ্চিত নেতাকর্মীরা।

এদিকে, বিরোধী অবস্থানে থেকে সরকার বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে বছরের পর বছর ধরে জেলার ৬ উপজেলার কোথাও ঐক্যবদ্ধ হতে পারছেনা দলটির নেতাকর্মীরা। এর কারন হিসেবে পকেট কমিটি গঠনকেই দায়ী করছেন তারা।

এক সময় ‘মুন্সিগঞ্জের মাটি বিএনপির ঘাঁটি’ এই কথা সারাদেশে প্রচলিত ছিলো। এর উপর ভিত্তি করে জেলার অনেকেই কেন্দ্রীয় পর্যায়ে নেতৃত্বও দিয়ে আসছেন। অনেকে দল ক্ষমতায় থাকাকালে উপহার হিসেবে পেয়েছেন মন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির পদ পর্যন্ত।

গেলো বছরের ২৫ আগষ্ট মুন্সিগঞ্জ জেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি গঠন করা হয়। এতে আব্দুল হাইকে আহবায়ক ও কামরুজ্জামন রতনকে সদস্য সচিব করে ৫৮ সদস্যের কমিটি ঘোষনা করা হয় কেন্দ্র থেকে।

এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ওই আহবায়ক কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। গঠন হয়েছে পাল্টা কমিটিও। এর আগেও এই দুইজনকেই দায়িত্বে রেখে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গঠন হয়। পরে ৫ বছরেরও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি আব্দুল হাই ও কামরুজ্জামানর রতন।

তৃণমূলের একাধিক নেতাকর্মীর অভিযোগ, জেলা বিএনপির কমিটিতে পরীক্ষিত নেতাদের স্থান নেই। জেলা বিএনপির আহবায়ক আব্দুল হাই সংগঠনকে তার পারিবারিক দল হিসেবে পরিণত করেছে।

তারা বলছেন, জেলা বিএনপির আহবায়ক, তার আপন ছোট ভাই মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আহম্মেদ সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি, তার স্ত্রীর বড় ভাই শাহজাহান খান লৌহজং উপজেলা বিএনপির সদ্য ঘোষিত আহবায়ক এবং আপন ভায়রা ভাই মিরকাদিম পৌর বিএনপির আহবায়ক জসিম উদ্দিন। এরা প্রত্যেকেই প্রায় যুগ যুগ ধরে এসব পদ পদবী আগলে রেখেছেন। এরাই দলের নীতি-নির্ধারক।

কেন্দ্রীয় বিএনপির একাধিক সূত্র বলছে, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশ স্ব-স্ব এলাকায় উপস্থিত হয়ে স্থানীয় নেতৃবৃন্দদের সাথে নিয়ে আলোচনা ও মতবিনিময় করে কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত দেন। এছাড়া কমিটি করার ক্ষেত্রে বিভাগীয় সাংগঠনিক দায়িত্বে থাকা নেতৃবৃন্দদের সাথে আলোচনা ও তাদের উপস্থিত রেখে কমিটি গঠন করার কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু মুন্সিগঞ্জে এর ব্যত্যয় ঘটেছে। এছাড়াও জেলা কমিটি ঘোষণা করার পর লৌহজং উপজেলার ১২ জন জেলা কমিটিতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু এ ১২ জনের একজনও জানেননা উপজেলার আহবায়ক কমিটি হয়েছে।

লৌহজং উপজেলার বিএনপির আগের কমিটি স্থগিত করা হয়নি। তারাও জানে না নতুন কমিটি হয়েছে, ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতা কর্মীরা জানে না কমিটি হয়েছে। একইভাবে সিরাজদিখান এবং সদর উপজেলার মিরকাদিম পৌর বিএনপিরও কেউ জানে না কমিটি হয়েছে। এ নিয়ে দলের ত্যাগী নেতাদের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

তৃণমূলের একাধিক নেতাকর্মীর অভিযোগ, জেলা বিএনপির আহবায়ক আব্দুল হাই ও সদস্য সচিব কামরুজ্জান রতন মিলে তাদের পছন্দের প্রার্থীদের দিয়ে কমিটি গঠণ করেছেন। এতে ক্ষুব্দ হয়ে বিএনপির রাজনীতি থেকে সরে আশার ঘোষণাও দিয়েছেন অনেকেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা বিএনপির কয়েকজন শীর্ষ নেতাদের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকরে। তারা বলেন- আমাদের সাংগঠনিক অবস্থা দুর্বল। এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে টাকার বিনিময়ে পদ বিক্রি, ত্যাগী নেতাদের বাদ দেওয়া ইত্যাদি। ঢাকায় ব্যবসা করেন, কমিটিতে এমন নেতাদের সংখ্যাই বেশি। তাই আন্দোলন-সংগ্রামে তাঁরা উপস্থিতও থাকেন না।

তারা বলেন, আপনারা ইতোমধ্যে জেনেছেন সিরাজদিখান উপজেলা বিএনপির আহবায়ক কমিটি গঠণ হয়েছে। সেখানে যাকে আহবায়ক করা হয়েছে আব্দুল ধীরন কুদ্দুস তার বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা থাকাকালীন সময় ধরে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হওয়া তো দুরের কথা একটি জিডিও হয়নি। তার সাথে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির সাথে গোপন আতাত রয়েছে। এর কারনে তার বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়নি। কিন্তু উপজেলার শতশত নেতাকর্মী হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। এক দিনের জন্য তাদের খোঁজখবর নেননি। এছাড়া আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি বক্তব্য রেখেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও আওয়ামী লীগের সকল প্রোগ্রামে স্ব-শরীরে উপস্থিত থাকেন তিনি। এ ধরনের লোক দিয়ে কমিটি গঠন করে জেলা বিএনপির আহবায়ক আব্দুল হাই ও সদস্য সচিব কামরুজ্জান রতন।

তৃণমূলের একাধিক নেতাকর্মীর অভিযোগ, দলের সদস্য সচিব কামরুজ্জামান রতন বিগত সময়ে কোন আন্দোলন সংগ্রামে উপস্থিত হয়নি। শুধু পদ বাণিজ্য নিয়ে পরে থাকেন তিনি। তাছাড়া বিএনপির চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষনে থাকলেও তিনি ঢাকার ৫ তারকা হোটেলে আয়োজন করে মেয়ের অনুষ্ঠান করেছেন।

সিরাজদিখান উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারন সম্পাদক মাসুদুর রহমান কুট্টি বলেন, আমরা একটি অনিয়মের কথা উল্লেখ করে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। আমাদের উপজেলায় দুই ভাবে বিভক্ত হয়ে জেলা কমিটির কাছে দুইটি কমিটির আবেদন করা হয় গেলো ৬ ফেব্রুয়ারি। ঐ দিন উভয় পক্ষের সাথে বসে কমিটি গঠন করবে বলে জানায় তারা। কিন্তু আমাদের না জানিয়ে তারা একটি কমিটির অনুমোদন দিয়ে দেয়। আমাদের সাথে কোন ধরনের আলোচনা ছাড়াই কমিটি গঠন করে তারা।

বিএনপির জেলা আহবায়ক কমিটির সদস্য আওলাদ হোসেন বলেন, আমরা সিরাজদিখান থেকে জেলা আহবায়ক কমিটির সদস্য ৮ জন। ৮ জনের মধ্যে ৭ জন দেশে ও একজন বিদেশে রয়েছে। দেশে থাকা ৭ জনের মধ্যে দুইজন আহবায়ক প্রার্থী ও আমি সহ আরও ৪ জন সদস্য সচিব প্রার্থী ছিলাম। এই পর্যন্তই তারা শুনেছেন এবং জেনেছেন। পরবর্তীতে আমরা কিছুই জানি না। কমিটি গঠন হয়ে গেছে। আমাদের মনে হচ্ছে বিভাগীয় সাংগঠনিক দায়িত্বে যারা রয়েছেন তারা অবগত নন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জেলা বিএনপির সদস্য সচিব কামরুজ্জামান রতন বলেন, আমাদের দলের গঠনতন্ত্র এবং কেন্দ্রের নির্দেশনা অনুযায়ী যাচাঁই-বাছাই করে এই তিনটি কমিটি করেছি। সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট থানার যারা সদস্য রয়েছেন তাদের নিয়ে কমিটি গঠন হয়। যে কমিটি নিয়ে অভিযোগ তোলা হয়েছে সিরাজদিখান কমিটি। এই কমিটিটি সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক ও তাদের মতামতের উপর ভিত্তিতে তাদের স্বাক্ষরিত হয়ে গঠন হয়। এদের স্বাক্ষরিত কপি আমাদের হাতে রয়েছে।

তিনি বলেন, যারা অভিযোগ দায়ের করেছেন তারা বিগত ১০ বছরে কোন আন্দোলন সংগ্রামে উপস্থিত ছিল না। এছাড়া একজন অভিযোগকারী জসিম উদ্দিন খোকন গেলো ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে বিভিন্ন মিছিল মিটিং ও নৌকার শ্লোগান নিয়ে মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। নৌকার পক্ষে কাজ করেছেন। এ ধরনের ভিডিও আমাদের কাছে রয়েছে। যারা দলের পদ পায় তাদের কাছে ভালো আর যারা পদ-পদবী পায় না তাদের কাছে আমরা খারাপ এটাই স্বাভাবিক।

মুন্সিগঞ্জে গঠিত এই তিনটি কমিটি হয়েছে বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরা এ বিষয়ে জানেন কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তাদের কেন জানাতে হবে। আমাদের দলের মাননীয় মহাসচিব ও যুগ্ম মহাসচিব তাদের সাথে আলাপ করে এটা করেছি। আর কোন জেলা কমিটি ও থানা কমিটি গঠন করার ক্ষেত্রে কোন সাংগঠনিক সম্পাদককে দায়িত্ব দেয়া হয়নি।

জেলা বিএনপির আহবায়ক ও সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল হাই বলেন, যখন কমিটি দেওয়া হয় তখন তারা জানে না। এখন যখন কমিটি দেওয়া গেছে এখন তারা জানলো কেমনে। জানে সবাই, পদ না পেলে বলে আমরা জানি না। কমিটি করা হচ্ছে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট। একেকটি থানায় আছে ১২-১৩ টি করে ইউনিয়ন। এখন তাদের ঘরে ঘরে ১৪ জন করে যদি পদ দেয়া যেত তাহলে তারা খুশি হতেন। কেন্দ্রে যারা অভিযোগ দিয়েছে সেটা তাদের অধিকার। যদি এটা অন্যায় হয় তাহলে কেন্দ্র এই কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে আরেকটা কমিটি করে দিবে। এর আগেও মুন্সিগঞ্জ জেলা কমিটি নিয়ে পাল্টা কমিটি হয়েছে। কোন কমিটি করতে গেলে এমন হয়। যে তিনটি কমিটি হয়েছে তা গণতান্ত্রিকভাবে হয়েছে। বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদকরাও অবগত রয়েছেন। যদি তারা অবগত না থাকে তাহলে তারা তাদের ব্যবস্থা নিবে। কমিটি গুলো যে পদ্ধতিতে করা হয় আমরা সে পদ্ধতি অনুসরণ করেই করেছি।

ঢাকা বিভাগের দায়িত্বে থাকা কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন বলেন, কমিটি হয়েছে, আমি অবগত আছি। দলের একটা দিক নির্দেশনা আছে আমরা সেটা অনুসরণ করি। সেভাবে আমরা জেলা কমিটির সাথে যোগাযোগ করি। তারা স্থানীয় নেতাকর্মীদের সাথে আলোচনা করে কমিটি তৈরী করে। এখন জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাধারন সম্পাদক বলতে পারতে পারবে তারা কার সাথে আলোচনা করেছে।

error: দুঃখিত!