মুন্সিগঞ্জ, ১২ অক্টোবর, ২০২০, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
ইলিশ নিয়ে সরকার যখন প্রতিবছর নতুন সুখবর দিচ্ছে তখনি প্রতিবছর মা ইলিশ ধ্বংসে বিশেষ ব্যবহৃত নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল উৎপাদন বাড়ছে মুন্সিগঞ্জে।
অন্যদিকে এই নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের কারনে জাটকা, ডিমওয়ালা, পোনা মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী অকালে মারা যাওয়ায় জীববৈচিত্র্য হুমকিতে পড়ছে।
কারেন্ট জালে বড় মাছের পাশাপাশি ধরা পড়ছে জাটকা এবং পাঙাশ, রুই, কাতল ও আইড় মাছের পোনা। এ ছাড়া এ জালে ডিমওয়ালা পুঁটি, ট্যাংরা, বজুরি, কই, পাবদা, ঢেলা ও বাইলা মাছ; ব্যাঙ, সাপ ও কুঁচেসহ অন্যান্য জলজ প্রাণীও আটকা পড়ছে।
ধারনা করা হচ্ছে, অন্য বছরের চেয়ে এবছর আরও বেশি কারেন্ট জাল উৎপাদন করা হয়েছে মুন্সিগঞ্জে। ইতিমধ্যে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়া এসব কারেন্ট জাল দিয়ে মা পোনার পাশাপাশি আর মাত্র ২ দিন পর সারাদেশে মা ইলিশ ধরার মহাউৎসব শুরু হবে।
মুন্সিগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিসের তথ্য বলছে, পুরো বাংলাদেশে যে পরিমাণ কারেন্ট জালের চাহিদা রয়েছে তার ৮০ ভাগ পূরণ করছে মুন্সিগঞ্জের কারেন্ট জাল ব্যবসায়ীরা।
মুন্সিগঞ্জ মুক্তারপুর নৌ পুলিশ ফাড়ি’র তথ্য বলছে, গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুন্সিগঞ্জের দুইটি ইউনিয়ন পঞ্চসার ও রামপাল ও একটি পৌরসভার কিছু অংশে অভিযান চালিয়ে সর্বমোট ৮৩ কোটি ৬৬ লক্ষ১৮ হাজার ৫৫০ মিটার কারেন্ট জাল উদ্ধার করা হয়েছে। যার বিপরীতে উৎপাদকদের বিরুদ্ধে ১১৭ টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর আটক করা হয়েছে ২২ জনকে।
তবে ‘আমার বিক্রমপুর’ নিজস্ব অনুসন্ধানে দেখেছে, মুন্সিগঞ্জের সদর উপজেলার পঞ্চসার ও রামপালের অর্ধশতাধিক কারেন্ট জাল উৎপাদনের ফ্যাক্টরি গতকাল রোববার (১১ অক্টোবর) পর্যন্ত সচল। সেগুলোতে কারেন্ট জাল উৎপাদন চলছে।
সরেজমিনে পঞ্চসার ইউনিয়নের গোসাইবাগ, নয়াগাও, দুর্গাবাড়ি, রামেরগাও, ডিঙ্গাভাঙ্গা, সরকারপাড়া, সুতারপাড়, মালিরপাথর ও রামপাল ইউনিয়নের হাতিমাড়া, বদলপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রকাশ্যে কারেন্ট জাল উৎপাদনে ব্যস্ত রয়েছেন শ্রমিকরা।
এর চেয়েও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কারেন্ট জাল উৎপাদনের পর বিপণনের আগে শেষধাপে যেখানে পাঠানো হয় অর্থাৎ আয়রনের অন্তত ৫টি ফ্যাক্টরিতে প্রকাশ্যে কারেন্ট জাল আয়রন চলছে। যেগুলো আয়রন শেষে প্যাকেট করে দেশের বিভিন্ন জেলায় মা ইলিশ ও অন্যান্য পোনা ধরতে জেলেদের কাছে পাঠানো হবে।
মুন্সিগঞ্জে প্রকাশ্যে চলছে কারেন্ট জাল আয়রন। ভিডিও: আমার বিক্রমপুর
এই ৫ টি আয়রন ফ্যাক্টরির মালিক প্রত্যেকেই স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত। এরা নিজেদের প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন উপায়ে ‘বিনিয়োগ’ করেন।
এই কথিত প্রভাবশালীরা হলেন, পঞ্চসার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা, পঞ্চসার ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান, মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা বিএনপির সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ, রামপাল ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন পুস্তি ও পঞ্চসার ইউনিয়নের সুতারপাড় এলাকার জনৈক করিম মোল্লা।
অজ্ঞাত কারনে এসব কারেন্ট জাল আয়রনের ফ্যাক্টরিতে কোন অভিযান হয় না বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করলেও এমন অভিযোগ নাকচ করেছেন গত ১ বছরে সবচেয়ে বেশি অভিযান পরিচালনাকারী মুক্তারপুর নৌ পুলিশ ফাড়ি’র ইনচার্জ কবির হোসেন খান।
তিনি ‘আমার বিক্রমপুর’ কে বলেন, ‘যাদের নাম বলা হয়েছে তাদের সবার ফ্যাক্টরিতেই অভিযান চালিয়ে কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়েছে। ভালো কাজ করায় একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালায়। তারা চায় কোন অভিযানই যাতে না হয়।’
এ বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবায়েত হায়াত শিপলু আজ ‘আমার বিক্রমপুর’ কে বলেন, ‘কিছু কিছু অভিযোগ শুনি। সেগুলোর ব্যাপারে চোখ-কান খোলা আছে। আর কারেন্ট জালের বিরুদ্ধে আমার সর্বোচ্চ কঠোর অবস্থান রয়েছে। আজকেও আমি নিজে একটি ফ্যাক্টরিতে অভিযান চালিয়েছিলাম। প্রভাবশালী কেউ হোক আর যেই হোক সরকারের বিধি অনুযায়ীই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো।’
মা ইলিশ রক্ষায় নানা উদ্যোগ
এদিকে জানা গেছে, ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ৩ লাখ ৮৭ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ ধরা হয়েছিল, ২০১৮-১৯ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ গত ৫ বছরে দ্বিগুণ হয়েছে ইলিশ উৎপাদন। তাই এবারও ইলিশ উৎপাদনে সাফল্য ধরে রাখতে প্রতিবছরের মত আগামী বুধবার, ১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ ধরা বন্ধ ঘোষনা করেছে সরকার। এসময় দেশব্যাপী ইলিশ আহরণ, বিপণন, পরিবহন, ক্রয়-বিক্রয়, বিনিময় এবং মজুত করাও নিষিদ্ধ থাকবে।
মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবায়েত হায়াত শিপলু জানান, মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলায় জাটকা সংরক্ষণ ও মা ইলিশ রক্ষায় সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে সরাসরি জেলেদের নিয়ে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি সভা হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিসার সুনীল মন্ডল ‘আমার বিক্রমপুর’ কে জানান, ১৪ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত জাটকা সংরক্ষণ ও মা ইলিশ রক্ষায় আমাদের বিশেষ নজরদারি রয়েছে। এই ২২ দিন জেলেদের যাতে কষ্ট না হয় এজন্য সরকার ২০ কেজি করে চাল দিচ্ছে। মুন্সিগঞ্জ জেলার সিরাজদিখান বাদে ৫টি উপজেলার ২ হাজার ৯৭২ জন জেলের মাঝে এই চাল বিতরণ করা হবে।
তিনি জানান, জাটকা সংরক্ষণ ও মা ইলিশ রক্ষায় এই নিষিদ্ধ সময়ে বাজারগুলোতে নিয়মিত অভিযান চালানো হবে।
মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মনিরুজ্জামান তালুকদার ‘আমার বিক্রমপুর’ কে বলেন, জাটকা সংরক্ষণ ও মা ইলিশ রক্ষায় সরকারের দিক থেকে এ বিষয়ে জেলেদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য উদ্দীপনামূলক প্রচারাভিযান চালানো হবে। যারা মা ইলিশ ধ্বংসে চেষ্টা করবে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলবে।